<১০, ১৬.৪, ৩৭৭-৩৭৯>
সাক্ষাৎকারঃ অলীক কুমার গুপ্ত*
কর্নেল মঞ্জুর সাহেব ১১ই অক্টোবর তারিখে বাংলাদেশের ম্যাপ দেখালেন এবং কোথায় কোথায় অপারেশন করতে হবে তার নির্দেশ দিলেন। ১৪ই অক্টোবর কর্নেল মঞ্জুর সাহেব অপারেশনের জন্য ৩৮৫ জন গণবাহিনীর যুবককে তাদের সেক্টরে পৌঁছে দেয়ার ভার দিলেন আমার উপর। এদের নিয়ে বয়রা সাবসেক্টরে এসে মেজর নজমুল হুদার নিকট রিপোর্ট করি। ১৫ই অক্টোবর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ও পাক বাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণ করি এবং সিদ্ধান্ত নিই যে, ভারতের মধ্যে না থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকাই শ্রেয়। আমি কাশীপুরে হেডকোয়াটার স্থাপন করি এবং আমার এলাকা ছিল দক্ষিণ বেনাপোল রোড, বামে মহেশপুর থানা, জীবননগর থানা। ঝিকরগাছা থেকে বামে রাধানগরে আমার মেইন বেইস ছিল। ভারতীয় সীমান্ত থেকে চার মাইল দীর্ঘ পথ গণবাহিনীর সাহায্যে মুক্ত করি এবং সেখানে জার্মান রাষ্ট্রদূত আসেন এবং বাংলাদেশে মন্ত্রী মহোদয়গণও এসে দেখে যেতেন। অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মধুখালী গ্রামের নিকট এই দলটি পাকবাহিনীর এমবুশে পড়ে যায়। সেখানে ৩ জন আহত হয়। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছনে চলে গিয়ে কোন রকমে জীবন রক্ষা করি। অক্টোবর মাসের শেষদিকে পাকবাহিনীর ডিফেন্স দোষদিনাতে সন্ধ্যার দিকে আক্রমণ করি। এই যুদ্ধে গণবাহিনীর ১৫ জন গেরিলা অংশগ্রহণ করেন। এই আক্রমণে ৫টা চাইনিজ রাইফেল ও কিছু হেলমেট এবং খাদ্য আমাদের দখলে আসে।জনসাধারণের মুখে জানা যায়, প্রায় ১০জন খানসেনা নিহত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ১জন গেরিলা আহত হন। এই যুদ্ধে সেকেন্ড কমান্ডার ছিলেন আবদুল জলিল(সাবেক ইপিআর)।
অক্টোবরের শেষে ঝিকরগাছার ২ মাইল দূরে শিমুলিয়া সাহেব বাড়িতে পাকবাহিনী সহ ২০ জন রাজাকার ঘাঁটি করে অবস্থান করছিল। সেই ঘাঁটি থেকে পেট্রোল ডিউটিতে আসে ১০জন পাকসেনা সহ রাজাকার। এই দলের উপর আক্রমণ চালাই এবং ৩জন খানসেনা, ১জন বিহারী রাজাকার নিহত হয় এবং একজন রাজাকার আহতও তিনজন জীবন্ত ধরা পড়ে। পরে উক্ত তিনজন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর সাথে কাজ করে। এই আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ঐ মিশন ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে নভেম্বর মাসের দিকে পাকসেনারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র পুনরায় ঐ গ্রামে আক্রমণ করে এবং তিন ব্যক্তিকে হত্যা করে ও বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। পাকসেনারা সাবেক ইপিআর আবদুল জলিল ভ্রমে উক্ত তিনজনকে হত্যা করেছিল। তার পূর্বে উক্ত এলাকা থেকে আমাদের দল চলে যায়।
৩রা নভেম্বর ১২ জন গণবাহিনী ও সাবেক ইপিআর ৩০ জনকে নিয়ে ভোরের দিকে চৌগাছার বিওপির সামনে এমবুশ পেতে রাখি। সেই সময় উক্ত বিওপি পাকসেনাদের দখলে ছিল। পাকসেনাদের একটা পেট্রোল পার্টির সাথে সংঘর্ষ শুরু হয় সকাল ৯টা থেকে। যখন পেট্রোল পার্টি ধ্বংস হয়ে যায়, তখন তাদের সাহায্যের জন্য উক্ত বিওপি ক্যাম্প থেকে বহু পাকসেনা এসে আমাদের দলটি ঘিরে ফেলে এবং যুদ্ধ চলতে থাকে। নিরুপায় হয়ে তখন আমিও আমার দলবল বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে থাকি। এই সংবাদ পেয়ে সাবেক মেজর নজমুল হুদা মুক্তিফৌজ ক্যাম্প থেকে যুবকদের নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে আসেন এবং আমাদের সাহায্য করেন। ভারতীয় সৈন্যরা দূর থেকে ৩ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে মুক্তিফৌজকে সাহায্য করেন। যদিও এমবুশ করে আমাদের ফিরে যাবার ইচ্ছা ছিল কিন্ত তা সম্ভব না হওয়াতে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এর ফলে পাকসেনারা উক্ত বিওপি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে প্রায় ১৮/১৯ জন মৃত পাকসেনার লাশ নিয়ে যেতে সক্ষম হই। পরে জনসাধারণের আরো প্রায় ২০ জন পাকসেনার লাশ বিভিন্ন এলাকা উদ্ধার করে। স্টেনগান, চাইনিজ রাইফেল, এলএমজি ও ছোট একটা অয়ারলেসও উদ্ধার করি। এই যুদ্ধে একজন সাবেক ইপিআর ল্যান্স নায়েক আহত হন। পরে হাত কেটে তাকে বাঁচানো হয়।
১২ই নভেম্বর সন্ধ্যার সময় চৌহগাছা চোরামনকাটির মাঝামাঝি রোডে একটি গাড়ি সহ রোডের ব্রীজ সহ উড়িয়ে দিই আমিও আমার তিন সঙ্গী।
গুলবাগপুর গোয়ালহাট নামক স্থানে পাকসেনারা আমাদের দলের উপর ঈদের দিন আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে ৯জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন এবং ৩ জন গণবাহিনীসহ ৩জন মানুষও শহীদ হন। জনসাধারণ আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। জনসাধারণ সেই সময় এই এলাকাতে সব কাজ করেন মুক্তিবাহিনীর পক্ষে। সেই দিন কর্নেল মঞ্জুর ৬/৭ ঘণ্টার মধ্যে হৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করার হুকুম দেন। আমার আক্রমণকালে পাক বিমান আক্রমণ করে। পরে ভারতীয় সৈনিকের সাহায্যে উক্ত এলাকা পুনরায় দখল করি। এরপর আমি মিত্রবাহিনীর সাথে কাজ করতে থাকি। ভারতীয় বাহিনীর আগে এবং পাকবাহিনীর সামনে থেকে মিত্রবাহিনীকে সাহায্য করি।
২৪শে নভেম্বর গরীবপুর গ্রামে মিত্রবাহিনীর সাথে ট্যাংক যুদ্ধ হয়। সেই সময় পাকিস্তানী ১৪টি ট্যাংক ছিল। এই যুদ্ধে ৫টি ভারতীয় ট্যাংক নষ্ট হয়ে যায়।পাকিস্তানী সমস্ত ট্যাংক নষ্ট হয়ে যায়। ১৪টি ট্যাংকের মধ্যে ৮টিকে ভারত নিয়ে ছবি তোলা হয়। ২৬শে নভেম্বর চৌগাছা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
৩রা নভেম্বর আমি কামাল ও তৌফিক সাহেব মিলে নাভারন ও ঝিকরগাছা রোডের মধ্যবর্তী স্থানে একটি জীপগাড়ি উড়িয়ে দিই। ২জন খানসেনা নিহত হয়।
৭ই ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হয়। ৩ইঞ্চি মর্টার বাহিনী নিয়ে আমি নড়াইল যাই। সেখানে ১৫০জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে।
স্বাক্ষরঃ অলীক কুমার গুপ্ত
যশোর সেনানিবাস
২৮-৩- ৭৩
*১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত।