সাক্ষাৎকারঃ মোঃ নুরুজ্জামান

<৯, ৯.৫, ২৮৮-২৮৯>

সশস্ত্র প্রতিরোধে রংপুর
সাক্ষাৎকার- মোঃ নুরুজ্জামান
১৫-০৭-১৯৭৮

(স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প কর্তৃক সংগৃহীত)

 

২৭শে মার্চ রাত ৮ ঘটিকার দিকে আমরা প্রায় ২০/২৫ বাঙালি ইপিআর সমবেত হয়ে পরামর্শ সভা করি। নায়েক সুবেদার নুর মোহাম্মদ এই পরামর্শ সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি সবাইকে সাহস দিয়ে বলেন যে, যেহেতু তিনি সবারই সিনিয়র সেহেতু কোনো ক্ষতি হলে আগে তারই হবে। কিন্তু আমি ভিন্নমত পোষণ করি ও জানাই যে, অস্বস্তিকর অবস্থায় আর বসে থাকা সম্ভব নয়। এখন আমরা নিরস্ত্র। যে কোনো সময় আমাদের বিপদ হতে পারে। এখানকার অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে আমাদের পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই পরামর্শ সভায় আমরা সবাই বিপদ বুঝতে পারি কিন্তু তৎক্ষণাৎ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি নাই।

 

আমরা জানতে পেলাম যে, সাবেক বাঙালি ইপিআর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেব নিখোজ হয়েছেন। এই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের পুনরায় পরামর্শ সভা হয়। অস্ত্রসজ্জিত হয়ে পাঞ্জাবী সৈন্যদের আঘাতের স্বপক্ষে আমি উক্ত সভায় সোচ্চার হই। আমাদের পরামর্শ সভা যখন চলছিলো তখন শহরের সেনাবাহিনীর গ্যারিসনের সৈন্যরা উত্তর দিকের একটি পুলের নিকটবর্তী গৃহস্থ বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করছিলো। আমরা আগুন দেখার সাথে সাথে সৈন্যদের মেশিনগানের গুলির শব্দও শুনতে পাই। হঠাৎ দেখতে পাই পাঞ্জাবী সৈন্যদের জীপগুলো আমাদের ব্যারাকের দিকে এগিয়ে আসছে। সবাইকে গ্রামের দিকে ঢুকে পড়তে বলা হয়। আমি নিজেও নূরুল হক নামে একজন অসুস্থ বাঙালি ইপিআর’কে নিয়ে নিকটবর্তী গ্রামে ঢুকে পড়ি। ব্যারাক থেকে উত্তরে প্রায় ৫ মাইল দূরে জনৈক হিন্দু গৃহস্থ বাড়ীতে প্রথমে আশ্রয় নেই।

 

২৮শে মার্চ ভোরবেলা কালীগঞ্জ থানার এমসিএ করিমউদ্দিন সাহেবের নিকট উপস্থিত হই। তার সাথে পরামর্শ করে প্রায় ৩০ জন ছাত্রকে জোগাড় করা হয়। সীমান্তবর্তী ভারতীয় ফাঁড়ি থেকে কিংবা ভারতের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে মাইন ও এক্সপ্লোসিভ আনার জন্য ছাত্রদেরকে পাঠানো হয়। এরপর তাড়াহুড়ো করে স্থানীয় আনসার মুজাহিদ ও ছাত্রদের সমন্বয়ে প্রায় ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করে আমরা তাদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজ শুরু করি। এমসিএ করিমউদ্দিন সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ঐ দিনই রংপুর জেলার ভারত সীমান্তবর্তী পাটগ্রাম, লালমনিরহাটে, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ থানার সমস্ত ইপিআর ফাঁড়িগুলোতে সংবাদ পাঠানো হয়। এই সংবাদে সাবেক ইপিআর’দেরকে সশস্ত্র অভিযানের জন্য সংগঠিত হয়ে একযোগে রংপুর শহরে অবস্থিত সামরিক গ্যারিসনের দিকে অগ্রসর হবার জন্য আবেদন জানানো হয়েছিলো।

 

১লা এপ্রিল, সাবেক ইপিআর কোম্পানী প্রধান সুবেদার বোরহান উদ্দীন বাঙালি ইপিআর’দের সংঘবদ্ধ করে পাকিস্তানী সৈন্যদের অগ্রাভিযান প্রতিরোধের জন্য কাকিনা রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ডিফেন্স দেন। এদিকে আমি দ্রুত মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানী গড়ে তুলি। এই কোম্পানী দু’টির কমান্ডার ছিলেন যথাক্রমে মুজাহিদ তমিজ উদ্দিন এবং আনসার কমান্ডার রিয়াজ উদ্দিন। মুজাহিদ ক্যাপ্টেন তমিজ উদ্দিন পরে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে নিহত হন। মুজাহিদ ক্যাপ্টেন তমিজ উদ্দিন তার কোম্পানীসহ সুবেদার বোরহানের দল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো। কমান্ডার রিয়াজউদ্দিনকে তার কোম্পানীসহ গঙ্গাচড়া ও কালীগঞ্জ থানার তিস্তা নদীর তিনটি ঘাঁটি পাহারায় নিয়োজিত করা হয়েছিল।

 

৮ই এপ্রিল রাত একটার দিকে সুবেদার বোরহানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি কোম্পানী লালমনির থানা হেডকোয়ার্টারে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের পরপরই সুবেদার বোরহান তার কোম্পানীকে সরিয়ে কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরের দিকে নিয়ে যান।

 

৯ই এপ্রিল পাকিস্তানী সৈন্যরা কালী বাজারের কাছাকাছি এসে পড়লে আমরা সবাই সরে পড়ি। ১৪ই এপ্রিল ফুলবাড়ী থানায় উপস্থিত হই। এই ফুলবাড়ী থানাতেই সাবেক ইপিআর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেবের সাথে আমার দেখা হয়। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের সাথে ঐ সময় দ্বিতীয় কোনো অফিসার ছিলো না। তিনি আমাকে ভারত সীমান্তবর্তী থানা ভূরুঙ্গামারীতে নিয়ে যান। আমি নওয়াজেশ সাহেবের সহকারী হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করি। প্রকৃতপক্ষে ভূরুঙ্গামারী থানা হেডকোয়ার্টার ঐ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি পুরো সেক্টরে পরিণত হয়েছিলো। রংপুর জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সাবেক ইপিআর মুজাহিদ আনসার এবং স্কুল কলেজের ছাত্রবৃন্দ দলে দলে ভূরুঙ্গামারী থানায় আসতে থাকে। আমরা তাদেরকে নিয়ে ছয়টি কোম্পানী গঠন করি। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ভূরুঙ্গামারী থানা সদরেই দেয়া শুরু হয়। সুবেদার বোরহান পাঁচগাছি থেকে কাউয়াহাগা পর্যন্ত ধরলা নদীর বিস্তৃত নদী তীর এলাকাজুড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি কোম্পানী মোতায়ন করেন। অপরদিকে সাবেক ইপিআর সুবেদার আরব আলী কাউয়াহাগা থেকে গোরল মঞ্জিল পর্যন্ত অঞ্চল জুড়ে দুটি কোম্পানী মোতায়ন করেন।

 

কুড়িগ্রাম মহকুমা শহরে পাকিস্তানী সৈন্যরা অবস্থান গ্রহণ করার পর ভূরুঙ্গামারী থানার ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা যোদ্ধাদের পাঠানো হয়। তারা অধিকৃত কুড়িগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী উলিপুরে সাফল্যের সাথে গেরিলা আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়।

 

নবগঠিত বাংলাদেশ বাহিনীর সি-ইন-সি কর্নেল ওসমানী ২৪শে মে ভূরুঙ্গামারী থানা হেডকোয়ার্টার পরিদর্শনে আসেন। পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য এবং কুড়িগ্রাম শহরের সাথেই প্রবাহিত ধরলা নদীর উত্তর তীরস্থ আমাদের প্রতিরোধ ঘাঁটি মজবুত করার জন্য ভারী অস্ত্র প্রদানের আহবান জানাই। এর ফলে আমরা ভারত থেকে দুটি এসএমজি ও দুটি ৮১এম-এম মর্টার পাই। এই অস্ত্র দুটি ধরলা নদীর উত্তর তীরস্থ পাটেশ্বরী ডিফেন্স ও কাউয়াহাগা ডিফেন্সে ব্যবহার করা হয়। হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে এই অস্ত্র খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত উক্ত এসএমজি দুটো ফেরত প্রদানের নির্দেশ দেয়। ফলে এসএমজি দুটো তাড়াহুড়ো করে ফেরত দেওয়া হয়।

 

এদিকে ২৬শে মে পাকিস্তানী সৈন্যরা ভারী কামানের সাহায্যে পাটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটিতে তীব্র আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরলা তিস্তা নদীর তীর থেকে শেল বর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রের অভাবে বাংকার থেকে উঠে ভূরুঙ্গামারীর দিকে ফিরে আসতে থাকে। মূলতঃ ঐদিনই পাটেশ্বরী প্রতিরোধ ঘাঁটি ভেঙ্গে যায়।

Scroll to Top