<১০, ১৬.২, ৩৭৪-৩৭৬>
সাক্ষাৎকারঃতৌফিক-ই- এলাহী চৌধুরী
শেষবারের মত এপ্রিলের শেষে যশোরের বেনাপোল থেকে ভারতে পশ্চাদপসরণ করার সময় আমাদের দুঃখকষ্ট সীমাহীন ছিল।বর্ষার আগমনে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল এবং আমাদের সঙ্গীদের শোয়া দূরে থাক, মাথা গোঁজার ঠাইটুকুও ছিল না। অবিরাম বৃষ্টি, অর্ধাহার, অনাহার তার উপর আপাতদৃষ্টিতে পরাজয়ের গ্লানি মিলিয়ে আমরা অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। এই রকম অবস্থায় বাংলার মাটিকে ছেড়ে বিদেশে বিতাড়িত হওয়া যে কি মানসিক যন্ত্রণা সেটা যারা কোনদিন এই রকম অবস্থায় পড়েনি তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের মানসপটে ভেসে উঠেছিল তাদের ফেলে আসা গ্রাম, ঘরবাড়ি, বাবা- মা- স্ত্রী-পুত্র পরিজন। তাদের কাছ থেকে কতদিনের বিদায় নিয়ে যাচ্ছিল তারা জানত না।এই বেদনাবিধুর বিদায়লগ্ন আমাদের কেউ কোনদিন ভুলাতে পারবে না।
এই সময়ে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা শুরু হয়। আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে কিছুদিন বিএসএফ এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের রেশন, গোলাবারুদ এবং সরবরাহের দায়িত্ব নেন। খুব সম্ভবতঃ ১৮ বিএসএফ এর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেঈ সিং এর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯৬৫ সনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ‘বীরচক্র’ পাওয়া এই সামরিক অফিসারটি আমাদের এই চরম দুর্দিনে বাণী শুনিয়েছেন।এই সময় আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুনভাবে সংগঠন শুরু করি এবং সময়সূচি গ্রহণ করি। আমাদের সমস্ত ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ এবং অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের এবং প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের কয়েকটি কোম্পানীতে ভাগ করে দেয়া হয়।প্রায় ৩৫০ মাইল সীমান্তে(কুষ্টিয়ার উত্তর থেকে খুলনার দক্ষিণাংশে পর্যন্ত) আমাদের স্টাটেজিক দায়িত্ব ছিল কয়েকটিঃ
১। শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যূহগুলিতে শত্রুকে হয়রানি করা। ২। শত্রুর উপর অতর্কিত রেইড চালিয়ে কুষ্টিয়া জেলার উত্তর মাথা থেকে দক্ষিণে খুলনার সাতক্ষীরা- কলারোয়া রাস্তা অবধি কতগুলো বিশেষ সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মোতায়েন করা। এফ কোম্পানী কুষ্টিয়ার প্রাগপুর বিওপির বিপরীতে কমান্ডার প্রথমে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর এবং আমি।৩। শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থার বিঘ্ন সৃষ্টি করা, ব্যহত করা এবং সম্ভব হলে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। ৪।শত্রুদের ছোট ছোট দলগুলোর উপর পেট্রল পার্টির অ্যামবুশ করা ইত্যাদি। মোটামুটিভাবে শত্রুর দুর্বল জায়গাগুলিতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সরে পড়াই আমাদের দায়িত্ব ছিল। যেসব জায়গায় সম্ভব হচ্ছিল আমরা বাংলাদেশের কিছু ভেতরে সামরিক প্রতিরক্ষাব্যূহও গড়ে তুলেছিলাম।
সি কোম্পানীঃ মেহেরপুর শহরের বিপরীতে কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী।
বি কোম্পানীঃ দর্শনার বিপরীতে, কমান্ডার ছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান।
ডি কোম্পানীঃ চৌগাছার বিপরীতে, কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা।
এ কোম্পানী ছিল খুলনার ভোমরা বিওপির বিপরীতে,কমান্ডার ছিলেন প্রথমে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এবং পরে ক্যাপ্টেন মাহাবুব উদ্দিন আহমদ।
এইচ কোম্পানী ছিল বেনাপোলের বিপরীতে, প্রথমে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে আর কমান্ডার ছিলাম আমি নিজে। সর্ব দক্ষিণে জি কোম্পানী। সাতক্ষীরা- কলারোয়া রাস্তার বিপরীতে এই কোম্পানী মোতায়েন ছিল। কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন শফিউল্লাহ। এই সময় আমাদের হেডকোয়াটারে মুন্সিগঞ্জের এসি এ ফ্লাইট লেঃ জামাল যোগ দেন।
এইরকম একটা সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যূহ, যেটা এ কোম্পানী ভোমরা বিওপির আশেপাশে গড়ে তুলেছিল, তার উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ চালিয়েছিল ৩০শে মে তারিখে। প্রায় ১৭ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার গোলন্দাজ বাহিনীকে ব্যবহার করে। মুক্তিযোদ্ধারা এই দৃষ্টান্তমূলক সাহসও সংকল্পের পরিচয় দেয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন মাহবুব এই যুদ্ধ দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেন। প্রায় তিন শতাধিক শত্রুসৈন্য একজন অফিসার সহ এই যুদ্ধে হতাহত হয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন শত্রুর কয়েকটি মৃতদেহ আমাদের কৃষ্ণনগর হেডকোয়াটারে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হন। সেদিন কৃষ্ণনগরের জনসাধারণ এই লাশ দেখার জন্য হেডকোয়াটারে ভেঙ্গে পড়েছিল এবং ভারতীয় সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা মৃতদেহ দেখতে এসেছিল।
এই সময় আমাদের মূল সাংগঠনিক কাজ চলতে থাকে। আর্মি হেডকোয়াটার থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পূর্ণ শক্তিতে বলীয়ান করে তোলার। সমস্ত মুক্তিবাহিনীকে ২টা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়।১। নিয়মিত বাহিনী (ক) সেন্টার ট্রুপস (খ) রেগুলার ট্রুপস ২। অনিয়মিত বাহিনী- গণবাহিনী।
বেনাপোল পতাকা
পশ্চিম রণাঙ্গনে আমাদের সংগ্রাম এবং গৌরবের প্রতীক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাস পর্যন্ত বেনাপোল চেকপোস্টে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীয়মান ছিল। এই পতাকার পেছনের ছোট ইতিহাস আছে।
এপ্রিলের শেষদিকে যখন আমাদের জনশক্তি সীমান্তের অপর পারে চলে যায় তখনো বেনাপোল সীমান্তে উড্ডীয়মান পতাকাকে আমরা অসহায়ভাবে ফেলে যাইনি। মে মাসের প্রথমার্ধে যখন মুক্তিবাহিনীর সংগঠন এবং পুনর্বিন্যাস চলছিল তখন এই পতাকার সংরক্ষণের ভার নিয়েছিলেন ১৮-বিএস এফ এর কমান্ডার লেঃকর্নেল মেঈ সিং(বীরচক্র)। বাংলাদেশের পতাকার প্রতি এতদূর শ্রদ্ধা এবং সম্মানও অনুরাগ আমি আর কোন ভারতীয়দের মধ্যে দেখিনি। এই রাজপুত অফিসারটি আমাদের পতাকাকে সম্মান দিয়ে সমস্ত বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছিলেন এবং তিনি বারবার এই কথাই বলতেন। ১৮-বিএস এফ তাদের মেশিনগান দিয়ে এই পতাকাকে কভার করে রেখেছিল।মনে হয় একটি কাকপক্ষীও ভিড়তে পারেনি। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা বা গভীর রাতে মেশিনগান গর্জে উঠত, যদি তার আশেপাশে সামান্য গতিবিধি পরিলক্ষিত হত। মেশিনগানের আওয়াজ শুনলে আমরা বুঝতে পারতাম মেঈ সিং এর লোকজন তৎপর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের এই পতাকার আশপাশ দিয়ে কত হাজার হাজার গোলাবর্ষণ হয়েছে। পতাকাকে ধ্বংস করার জন্য পাকিস্তানীদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।পাকিস্তানীদের এই অপচেষ্টাকে কেন্দ্র করে কতজন হতাহত হয়েছে তা বোঝা মুশকিল। এই পতাকা নিয়ে সীমান্ত সবসময় সরগরম থাকত। এ ছিল আমাদের অনাগত দিনের বিজয়ের প্রতীক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্যযোগ্য যে যশোর সেনানিবাসে যখন প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট আক্রান্ত হয়( আনুমানিক এপ্রিলের প্রথমার্ধে) মেঈ সিং তার১৮ বিএসএফ ব্যাটালিয়নকে নিয়ে বাংলাদেশের ভেতর স্বীয় অনুপ্রেরণায় ঢুকে পড়েন এবং ঝিকরগাছার কাছে তার বাহিনীর সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে বিএসএফের কিছুসংখ্যক হতাহত হয় এবং কিছুসংখ্যক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। মেঈ সিং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢোকার এই সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছিলেন বিধায় ভারত সরকারের হাতে তাকে নাজেহাল হতে হয়েছিল। শুধু তাই নয় , এই সময় তিনি একবার গোপনীয়ভাবে ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে আমাদের চুয়াডাঙ্গা সদর দফতরও দেখতে আসেন।মেঈ সিং এর এই একগুঁয়েমি বেনাপোল চেকপোস্টে পরে মোতায়েনরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৭পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ন সহ্য করতে পারত না। তারা কয়েকবার প্রস্তাবও করেছিল যে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে গোলাগুলি বন্ধ হোক। কিন্ত মেঈ সিং কোনদিন এই প্রস্তাব মেনে নেননি। পরে তাঁর ব্যাটালিয়নকে এখান অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। কর্নেল মেঈ এর পথে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই পতাকা সংরক্ষণের দায়িত্ব নেন।
জুন-জুলাই মাসে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্ট বেনাপোল সীমান্ত থেকে জেড ফোর্সে যোগদান করার জন্য বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে চলে যায়। এই সময় বাংলাদেশের পতাকাটি বেনাপোলে সীমান্তে একটা স্বীকৃতি সত্য হয়ে গিয়েছিল। এরপর ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং আমার কোম্পানী মিলে এইচ কোম্পানী যৌথভাবে এই পতাকা সংরক্ষণের দায়িত্ব নেই। এবং বেনাপোল সীমান্ত থেকে প্রায় ৭০০/৮০০ গজ জায়গা নো ম্যান্স ল্যান্ড এ পরিণত হয়। আমার মনে আছে ‘ওমেগা’ রিলিফ দল যেদিন এই সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন আমিও ২/৩ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে বড় গাছগুলোর আড়াল দিয়ে ক্রল করে এগুচ্ছিলাম। চার/পাঁচ গজ দূরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকজন এদের জন্য অপেক্ষা করছিল। রাস্তার পাশ থেকে এদেরকে আমরা পতাকা দেখাই এবং বলি যে এই এলাকা আমাদের দখলে আছে। ‘ওমেগা’ দল ভয়ে ডান, বাঁয়ে তাকাতে সাহস পায়নি। এইভাবে দীর্ঘ নয়মাস আমরা বেনাপোল পতাকাকে রক্ষা করেছিলাম এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কোনদিন এই পতাকা ধ্বংস করা সম্ভব হয়নি। পতাকা যেখানে উড্ডীয়মান ছিল তার আশেপাশে পেট্রল পার্টি পাঠানো হত এবং তাদের সাথে পাকবাহিনীর প্রতিদিন গোলাগুলি বিনিময় হত। মে মাসে এই পতাকাকে সামনে রেখে বিবিসির প্রতিনিধিরা ক্যাপ্টেন হাফিজ এবং মেজর ওসমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
স্বাক্ষর/-
তৌফিক-ই- এলাহী চৌধুরী
১৪-১০-৭৩
**কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে এসডিও থাকাকালীন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।