সাক্ষাৎকারঃ মোজাফফর হোসেন

<৯, ১৩.২, ৩৫১-৩৫৩>

সিরাজগঞ্জ এলাকার সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার- মোজাফফর হোসেন

২৫-০৮-১৯৭৩
(বাংলা একাডেমির দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত)

২৫শে মার্চের ঘটনা। রাত একটার দিকে মহকুমা প্রশাসক শামসুদ্দিন সিএসপি (শহীদ) আমাকে সংগ্রাম পরিষদে জানালেন- পুলিশ, আনসার বাহিনীর যতো অস্ত্র আছে সব তোমাদের জন্য দিবো প্রতিরোধের জন্য।

 

২৬শে মার্চ বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ছুটি ভোগরত পাক বাহিনীর সেনা, আনসার, পুলিশ, ছাত্র, সাধারণ লোক, অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক সব মিলে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় অস্ত্র হিসেবে রাইফেল, বন্দুক, টু-টুবোর রাইফেল নিয়ে যুদ্ধে নামা হয়।

 

বগুড়ার আড়িয়ার বাজারে আগে থেকেই পাক বাহিনীর ঘাঁটি ছিলো। মার্চ মাসের শেষের দিকে সাধারণ লোক সামান্য অস্ত্র নিয়ে পাক বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ৩০ জনের মতো পাক সেনা ছিলো সেখানে। আকাশ পথে বিমান আক্রমণ চালায় পাক বাহিনী। ওদের গুলি ওদের গায়েই লাগে। গোলার ডাম্প থেকে আগুন লেগে যায়। বিমান বাহিনীর গুলিতেই বেশ কিছু পাক সেনা খতম হয়। তারপর জনসাধারণ ঢুকে পড়ে, অনেককে আত্মসমর্পন করায়। অনেককে হত্যা করে পিটিয়ে।

 

আমি এবং এসডিও শামসুদ্দিন সাহেব এদিন বগুড়া গিয়ে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সমঝোতা করে কিছু অস্ত্র এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ২০ জন এবং ইপিআর’এর প্রায় ৩০ জন নিয়ে সিরাজগঞ্জ চলে আসি। তখন আমাদের কাছে ছিলো ৭টি চাইনিজ রাইফেল, মার্ক ৪৬টি, রাইফেল ৫/৬টি।

 

২৬শে মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তখন আমাদের থাকা খাওয়া, বেতন সহ যাবতীয় ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ করতে থাকে।

 

সিরাজগঞ্জ যমুনার পাড়ে আমরা ৬/৭টি ছোট ধরনের কামান পেতে রাখি যার দূরত্ব এক মাইলের মতো। এই কামানগুলো তৈরী করেছিলো আমাদের স্থানীয় লোক আবুল মিস্ত্রী।

 

এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে খবর পেলাম টাঙ্গাইলের ঘাটে ৭টি লঞ্চ গেছে পাক বাহিনীকে নিয়ে যাবার জন্য। আমি তিনজন ছেলেকে এবং কিছু অস্ত্রসহ স্পীডবোট নিয়ে টাঙ্গাইল ঘাটে পৌঁছে ফাঁকা আওয়াজ করে সারেংদের আটকিয়ে ১১টি লঞ্চসহ সিরাজগঞ্জ ফিরে আসি।

 

বাঘাবাড়ীতে প্রতিরোধঃ এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে প্রায় ১৫০ জন ছেলেসহ আমি বাঘাবাড়ী ঘাটে ডিফেন্স দেই। আমার সাথে লতিফ মীর্জা, গোলাম কিবরিয়া, সোহরাব হোসেনও ছিলো। পরদিন ইপিআর, আনসার, পুলিশ ও বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে প্রায় ১০০ জন যোদ্ধা আমার এখানে পাঠিয়ে দেন এসডিও সাহেব।

 

বাঘাবাড়ীতে নদীর পাড়ে ২ মাইলব্যাপী ২০০ গজ পরপর পাকা পরিখা খনন করে সেখানে ডিফেন্স নিয়ে থাকি। তার পরদিন এসডিও সাহেব নিজে আমাদের ডিফেন্সে আসলেন প্রায় ৫০ জন ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক নিয়ে।

 

আরিচা ঘাট রক্ষা করার জন্য প্রায় ১০০ জন বেঙ্গল রেজিমেন্টে এবং ইপিআর বাহিনীর লোক নিয়ে আমি এবং এসডিও সাহেব অগ্রসর হই। কাশিনাথপুর পৌঁছালে শুনলাম আরিচার পতন ঘটেছে। তখন আমরা কাশীনাথপুরে জঙ্গলের ভিতরে আমাদের ঘাঁটি করি। সেখান থেকে ১০ মাইলের মধ্যে পাক ঘাঁটি আছে শুনলাম (গ্রামের নাম মনে নাই)। এসডিও শামসুদ্দিন সাহেবের কমান্ডে আমরা ১০০ জন তিন ভাগে ভাগ হয়ে পাক ঘাঁটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেই। একদল আক্রমণ চালাবে, একদল গাড়ী ধ্বংস করবে এবং আরেকদল ব্রিজ ধ্বংস করবে একই সময়ে। আমরা আক্রমণ করি রাত দুইটার দিকে। একই সাথে ব্রিজ ধ্বংস, ৫টি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্থ এবং ১৯ জন পাকসেনা খতম হয়েছে শুনলাম। পরদিন ভোরবেলা আমরা ফিরে আসি। আমাদের একজন ইপিআর জোয়ান গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। তাকে সিরাজগঞ্জ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই।

 

এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখের দিকে এসডিও সাহেব ফিরে আসলেন বাঘাবাড়ী ঘাট থেকে। তিনি আবার গেলেন বাঘাবাড়ী ঘাটে। আমিও গেলাম এসডিও সাহেবের সাথে। তার পরদিন পাক বাহিনী দুপুর ১টার দিকে হঠাৎ করে কাশীনাথপুর ক্যাম্প আক্রমণ করে। একজন হাবিলদারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো ক্যাম্পের। আমাদের জোয়ানরা বিশ্রাম করছিলো। ঠিক এমন সময় শত্রুরা মর্টার আক্রমণ চালায়। ৩০/৪০ মুক্তিযোদ্ধা এখানে শহীদ হয়। বাকিরা পালিয়ে যায় অস্ত্র ফেলে। পাক সেনারা আমাদের প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করে। আমি ১৫ জন উদ্ধারকর্মী নিয়ে পরদিন চারদিকে খুজতে লাগলাম আমাদের বাহিনীর লোকদের। ২ জন আহত বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ৮/১০ জন অন্যান্য জোয়ান নিয়ে বাঘাবাড়ী ঘাটে চলে আসি। আমাদের ডিফেন্স আরো জোরদার করি।

 

মে মাসের প্রথম সপ্তাহে লতিফ মীর্জাকে বাঘাবাড়ী ঘাটের দায়িত্ব আমি এবং এসডিও সাহেব অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারতে যাই। সিদ্ধান্ত হয় যে ৪ কোটি টাকার অস্ত্র কিনা হবে। পশ্চিম দিনাজপুরে ভারতীয় কর্নেলের সাথে দেখা করেন আমাদের এসডিও সাহেব। যাবার পথে হিলি সীমান্তে ক্যাপ্টেন আনোয়ার আমাদেরকে খুব বেশী অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন না জানান। তারপরই আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে দিনাজপুরে যাই। এসডিও সাহেব অস্ত্র কিনতে চান। কর্নেল জানান, এভাবে অস্ত্র বিক্রি করা যায় না। এসডিও সাহেবের না খাওয়া না স্নান। চিন্তায় মাথা প্রায় খারাপ ছিলো। তাই কর্নেল সাহেব অস্ত্র বিক্রি করতে অস্বীকার করলে এসডিও সাহেব খুব রাগারাগি করেন। বাকবিতন্ডা হয়। কর্নেল সাহেব পাক স্পাই মনে করে আমাদের দুজনকে বন্দী করেন। আমি কোনক্রমে খবর পাঠিয়ে কংগ্রেস নেতা এবং ছাত্রনেতার কাছে আমাদের অবস্থা জানাই। ছাত্রনেতা এবং কংগ্রেস এমপিদের প্রচেষ্টায় আমরা মুক্তি পাই। তারপর ফিরে আসি বাঘাবাড়ী ঘাটে।

 

ফিরে শুনলাম সিরাজগঞ্জে বাঙালি বিহারী মারামারি হয়েছে। বিহারীদের নিরাপত্তার জন্য ওসি সাহেব সকল বিহারীকে গ্রেফতার করে জেলখানাতে নিয়ে আসেন। এসডিও সাহেব ও আমি বাঘাবাড়ী ঘাটে ফিরে যাই আবার।

 

মে মাসের ২০ তারিখের দিকে বাঘাবাড়ী নদীর অপর পাড়ে পাক বাহিনী বাংকার করা শুরু করে। আমরা আক্রমণ করি। ক্রমাগত চারদিন পর তারা বিমান হামলা চালায় আমাদের উপর।

 

২৩/২৪ তারিখের দিকে আমরা পিছু হটে উল্লাপাড়া চলে আসি। আমরা প্রায় ১৫০ জন ছিলাম তখন। পাক বাহিনীকে সিরাজগঞ্জ পাঠানো হয়। আমরা প্রায় ৪০০ জন ছিলাম।
আমরা উল্লাপাড়া থেকে ২/৩ রাতে আকস্মাৎ বাঘাবাড়ী ঘাটে পাক বাহিনীর উপর হামলা করে পালিয়ে যাই।

ঘটনা প্রতিরোধঃ মে মাসের ২৫ তারিখে পাক বাহিনী উল্লাপাড়া আক্রমণ করলে আমরা ঘাটনা (সলপ) ব্রিজে আসি। আমরা সলপ স্কুলে আশ্রয় নেই। এসডিও সাহেব ও লতিফ মীর্জা আমাদের সাথে। এখানে ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ানরা বলে, “আমরা শেষ পর্যন্ত মারা যাবো, শেষবারের মতো স্ত্রী ছেলেমেয়েদের দেখতে দিন।” এসডিও সাহেব প্রত্যেককে ২০০/৩০০/১০০ টাকা করে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক মহিউদ্দিন আমাদের ছেড়ে গেলেন না।

 

শেষ সময়ে আমরা ১০০ জন ছিলাম ঘাটনাতে। এসডিও শামসুদ্দিন সাহেব নিজে কমান্ডিং অফিসার। ৪/৫ আমরা না খেয়ে ছিলাম।

 

সিদ্ধান্ত হয়, এসডিও সাহেব ৪০ জন ছেলে নিয়ে অস্ত্রসহ সিরাজগঞ্জ যাবেন সিরাজগঞ্জ রক্ষার জন্য। এখানে ২০০ মুক্তিযোদ্ধা ছিলো। আমরা ৫০/৬০ জন থাকবো ঘাটনাতে। পাক বাহিনীকে বাধা দিতে শেষ পর্যন্ত সিরাজগঞ্জে এসে শেষ যুদ্ধ হবে। সেই মোতাবেক এসডিও সাহেব চলে যান। আমি, লতিফ মীর্জা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক থাকলো ঘাটনাতে। আমি এবং লতিফ মীর্জা ১০ জনের খাবার যোগাড় করে ঘাটনা ব্রিজে রওয়ানা হই। কারণ ওখানে সামাদের নেতৃত্বে ১০ জন যোদ্ধা ছিলো পাহারায়। আমরা খাবার পৌঁছিয়ে দেখতে পেলাম একটি ট্রেন আসছে ঈশ্বরদী থেকে। আমাদের আর খাওয়া হলো না। খাবার পাঠিয়ে দিয়ে আমরা ১২ জন দুদিক থেকে ডিফেন্স নেই। আমাদের ২টি এলএমজি এবং ১০টি চাইনিজ রাইফেল ছিলো। ট্রেনটি ব্রিজের কাছে আসলে দেখলাম পাক সেনাতে ভর্তি। ওরা মাইন সরাচ্ছে আর অগ্রসর হচ্ছে। পাক সেনারা নেমে এখানে ওখানে ঘুরাফিরা করছে। মিস্ত্রিরা লাইন সারছে। ক্রমশ ৪০/৫০ জন পাক সেনা ব্রিজের একস্থানে একত্রিত হতে থাকে। পাক সেনাদের সাথে বেসামরিক পোশাকে অনেক বিহারীকে দেখলাম। ৪০/৫০ জন একসাথে হলে আমি ফায়ার ওপেন করতে বলি। সাথে সাথে ১০টি চাইনিজ রাইফেল ও ২টি এলএমজি গর্জে উঠে। ক্রস ফায়ারের সাথে সাথে সবকটি সৈনিক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বাকীরা সব ট্রেনে উঠে ট্রেনটি পিছনে নিয়ে গিয়ে অনবরত মেশিনগান এবং মর্টার দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। ৩ ঘন্টা গুলি ছোড়ার পর আমরা জঙ্গল থেকে বের হই। আমরা ক্লোজ রেঞ্জে থাকায় আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এক মাইল দূরে আমাদের ক্যাম্প গোলা পড়াতে আমাদের ছেলেরা সবাই পালিয়ে যায়। তারা মনে করে আমরা সবাই মারা গিয়েছি। রাতে কিছুদূর এসে মনে হলো যে, বাইনোকুলার ফেলে এসেছি। বাকীদের রেখে আমি ও মহিউদ্দিন ঘাটনা ব্রিজে যাই বাইনোকুলার খুঁজতে। সেখানে পৌঁছে দেখলাম একটি নৌকা দিয়ে কিছু সেনা পার হচ্ছে। কৌতুহল বশতঃ বাইনোকুলার খোঁজা বাদ দিয়ে পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কি হয় দেখার জন্য। দেখলাম চার জন সেনা পারে নামলো। আকস্মাৎ তারা হারিয়ে যায়। আমরা চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর পাতার মরমর শব্দ পেলাম এবং আমাদের দিকে ছায়ার মতো কিছু আসছে দেখলাম। আমাদের হাতের দুটি চাইনিজ এসএমজি একসাথে গর্জে উঠে। পতনের শব্দ পেলাম। পাল্টা কোনো গুলি হয় না। বুঝলাম সব খতম। তার পরপরই নদীর অপর পার থেকে ঝাঁক ঝাঁক গুলি আসতে লাগলো। আধ ঘন্টা পরে গুলি বন্ধ হলে ক্রলিং করে পালিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে এসে আর সব সাথীদের সাথে মিলিত হই। ক্যাম্পে এসে শুনি আমাদের ছেলেরা সব পালিয়েছে। লোকজন অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে, জিনিসপত্র লুট করেছে। নাম সংগ্রহ করে চারজনকে ধরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পাক বাহিনী ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালায় দু’ঘন্টা যাবৎ। বৃষ্টির মতো মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে গুলি চালায়। গুলি বন্ধ হলে আমরা পালিয়ে সিরাজগঞ্জের দিকে রওয়ানা হই।

 

Scroll to Top