সামরিক শাসনোত্তর প্রথম শহীদ দিবসে ছাত্র সমসজের বক্তব্য

<2.035.217-219>
শিরোনামঃ সামরিক শাসনোত্তর প্রথম শহীদ দিবসে ছাত্র সমাজের বক্তব্য

সূত্রঃ ছাত্র সমাজের প্রচারপত্র ।

তারিখঃ ১৯শে ফেবরুয়ারী, ১৯৬৩

 

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি
শহীদ দিবস পালন করুণ
.

বন্ধুগন,

শহীদের স্মৃতি-বিজড়িত অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বৎসারান্তে আমাদের দ্বারে সমাগত। শহীদের রক্তরঞ্জিত এই পবিত্র দিবস আমাদের আবেগ, অনুভূতি ও চেতনার এক মহৎ অংশকে জুড়িয়া আছে। অন্যান্য বৎসরের ন্যায় এবারও আমরা আমাদের শহীদ-ভাইদের পূণ্যস্মৃতির উদ্দেশ্যে আমাদের হৃদয়ের প্রেম, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করিব; আমরা যথাযোগ্য মর্যাদার সহিত এই মহান দিবস উদযাপন করিব।
.
মুখের ভাষার ন্যায়সঙ্গত দাবীকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এগারো বৎসর পূর্বে ১৯৫২ সালের এই দিনে যাহারা অকুতোভয় প্রাণ বিসর্জন দিয়াছিলেন, তাহারা সশরীরে আমাদের মধ্যে নাই বটে, তবে তাহারা যে অবিনশ্বর আদর্শ রাখিয়া গিয়াছেন আমরা তাহার উত্তরাধিকারী। ভাষার দাবী মানুষের জন্মগত অধিকারের দাবী। এগারো বৎসর পূর্বে স্বৈরাচারী শাসকচক্রের বুলেট আর বেয়নেট সেই দাবীকে স্তব্ধ করিয়া দিতে চাহিয়াছিল। নিজেদেরে বুকের তাজা রক্ত ঢালিয়া দিয়া সেই চক্রান্ত প্রতিরোধ করিয়াছিলেন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার এবং অনেক নাম না জানা শহীদ ভাইরা। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই এদেশের ছাত্র-জনতার গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক দিবস। এই ঐতিহাসিক দিবসকে কেন্দ্র করিয়া সারা পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষীর গণতান্ত্রিক স্বাধীকারের আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছে। এই দিবস আজ তাই আমাদের সুমহান জাতীয় দিবসে পরিণত হইয়াছে।
.
অন্যান্য বৎসরের চাইতে এ বৎসর এক বিশেষ পরিস্থিতিতে একুশে ফেব্রুয়ারির আগমন ঘটিতেছে। চুয়াল্লিশ মাসব্যাপী সামরিক শাসনের অবসানে দেশে গণতন্ত্রের মুক্তবায়ু প্রবাহিত হইবে এবং ছাত্র জনতার সর্বব্যাপী সমস্যা সমাধাানের বাস্তব চেষ্টার সূত্রপাত হইবে বলিয়া এবং আশা সৃষ্টি হইয়াছিল,কার্যক্ষেত্রে তাহা সম্পূর্ণ ব্যর্থ প্রতিপন্ন হইয়াছে। পক্ষান্তরে দেশময় চলিতেছে এক ঘোরতর অনিশ্চয়তা, যে অনিশ্চয়তা গণবিরোধী শাসকচক্রের গণতন্ত্র বিরোধী নীতি ও কার্যকলাপেরই অবশ্যম্ভাবী প্রতিফল। গত ফেবরুয়ারী হইতে এই ফেবরুয়ারী পর্যন্ত দলে দলে ছাত্র গেফতার করা হইতেছে, জেলে পাঠানো হইতেছে, তাহাদের উপর পুলিশের লাঠি বন্দুক বেয়নেট ব্যবহৃত হইতেছে, অনেককে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হইতে বহিস্কার করা হইতেছে, অনেককে রাস্টিকেট করা হইতেছে, অনেকের বৃত্তি বাতিল করা হইতেছে এবং প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ ছত্রসমাজের উপর সশস্ত্র গুন্ডাদল লেলাইয়া দেওয়া হইতেছে, এক কথায় নির্বিচারে ছাত্র-দলন এবং শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের উপর নজিরবীহন হামলায় এ দেশের শিক্ষা শিক্ষা-ব্যবস্থা ও শিক্ষা জীবন বিপর্যস্ত হইতে চলিয়াছে। দেশের এই ঘন-তমসাময় পরিস্থিতিতে শহীদের স্মৃতি বিজড়িত একুশে ফেব্রুয়ারি পুনরাবির্ভাব সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
.
এদিকে গণবিরোধী সরকার শহীদ মিনারের আরদ্ধ কাজ সম্পূর্ণ করার কাজে হাত দিয়াছেন। হয়তো এবারে ইহা সম্পূর্ণ হইবে। ইহা নিশ্চন্তভাবেই ছাত্র-জনতার আপোষহীন সংগ্রামের জয়ের সূচনা। কিন্তু যে গৌরবময় মহান আন্দোলনের ঐতিহ্যের এই শহীদ মিনার, বর্তমান শাসকচক্র সেই আন্দোলনকেই গলা টিপিয়া হত্যা করার জন্য যাবতীয় দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছে। কাজেই আজিকার মহান দিবসে শহীদ স্মৃতি তর্পনের সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অটল থাকার ব্যাপারে আামাদের অধিকতর সচেতন ও সংকল্পবদ্ধ হওয়া উচিত। প্রতিজ্ঞা ও কর্মে, শপথে ও সংকল্পে, আসুন আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে এই মহান দিবেষের আদর্শকে স্বার্থক করিয়া তুলি।

.

শহীদ স্মৃতি অমর হোক

শহীদ দিবসের কর্মসূচিঃ

*সকাল ৫-১৫ মিনিটে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন।

* মতাল ৫-৩০ মিনিটে প্রভাত ফেরী।

*সকাল ৬-৩০ মিনিটে কবর জিয়ারত।

*কবরস্থান হইতে শোভাযাত্র সহকারে শহর প্রদক্ষিণ ও শোভাযাত্র শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ।

* দ্বিপ্রহরে বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির ও গির্জার শহীদানদের আত্মা মাগফিরাত কামনা।

* বেলা ২-৩০ মিনিটে কার্জন হলে আলোচনা সভা ও একুশে স্মরণে গীতি নক্সা।

* সন্ধ্যা ৭টায় কার্জন হলে মিলাদ মাহফিল।

স্বাক্ষরকারীগণ

১। শ্যামাপ্রসাদা ঘোষ, সহ-সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন।

২। ওবায়দুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন।

৩। এ. কে. এম. ফজলে হোসেন, সহ-সভাপতি, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র পরিষদ।

৪। মোহাম্মদ আনিস, সাধারণ সম্পাদক, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র পরিষদ।

৫। সিদ্দিকুর রহমান, সহ-সভাপতি, মেডিক্যাল কলেজ।

৬। হায়দার আলী, সাধারণ সম্পাদক, মেডিক্যাল কলেজ।

৭। চৌধুরী সফি সামিহ, সহ-সভাপতি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল।

৮। আবুল কালাম আজাদ, সাধারণ সম্পাদক, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল।

৯। এনায়েতুর রহমান,সহ-সভাপতি, ফজলুল হক হল।

১০। শাহ আতিয়া রহমান, সাধারণ সম্পাদক, ফজলুল হক হল।

১১। আসমত আলী শিকদার, সহ-সভাপতি, ঢাকা হল।

১২। মীর্জা মোজাম্মেল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা হল।

১৩। এ. এস. সওগাতুল আলম, সহ-সভাপতি, ইকবাল হল।

১৪। এ. কে. এম. ওয়াহেদ চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক, ইকবাল হল।

১৫। আনন্দ মোহন দাস, সহ-সভাপতি, জগন্নাথ হল।

১৬। ধীরেন্দ্র নাথ বর্মন, সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ হল।

১৭। সৈয়দা শমসে আরা,সহ সভানেত্রী, মহিলা হল।

১৮। রওশন আক্তার বানু, সাধারণ সম্পাদিকা, মহিলা হল।

১৯। বদরুদ্দোজা, সহ-সভাপতি, জগন্নাথ কলেজ।

২০। আনোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ কলেজ।

২১। ফোরকান মিয়া, সহ-সভাপতি, কায়েদে আজম কলেজ।

২২। হাবিবুল্লাহ খান, সাধারণ সম্পাদক, কায়েদে আজম কলেজ।

২৩। নাসির উদ্দিন আহম্মদ, সহ-সভাপতি, ঢাকা কলেজ।

২৪। কাজী আফজালুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা কলেজ।

২৫। মোঃ জাকারিয়া,সহ-সভাপতি, পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউট।

২৬। মতিয়া চৌধুরী, সহ-সভাপতি, সহ সভানেত্রী, ইডেন কলেজ।

২৭। জাহানারা বেগম, সাধারণ সম্পাদিকা, ইডেন কলেজ।

২৮। তাহমিদা খানম, সহ সভানেত্রী, ইডেন কলেজ (ইন্টারমিডিয়েট সেকশন)।

২৯। মাজেদা খাতুন, সাধারণ সম্পাদিকা, ইডেন কলেজ (ইন্টারমিডিয়েট সেকশন)

Scroll to Top