সাক্ষাৎকারঃ ডাঃ মোহাম্মদ শাহজাহান

<৯, ১৪.৪, ৩৬৪-৩৬৫>

প্রতিরোধ – বরিশাল
সাক্ষাৎকারঃ ডাঃ মোহাম্মদ শাহজাহান
১৯৭২

মার্চ মাসে আমি বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় ছিলাম। ২৫শে এপ্রিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বরিশাল দখল করে নেয়। বরিশাল শহরের ৪ মাইল দূরে লাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি স্থানান্তর করা হয়। ২৫শে এপ্রিল পাকসেনাদের গুলিতে কামাল নামে একজন ছাত্র আহত হয়। আমাকে এসে খবর দেওয়া হলো। তখন সেখানকার হাসপাতালের সমস্ত ডাক্তার ভয়ে পালিয়ে যায়। আহত ছাত্রটিকে লাকুটিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, আমি এবং আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা লাকুটিয়া ঘাঁটিতে গেলাম।

 

বরিশাল শহরের পতনের পূর্বে মেজর জলিল সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করছিলেন। তিনি, লেফটেন্যান্ট হুদা এবং আরো কয়েকজন তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোক ভারতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলেন। মেজর জলিল তখন বাড়িতে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। এর আগে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ভারতে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলেন। তিনিও স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করছিলেন।

 

লাকুটিয়াতে থাকা নিরাপদ নয় মনে করে আমরা সেখান থেকে মাধবপাশা চলে গেলাম। আমরা প্রায় ৩০ জন লোক ছিলাম। তাদের মধ্যে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, লেঃ নাসিরও ছিলেন। মাধবপাশা থেকে আমরা মামুদকাঠিতে জনাব নূরুল ইসলাম মঞ্জুরের এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেলাম। এখানে আমরা শপথ গ্রহণ করি যে, আমরা সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রয়োজন হলে জীবন দিবো। এখানে বসে আমরা ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণ করি। দুটো ছেলেকে খবর আনার জন্য বরিশাল শহরে পাঠানো হয়।

 

আমরা পুলিশের এসপির লঞ্চে করে সুন্দরবনের দিকে রওয়ানা হলাম। ২৭শে এপ্রিল দুপুরের দিকে সুন্দরবনে ঢুকলাম। ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত সুন্দরবনের মধ্যে ছিলাম। সুন্দরবন, শরণখোলা, বুড়িগোয়ালিনী হয়ে ১লা মে ভারতীয় সীমান্ত হিংগলগঞ্জে পৌঁছালাম। সেদিনই ভারতের হাসনাবাদে চলে গেলাম কালিন্দী নদীর মধ্য দিয়ে।

 

এখানে এসে মেজর জলিল, লেঃ হুদা এবং আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেখা হয়। বরিশাল শহর পতনের ৪/৫ দিন পূর্বে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য তারা ভারতে গিয়েছিলেন। তারা ভারতের কাছ থেকে বেশ অস্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, এ সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সুন্দরবনের কোনো একটি জায়গায় ঘাঁটি স্থাপন করা হবে।

 

৬ মে দুটো লঞ্চে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করা হলো। আহত কামাল ও এবং লেঃ হুদাকে হাসনাবাদে আরো অস্ত্র সংগ্রহের জন্য রেখে আসা হলো। আমরা দুপুরের দিকে রওয়ানা হলাম। আমরা হিংগলগঞ্জে এসে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। সন্ধ্যার দিকে কৈখালীর সীমান্ত ঘাঁটির কাছে একটা খালের মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়লাম। আমাদের বড় লঞ্চটা আগে ছিলো এবং মেজর জলিলের লঞ্চটা ২৫/৩০ গজ পিছনে ছিলো। লঞ্চের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছিলো। বড় লঞ্চে আমি, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, এমপি মহিউদ্দিন, সেকেণ্ড লেঃ নাসির এবং আরো অনেকে ছিলো। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিলো এবং বৃষ্টি হচ্ছিলো। বুড়িগোয়ালিনীর কাছে কপোতাক্ষ নদীতে পাকিস্তানীদের দুটি গানবোট ছিলো। আমরা গানবোটগুলোর প্রায় ৫০ গজের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। তখন গানবোট থেকে আমাদের লঞ্চের উপর সার্চলাইট ফেলা হলো এবং একটা সিগন্যাল ফায়ারও করা হলো। লঞ্চটাকে নদীর পারে লাগিয়ে আমরা ছোট-খাট অস্ত্র এবং কিছু গুলির বাক্স নিয়ে তীরে লাফিয়ে পড়লাম। পিছনের লঞ্চ থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। তখন গানবোটগুলো আমাদের উপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। আমরা বাঁধের অপরদিকে গিয়ে বসে পড়লাম। এখান থেকে আমরা কিছুক্ষণ গুলিবর্ষণ করি এবং পিছনের লঞ্চের কাছে যাবার চেষ্টা করি। রাত তিনটা পর্যন্ত গানবোটের সাথে আমাদের গোলাগুলি বিনিময় হয়। আমরা লঞ্চ থেকে নামার ঘন্টাখানেক পরে লঞ্চে আগুন ধরে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়ে যায়।

 

আমরা ১৪/১৫ জন পিছনের লঞ্চের দিকে এগুতে থাকলাম। কিছুদূর গিয়ে আমি এবং আরেকজন মেডিক্যাল ছাত্র মইনুল পথ হারিয়ে ফেলি। পথ হারিয়ে আমরা আবার পিছনের দিকে যেতে থাকি। কিছুদূর গিয়ে একটা ডিঙ্গী নৌকা দেখতে পেলাম। আমরা নৌকায় উঠলাম। কিন্তু নদীর মাঝে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের উপর গানবোট থেকে সার্চলাইটের আলো এসে পড়লো। আমরা নদীতে লাফিয়ে পড়লাম এবং সাতরে নদীর অপর পাড়ে পৌঁছলাম। সেখানে একজন লোকের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। তখন ভোর হয়ে গিয়েছিলো। সে এলাকাটি ছিলো মুসলিম লীগের সমর্থকদের। পথে আমরা কয়েকবার মুসলিম লীগের দালালদের হাতে ধরা পড়েছি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। অবশেষে আমরা আবার ভারতে চলে যেতে সমর্থ হই।

Scroll to Top