৪৪। সৈয়দপুরে বাঙ্গালী নিধন অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ বিবরণ (৪৩৫-৪৩৬)
সূত্র-সংবাদ, ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
সৈয়দপুরে বাঙ্গালী নিধন অভিযানের একজন দুঃখিনী সাক্ষী সুরাইয়া বেগম
দু’সন্তানের জননী বেগম সুরাইয়া রহমান। বেগম সুরাইয়া রহমান হচ্ছেন সৈয়দপুরের তদানীন্তন হাউসিং এবং সেটেলমেন্ট বিভাগের মহকুমা ইঞ্জিনিয়ার শহীদ ফজলুল রহমানের পত্নী। অশ্রুসজল চোখে বেগম সুরাইয়া রহমান সেদিন আমার কাছে তাঁর স্বামী, দেবর ও ভাগ্নের শহীদ হবার কাহিনী বলেছিলেন। তিনি বললেন, ১৯৭১ সালের ১লা এপ্রিল আমার জীবনে সেই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনলো। আমার ব্যাক্তিগত জীবনে ঐদিনই হলো শহীদ দিবস। তিনি বলেছেন,১লা এপ্রিল বিকেলের দিকে প্রায় ২০জন হানাদার পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের বাঙ্গালীপুরস্থ বাসভবনে আসে। তারা সবাই আমাদের লাইন করালো। আমার সাড়ে তিন বছরের শাহনাজ পারভিন (রুমা) তখন কোলে। হানাদার বাহিনীর ভয়ে সে তাকে চেপে ধরে রয়েছে। আমার স্বামীর গলায় পবিত্র কোরান শরীফ ঝোলানো।
বাচ্চাটি কোলে। কোরান শরীফ ছুড়ে ফেলে তারা বলল, কেয়া তুম জয় বাংলা বোলতা? তোম আওয়ামী লীগকে সাথ হেয়?এই বলে তারা আমার স্বামী, তার ভাই ১ম বর্ষ এম, বি, এস-এর ছাত্র রফিকুল ইসলাম, তার ভাগ্নে এস,এস, সি পরীক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন, বাসার মালী রুহুল আমীনকে ধরে নিয়ে যায়। ছোট মেয়েটি তখন তার আব্বুর গায়ের সাথে মিশে ছিল। নামতে চায় না। কিছুতেই সে তার আব্বুকে ছাড়বে না। আমি তাকে জোর করে নামালাম তার আব্বুর কোল থেকে। হাউসিং এ- সেটেলমেন্ট বিভাগের ড্রাইভার আবাঙ্গালির আবিদ হোসেন সৈন্যদের সাথে এসেছিল। সে বাসায় ঢোকেনি, বাইরে ছিল। সে-ই হানাদারদের সব খবর দিত। তার এক ভাই নাজিরও হানাদার বাহিনীর দালালী করতো। বেগম সুরাইয়া তাঁর সুখের নীড় ভাঙ্গার কাহিনী বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। অনেক কিছু বলতে চেয়েও তিনি বলতে পারেননি।
তিনি বললেন, বাসা থেকে ওদেরকে নিয়ে বেরুবার পাঁচ মিনিট পর আমি কয়েকটা গুলির শব্দ শুনেছি। হয়তো এই গুলিতে ওদের সবাইকে এক সাথে হত্যা করা হলো। আমরা সবাই তাদের চারজনের আগমনের প্রতিক্ষা করছিলাম। আমার শাহনাজ তার পিতা, চাচা ও ভাইয়ের প্রত্যাবর্তনের জন্যে উন্মুখ হয়ে প্রহর গুনছিল। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। আসলেন মেজর গুল, মেজর জাভেদ, ক্যাপ্টেন বখতিয়ার, কর্নেল শফি। তারা আমাদের ছাদের উপর কামান বসালেন। দারুণ উত্তেজনা, অশান্তি ও দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে রাত্রি কাটালাম।
২রা এপ্রিল। ১৯৭১ সাল। আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাবার দ্বিতীয় দিন। ড্রাইভার আবিদ জানতো আমার স্বামী, দেবর, ভাগ্নে প্রমুখের ভাগ্যে কি ঘটেছিল। সে জানতো তারা তখন কোথায়। তার তখন অবাধ সুযোগ-সুবিধা। সে ঐ দিন কয়েকজন আবাঙ্গালিকে নিয়ে এসে আমাদের বাসা লুট করে নিয়ে গেলো। আমাদের পরিবারটা ছোট। বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলাম। বাসায় প্রায় ৫০/৬০ হাজার টাকার বিভিন্ন জিনিসপত্র ছিল। সেসব কিছু নিয়ে গেল। হানাদার সৈন্য বাহিনী ঐদিনই আমাদের সৈয়দপুর টেকনিক্যাল স্কুলে নিয়ে গেলো। সেখানে শুধু মহিলা আর মহিলা। কমপক্ষে ৬০০ থেকে ৭০০। সবাই এক একটি সকরুন কাহিনীর প্রতিকৃতি, জীবন্ত সাক্ষী। সেখানে আমরা হানাদার সৈন্যদের পৈশাচিক দেখেছি, শুনেছি তাদের বিদ্রুপপূর্ণ টিটকারী। এরপর আমাদেরকে দারুল উলুম মাদ্রাসায় সরিয়ে নেয়া হয়। তারপর দু’মাস পর আমরা ঢাকায় চলে আসি।