শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
প্রচারিত অনুষ্ঠান (অংশ) |
টেপ থেকে উদ্ধৃত | ২৬-৩০ মার্চ, ১৯৭১ |
“এবার তোমাদের বিদায় নিতে হবে, তবে অক্ষত অবস্থায় নয়। যে রক্ত এতদিন তোমরা নিয়েছো, সে রক্ত এবার আমরাও নেব।” বলেছেন বাংলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
“বাঙালী রেজিমেন্ট, ই-পি-আর, পুলিশ বাহিনী, মুক্তিসেনা- এগিয়ে যাও। তোমাদের সাথে রয়েছে বাংলার বিপ্লবী বীর জনতা। এরা সবাই রক্ত দিতে প্রস্তুত, আজ এরা রক্ত দেবেই এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে পাকিস্তানী হানাদারদের ওপর এরা আক্রমণ চালাবে।” বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
“পাক সৈন্যদের খতম করুন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখুন। যে পতাকা একবার বাংলার– মানুষ উড়িয়েছে,শেষ রক্তবিন্দু থাকতেও সেই পতাকা কোনোদিন তারা ভুলে যাবে না।” বলেছেন স্বাধীন বাংলার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চারজন নেতা।
মনে রাখবেন, শত্রুসৈন্য ধ্বংস হওয়া না পর্যন্ত এই যুদ্ধাবস্থা চলবেই। তাই আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে, রাতের ঘুম হারাম করে আপনারা আপনাদের বিজয়ের পথে এগিয়ে যান।
পশ্চিমা হানাদারেরা এখনো চিনতে পারেনি বাঙালী রেজিমেন্ট, ই-পি-আর, পুলিশ বাহিনী আর মুক্তিসেনা কি জিনিস। তারা ভুলে গেছে, এই বাহিনী বিভিন্ন যুদ্ধে যে শৌর্য ও বীর্য দেখিয়েছে তা তারা এখনো আন্দাজ করতে পারেনি। আমরা দৃঢ় বিশ্বাস রাখি, যে সমস্ত হানাদার পাকিস্তানী সৈন্য এখনো রয়েছে তাদের বাঙালীরা নিশ্চিহ্ন করে দেবে। জয় বাংলা।
সংগীতঃ জয়, জয়, বাংলার জয়… …।
স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মরণপণ সংগ্রাম চলেছে। বাংলার বীর সৈনিক, ইষ্ট বেঙ্গল রাইফেলস, ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ বাহিনী এবং এদেশের প্রতিটি ছাত্র, কৃষক, জনতা, হানাদার পশ্চিমা গুণ্ডা বাহিনীর আক্রমণ সাফল্যের সাথে প্রতিহত করে চলেছে। এবং বাংলার বীর সৈনিকদের আক্রমণে দিশেহারা পশ্চিমা বাহিনী পিছু হটে চলেছে এবং মর্টার, কামান এবং ট্যাঙ্কের সাহায্যে বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে গণহত্যা করে চলেছে। পশ্চিমা হানাদার বাহিনী যখন প্রতিটি আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে গতকাল রাত্রে হাসপাতালে পর্যন্ত বোমাবর্ষণ করেছে- বাংলার সাত কোটি মুক্তিপাগল মানুষের উপর যেভাবে পশ্চিমা হানাদার বাহিনী আক্রমণ করে চলেছে, তার প্রতিরোধে বাংলার মানুষকে সর্বাত্মক সহায়তা করা প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নৈতিক কর্তব্য বলে আমরা মনে করি। তাই বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ বিশ্বের কাছে আহবান জানাচ্ছে তারা যেন বাংলার মুক্তিপাগল জনগণের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। আপনাদের অবগতির জন্য আমরা আরও জানাচ্ছি যে, পশ্চিমা হানাদার বাহিনীর মেজর জেনারেল টিক্কা খান- যাকে বাংলার বীর জনতা গর্ভনর হিসাবে মেনে নিতে ………. (অস্পষ্ট) অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, সেই কুখ্যাত টিক্কা খানকে বাংলার বীর
স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রথম সম্প্রচার কেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার ভবন। ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠান প্রচারের পর হানাদার বাহিনীর বিমান আক্রমণে কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায় এবং চট্টগ্রাম সীমান্তবর্তী মুক্তাঞ্চল থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠান পুনঃপ্রচার শুরু হয়। পরবর্তীতে ২৫ মে থেকে মুজিব নগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে বেতার সম্প্রচার পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়।
* বন্ধনীযুক্ত অংশের টেপ অস্পষ্ট ও বাংলা ভাষণের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
সৈনিকেরা হত্যা করেছে। বাংলার বীর জনতা প্রতিটি অলিতে-গলিতে অস্ত্র হাতে শত্রু দের মোকাবিলা করে চলেছে। বিশ্ববাসী, আপনারা আসুন, বাংলার মানুষকে সর্বাত্মক সহায়তা করুন। আমরা জানি, ইনশাল্লাহ জয় আমাদেরই হবেই। জয় বাংলা।
আপনারা বাংলার প্রতিটি জনসাধারণকে জানিয়ে দিন যেন শত্রুর মোকাবিলায় তারা সর্বাত্মক সাহায্য করেন। বাংলার বীর সৈনিকেরা যেভাবে শত্রুর মোকাবিলা করে চলেছে, তা সত্যই প্রশংসার যোগ্য। আপনারা এগিয়ে আসুন। আপনারা কেউ শহর থেকে যাবেন না। যে যেরূপ ভাবেই পারেন বাংলার মুক্তিপাগল মানুষকে সাহায্য করুন। …… আমাদের বিভিন্ন কেন্দ্রে খাদ্য ও যেসব সামগ্রী সংগ্রহ করা আছে, আপনারা যদি পারেন, সেখানে খাদ্য ও সামগ্রী জমা দিন।
সঙ্গীতঃ … … …
ঘুম পাড়ানো তোতা পাখী লও বিদায়, লও বিদায়।
… … … … … …
. আমি বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর মেজর জিয়া। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীরদলনেতা মেজর জিয়া বংবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনুতার আন্দোলনের পক্ষে কথা বলছি।
মূলত পাঞ্জাবী অধ্যুষিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী সর্বস্তরের বেসামরিক বাঙ্গালীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তারা মূলত সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর নিরস্ত্র কর্মকর্তা ও অন্যান্যদের যাদের পরিবারকে হত্যা করা হয়নি মূলত তাদের কাউকেই রেহাই দেওয়া হয়নি। গত বৃহস্পতিবার রাত হতেই এই হত্যাকান্ড শুরু করেছে এবং যখন তারা আক্রমণ করা শুরু করে পুরো স্বাধীন বাংলার নিরস্ত্র সৈন্য, নৌ সদস্য, বিমানবাহিনীর সদস্য ও সাধারণজনগণকে হত্যা করা শুরু করে দেয়। তারা আর্টিলারী কামান, আমেরিকান, রাশিয়ান ও চীনা অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে। এছাড়াও বর্তমানে তাদের কাছে রয়েছে রাশিয়ান ট্যাঙ্ক যা ১৯৬৫ সালের তথাকথিত যুদ্ধে ইন্দোনেশিয়া আমাদেরকে দিয়েছিলো। তাদের এ সমস্ত কাজ যেমন বর্বরোচিত তেমনই জঘন্য। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, বেসামরিক কর্মচারী, সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করার ব্যাপারে তাদের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল। এই চরম মুহূর্তে সবচাইতে প্রয়োজনীয় হচ্ছে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অন্তরালে চলে যাওয়া বা গোপনে সেখান হতে কাজ চালানো। কিছুক্ষণ আগে ভয়েস অব আমেরিকা বেতারে বলা হয়েছে যে, স্বাধীন বাংলাদেশের ন্যায় আন্দোলনকে পূর্ণরূপে সমর্থন করে বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশের পাখতুনিস্তান তথাকথিত পাকিস্তান হতে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এই সময়ে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে সংঘবদ্ধভাবে মহান সংগ্রাম গড়ে তোলা। সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে আমরা এই সমস্ত দেশদ্রোহী পাঞ্জাবী সেনাদের দু’একদিনের ব্যবধানেই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করবো এবং শত্রুদের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করবোই। জয় বাংলা।
আপনারা এতোক্ষন শুনছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর নেতা মেজর জিয়ার ধারণকৃত বক্তব্য। এই সম্প্রচার মুক্ত বাংলা বেতার হতে সম্প্রচারিত হচ্ছে।
আপনারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনছেন। এবার আপনাদের মুক্তি-বাঙালী মুক্তিসেনা বাহিনীর নায়ক মেজর জিয়া আপনাদেরকে বাংলায় ভাষণ দিচ্ছেন।
আমি শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষিত স্বাধীন বাংলা প্রসংগে বলছি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধানত ……….. * পাঞ্জাবী সৈন্যরা বাংলার বেসামরিক মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তারা অফিসার এবং নিরস্ত্র সৈন্যদের হত্যা করেছে। এমন কি তাদের পরিবারদেরকেও রেহাই দেয়নি। তাদের এরকম হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে গত বৃহস্পতিবার থেকে। সেদিন থেকে তারা বাঙালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করে এবং সমস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের উপর জুলুম চালাতে থাকে। তারা আর্টিলারী কামান, আমেরিকান, রাশিয়ান ও চীনা অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে। এছাড়াও তাদের জুলুমের ভয়াবহ সামগ্রীগুলির মধ্যে ইন্দোনেশিয়া আমাদেরকে দিয়েছিলো। দুশমনদের এ সমস্ত কাজ যেমন বর্বরোচিত তেমনি জঘন্য। এই সমস্ত বর্বর হানাদারদের এখন সুপরিকল্পিত মতলব হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান রাজনীতিক নেতাদের, বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের এবং বাংলাদেশের মুক্তিসেনাদের হত্যা করা। এই চরম মুহুর্তে সবচেয়ে প্রয়োজন হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদিগকে আণ্ডারগ্রাউন্ড বা গোপন কাজে চলে যেতে হবে এবং সেখান থেকে দুর্বার আক্রমণ গড়ে তুলতে হবে। কিছুক্ষণ আগে ভয়েস অব আমেরিকা বেতারে বলা হয়েছে যে, স্বাধীন বাংলাদেশের ন্যায় আন্দোলনকে পূর্ণরূপে সমর্থন করে বেলুচিস্তান এবং সীমান্ত প্রদেশের পাখতুনিস্তান তথাকথিত পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এই সময় আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে সংঘবদ্ধভাবে মহান সংগ্রাম গড়ে তোলা। আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা পাঞ্জাবী দেশদ্রোহীদের সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করবো। এই পাঞ্জাবী দেশদ্রোহীদের বিধবস্ত করতে আমাদের সময় লাগবে মাত্র একদিন কিংবা দুইদিন। এবং এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশকে আমরা শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করবো। জয় বাংলা।
আমি বাঙালি মুক্তি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট শমসের বলছি, এতদ্বারা বাঙালি মুক্তিবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমানের তরফ থেকে এই ঘোষণা পাঠ করছি। তিনি বলেন, এমন খবর পাওয়া গেছে যে জল ও আকাশ পথে চিটাগং এবং ঢাকায় আরো অধিক সংখ্যক পাঞ্জাবি সেনা এবং অস্ত্র আনয়ন করা হচ্ছে। অতএব বাঙালি জনগণের পক্ষ থেকে বিশ্বের সকল শান্তিকামী দেশের প্রতি আমার অনুরোধ, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতার বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সব ধরনের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। এই পরিস্থিতিতে আমি নিজেকে শেখ মুজিবের অধীনে পরিচালিত স্বাধীন বাংলা মুক্তি সরকারের প্রাদেশিক প্রধান হিসেবে ঘোষণা করছি। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আরো তীব্রতা, তেজ এবং আত্মত্যাগের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে নেয়ার আহবান জানাচ্ছি। আল্লাহর রহমতে জয় আমাদেরই- জয় বাংলা। ঘোষণাটি এরকমঃ চট্টগ্রামের সকল বেসামরিক জনগণকে যার যা অস্ত্র আছে তাই নিয়ে লালদিঘী ময়দানে জমায়েত হওয়ার জন্য এবং বাঙালি মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া এবং ক্যাপ্টেন নাসেরের কাছে রিপোর্ট করার জন্য অনুরোধ করা গেল।
চট্টগ্রামে অবস্থানরত সমস্ত নাগরিকদেরকে আহবান করা হচ্ছে যে, তারা দুপুর বারোটার মধ্যে লালদিঘীর ময়দানে তাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ক্যাপটেন ভূইয়া এবং ক্যাপটেন নাসের … (অস্পষ্ট) হাজির হন। তিনারা দুপুর বারোটা পর্যন্ত আপনাদের জন্য ওখানে অপেক্ষা করবেন। দুপুর বারোটার মধ্যে আপনারা সবাই নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লালদিঘীর ময়দানে হাজির হয়ে যান। সেখানে ক্যাপটেন ভূইয়া ও ক্যাপটেন নাসের আপনাদেরকে আদেশ ও নির্দেশ দেবেন। অস্ত্রশস্ত্র পারতপক্ষে লুকিয়ে আনবেন-সাধারণ নাগরিক যাতে তা না দেখেন। আপনারা অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে আনবেন। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া লালদিঘীর ময়দানে যাবেন না। যাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র আছে শুধু তারাই লালদিঘীর ময়দানে যেয়ে হাজির হবেন। অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া কেউ ওখানে যাবেন না।
*এই অংশে টেপ অস্পষ্ট
আর একটি বিশেষ ঘোষণাঃ কুমিরায় অবস্থানরত স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনীর সংগে ক্যাপটেন ভূইয়া- ক্যাপটেন ভূইয়া দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনীর সংগে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের যে সংঘর্ষ হয়েছিল, তাতে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের তিনশত সিপাই নিহত হয়েছে। তারা এখন ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়েছে। কোন বেসামরিক নাগরিক তাদেরকে সাহায্য করবে না। পাঞ্জাবী কোন সৈনিককে বেসামরিক নাগরিক সাহায্য করবেন না। এখানেও স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনীর জয় হয়েছে। জয় বাংলা।
……স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। স্বাধীন বাংলার বাসিন্দাদের উদ্দেশে আমাদের আবেদন, আপনারা কোন অবস্থাতেই বিভ্রান্ত হবেন না। আপনাদের উৎসাহ ও মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখুন। শান্তি ও শৃংখলার সাথে প্রত্যেকটি স্বাধীন দেশের নাগরিক বাংলার মুক্তিবাহিনীর কাজে সহায়তা করুন। আমাদের মুক্তিবাহিনীর কর্মতৎপরতায় সমগ্র এলাকা মুখর। আমাদের ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানপাট চালু করেছেন যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সুলভে পাওয়া যায়। ঔষধপত্রের দোকানগুলো খোলা হচ্ছে। আপনারা যদি পরাজিত শক্রবাহিনীর তাদের সাথে কথা বলে তাদের ভাষা পরীক্ষা করবেন। তারা আমাদের বাঙালী সামরিক বিভাগের জোয়ানদের ওপর জুলুম করেছে। তাদের ক্ষমা নেই। ক্ষমা নেই। প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নেবো! নেবো! আমাদের মুক্তিবাহিনী, কুমিরায় তিনশত বেঈমান পাঞ্জাবী জোয়ান যখন পালাচ্ছিল, ক্যাপটেন ভূইয়ার নেতৃত্বে সম্পূর্ণভাবে তাদের ধ্বংস করে দিয়েছে। জয় বাংলা। জয় বাংলা। জয় বাংলা।
দুশমনরা আমাদের মুক্তিবাহিনীর পোশাক পরে চোরের মত স্বাধীন বাংলাদেশ ছেড়ে বনে-জঙ্গলে পালিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত বাংলাদেশের নাগরিকরা সজাগ দৃষ্টি রাখুন এই হানাদারদের ওপর। এদের যেখানেই পান, সাথে সাথে এদের ধরে উপযুক্ত শাস্তি দিন। এদের চেনার প্রথম উপায় হচ্ছে- যেখানে দেখেন বেশ দূরত্বে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এদের সাথে কথা বলবেন, সামনে যাবেন না প্রথমে। সন্দেহজনক লোক দেখলে বেশ দূরত্ব থেকে কথা বলে এদের পরিচয় জেনে তারপরে যদি সন্তুষ্ট হন, ছেড়ে দেবেন। নয়তো হাতের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করুন।
স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত খবর শুনুন
স্বাধীন বাংলার মুক্তিবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেছেন, স্বাধীন বাংলার গ্রাম ও শহরের কোন ব্যক্তি যেন কোন প্রকার গুজবে কান না দেন বা কোন গুজবে বিভ্রান্ত না হন। কেননা, শত্রুসৈন্যরা ছদ্মবেশে শহরে ছড়িয়ে পড়ে এসব গুজব ছড়াতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মানবতাবাদী সংস্থা স্বাধীন বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর হানাদার পাঞ্জাবীদের অমানুষিক অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করেছেন। গত পাঁচদিন ধরে শত্রুসৈন্যরা পানি, খাদ্য, বিদ্যুৎবঞ্চিত হয়ে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। তাদেরকে ভাতে পানিতে মারাই হচ্ছে উপযুক্ত প্রতিশোধ। এই উচিত সাজাই হবে তাদের প্রাপ্য। আসাম বেতার কেন্দ্রের খবরে প্রকাশ, কুখ্যাত এহিয়া সরকার বঙ্গবন্দু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে খবর প্রচারের বহু পরে বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ শোনা গেছে। আমি আবার বলছি, আসাম বেতার কেন্দ্রের খবরে প্রকাশ, কুখ্যাত এহিয়া সরকার বঙ্গবন্দু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে খবর প্রচারের বহু পরে বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ শোনা গেছে । শেখ মুজিবুর রহমান সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় বিপ্লবী পরিকল্পনা কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। মুক্তিবাহিনী প্রধান
নির্দেশ দিয়েছেন- বেসামরিক লোক, যাঁরা অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার জানেন না, তাঁদের হাতে যেসব অস্ত্রশস্ত্র আছে, তা প্রত্যেক জেলার ই-পি-আর বাহিনীর হাতে অবিলম্বে জমা দিতে হবে। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাখতুনিস্তানে অবস্থানকারী সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক বাঙালী লোকজন সম্প্রতি আশংকার কোন কারণ নেই বলে আসাম বেতার থেকে ঘোষণা করা হয়েছে।
মুক্তিবাহিনী প্রধানের খবরে প্রকাশ,নিহত টিক্কা খানের চারজন সহকারীও নিহত হয়েছে। এ খবর আপনারা শুনছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিষ্টার শরন সিং পূর্ববাংলার উপর পশ্চিমাদের সামরিক হামলার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে কোন আবেগ প্রকাশ না করার অর্থ এই নয় যে, ভারতবাসীদের মনে বাঙালীদের প্রতি সহানুভূতি ও আবেগের অভাব রয়েছে এবং এ বিষয়কে গুরুত্ব দেয়ার অর্থই হচ্ছে তারা আমাদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতিশীল। মিসেস গান্ধী স্বাধীন বাংলার মুক্তিকামী জনতার ওপর পাঞ্জাবী দস্যুদের ট্যাঙ্ক আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেছেন।
ভয়েস অব আমেরিকার খবরে প্রকাশ, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান পাখতুনিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।
বাংলাদেশের সমস্ত সরকারী-বেসরকারী অফিস, আদালত সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে। এই সম্পর্কিত তথাকথিত পাকিস্তান রেডিওর খবর সর্বৈর মিথ্যা।
খবর শুনলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। আমাদের পরবর্তী ঘোষণার জন্য একটু অপেক্ষা করুন।
বাংলাদেশের সমস্ত পেট্রোল পাম্পের মালিকদের প্রতি এক নির্দেশে স্বাধীন বাংলার মুক্তিবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেছেন, সামরিক বাহিনীর অনুমোদিত পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ যেন কোন প্রাইভেট গাড়ীর জন্য পেট্রোল বিক্রি না করেন।
আমি আবার বলছি, বাংলাদেশের সমস্ত পেট্রোল পাম্পের মালিকদের প্রতি এক নির্দেশে স্বাধীন বাংলার মুক্তিবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেছেন, সামরিক বাহিনীর অনুমোদিত পরিচয়পত্র ছাড়া কেউ যেন কোন প্রাইভেট গাড়ীর জন্য পেট্রোল বিক্রি না করেন। এই সংগে অন্যান্য নির্দেশ হচ্ছে, রাত্রে কেউ বাতি জ্বালাবেন না। কোন ঘরের আলো যেন আকাশ থেকে দেখা না যায়। সারা বাংলাদেশে সম্পূর্ণরূপে নিম্প্রদীপ থাকবে। স্বেচ্ছাসেবকরা প্রত্যেকটি গাড়ী চেক করবেন। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি বিমানবন্দরের রানওয়ে যে-কোন ত্যাগের বিনিময়ে বিমান নামার পক্ষে অনুপযোগী করে তুলুন। রাত্রে কোন বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবক কোন গোলাগুলির আওয়াজ করবেন না। কোন অবস্থাতেই কোন সক্ষম ব্যক্তি শহর ছেড়ে গ্রামে যাবেন না। ঘোষণাটি আবার পড়ছি … …
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সম্পর্কে বিশেষ ঘোষণা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রর অনুষ্ঠান সম্পর্কে একটি বিশেষ ঘোষণাঃ
এখন থেকে আমরা প্রতিদিন নিয়মিত তিনটি অধিবেশন আমাদের সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে প্রচারের ব্যবস্থা করেছি। প্রতিটি অধিবেশন আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হবে। প্রতিদিন সকাল ন’টায় আমাদের প্রথম অধিবেশন শুরু করা হবে, বেলা একটায় দ্বিতীয় অধিবেশন ও সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তৃতীয় অধিবেশন শুরু করা হবে। আবার বলছি … … … …
প্রত্যেক অধিবেশনে আপনারা খবর, দেশ-বিদেশের প্রতিক্রিয়া, সংগীত ইত্যাদি শুনতে পাবেন। মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনীর মেজর জিয়ার নির্দেশ শুনতে পাবেন। এছাড়া মুক্তিবাহিনীর বীর জোয়ান এবং বেসামরিক ব্যক্তিবিশেষের সংগে সাক্ষাৎকারও প্রচারিত হবে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিশেষ ঘোষণা ও খবর প্রচার শেষ হলো। জয় বাংলা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাহিনী- আমি এখন বাংলাদেশ স্বাধীনতা বাহিনীর মেজর জিয়ার পক্ষ থেকে একটি বাণী প্রচার করবো। এতে বলা- এ কথা প্রচারিত হচ্ছে যে আরও পাকিস্তানি পাঞ্জাবী সেনাবহর ও অস্ত্রশস্ত্র চট্টগ্রাম ও ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে সাগর ও আকাশপথে। তাই-আমি, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় দেশগুলোকে অনুরোধ জানাচ্ছি “স্বাধীন বাংলাদেশ” এর স্বীকৃতি প্রদানের জন্য এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতালব্ধ বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতা প্রদানের জন্য সকল প্রকার বাস্তবিক সহায়তা বৃদ্ধি করতে। এমতাবস্থায় আমি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছত্রচ্ছায়ায় নিজেকে স্বাধীন বাংলা মুক্তি সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বলে ঘোষণা করছি। আমি বাংলাদেশের জনগণকে এই স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি আবারও বলছি…
সমস্ত পেট্রল পাম্পের মালিকদের প্রতি-যারা গাড়ী চালানো জানেন, তারা অবি লম্বে রেষ্ট হাউজে আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে উপস্থিত হোন।
… … (নারীকণ্ঠ)- বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য বাংলার সব পুরুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এদের সাহস ও উৎসাহ যোগাতে হবে আমাদের নিজ নিজ ঘরে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখুন, এ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বাড়িতে পুরুষদের উজ্জীবিত করে প্রমাণ করুন- এ সংগ্রাম শুধু বাংলার পুরুষদের নয়, মা-বোনেরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আপনারা প্রমাণ করুন প্রতিটি বাঙালী ললনা বীর নওজোয়ানদের মা-বোন,বীরাঙ্গনা। আপনারা বগীর হাংগামার সময় যেভাবে হানাদার বর্গীদের বিরুদ্ধে তেজের সংগে রুখে দাঁড়িয়েছেন, রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন, তা এখন বৃথা যেতে দেবেন না। আপনারা সবক্ষেত্রে প্রাণপণ সাহায্য করুন। প্রতিটি ঘরে দুর্গ তৈরী হরেছেন, আজ দেশদ্রোহী পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। আপনাদের সন্তানদের প্রেরণা দিন, সাহস দিন, তাদেরকে অস্ত্র হাতে বেরিয়ে পড়তে দিন। আপনাদের কোন ভয় নেই। আমাদের স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় সারা বাংলাদেশ এখন আমাদের হাতে আমাদেরই আছে, আমাদের কাছে। আপনারা এদেশ রক্ষা করুন, আপনারাও রক্ষার কাজে পার্টিসিপেট করুন, অংশগ্রহণ করুনঅংশ নিন। আপনারা মুক্তিবাহিনীর জোয়ানদের সব রকমের সহায়তা করুন। আল্লাহর অনুগ্রহে আমাদের জয় সুনিশ্চিত। জয় ন্যায়ের ও বিনাশ অন্যায়ের হবেই হবে, এ আমাদের মনে রাখতেই হবে। জয় বাংলা। … …
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠান প্রচার এখনকার মত এখানেই শেষ হচ্ছে। আবার আমরা আপনাদের সম্মুখে উপস্থিত হবো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়।
স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনছেন।
স্বাধীন বাংলার ভাই-বোনেরা, আসসালামু আলায়কুম
মহান জননায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন । সারা বাংলাদেশে আজ যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। চিরাচরিত প্রথায় বাংলার জনসম্পদ লুণ্ঠন করার ঘৃণ্য মানসিকতা বর্জন করতে না পেরে এখনও শোষণ অব্যাহত রাখতে চায় ওরা। তাই তার সকল ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে পৈশাচিকভাবে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে সর্বপ্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে বদ্ধপরিকর এবং বাংলাদেশসহ সমগ্র পৃথিবী আজ স্তম্ভিত সামরিক শক্তির এহেন জঘন্যভাবে প্রয়োগ পৃথিবীর ইতিহাসের আর দ্বিতীয় নজীর নেই। আজ সারাদেশ সামরিক শক্তির দাপটে এবং নারকীয় হত্যাকাণ্ডে ক্ষতবিক্ষত। স্বাধীন বিপ্লবী জনসাধারণ*…….. হেনে তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় স্বাধীন বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে হানাদার তস্করের দল প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় এ শত্রুবাহিনী তাদের শক্তি বাড়াবার উদ্দেশ্যে অনবরত হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে। কুমিল্লা থেকে সৈন্য এনে তারা তাদের শক্তিকে মজবুত করতে চাইছে। ই-পি-আর ও অন্যান্য শক্তি তাদের মোকাবিলায় প্রচণ্ডভাবে যুদ্ধ চালিয়ে তুমুল যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। হানাদারদের যাতয়াতের পথ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিন। শত্রুসেনা শহরে প্রবেশ করতে চাইলে সুবিধা মত স্থানে অবস্থান করে মরিচের গুড়া, সোডা ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছড়িয়ে দিন, হাতবোমা নিক্ষেপ করুন। গ্রামের ভাইদের কাছে আমাদের আবেদন, দলে দলে শহর অভিমুখে অগ্রসর হোন এবং ক্যান্টনমেন্ট দখল করার কাজে লিপ্ত মুক্তিসেনাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করুন। শহরের ভাইদের কাছে আবেদন, আপনারা দলে দলে আন্দোলনকে সফলকাম করে তুলুন। বন্ধুগণ!……….
আজকে আমরা দেখতে পাই, নিরপরাধ নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের ওপর যেভাবে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে, দেখামাত্র গুলি করছে, হাজার হাজার মানুষ আজকে মৃত্যুবরণ করছে তার নজির এ বিশ্বের ইতিহাসে নেই। জানাবো, আপনারা এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখেও চুপ করে থাকবেন না। আসুন বিশ্ববাসী, সাড়ে সাত কোটি এই পূর্ব পাকিস্তানী ভাইদের বাঁচানোর জন্য আপনারা আমাদের সাহায্য করতে অগ্রসর হোন। বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানাই- আপনারা মানবতার খাতিরে, মানুষকে বাঁচাবার তাগিদে, বাংলার জনগণের মুক্তির জন্য অগ্রসর হোন। হে বিশ্বের অধিবাসী তোমরা দেখ, কিভাবে পশ্চিমা এই গণবিরোধী শক্তি,এই শোষক শ্রেণীর প্রতিভূ পশ্চিম- এই সাম্রাজ্যবাদীদের দালালেরা পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করবার উদ্দেশ্যে কিভাবে তাদের নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের কাছে আহবান জানাই, আপনারা চুপ করে থাকবেন না, আসুন আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করুন। বন্ধুগণ, আমি সারা বাংলার স্বাধীন বাংলার জনগণের কাছে আহবান জানাবো, বাঙালী ভাইয়েরা, আপনারা তুমুল সংগ্রামে নিজেদেরকে শরিক করুন এবং হানাদার দুশমনদের খতম করুন। যেখানে যে যে অবস্থায় আছেন, যার হাতে যে অস্ত্র আছে, সেই অস্ত্র তুলে নিন। মা-বোন বাপ-ভায়েরা বসে থাকবেন না। রাস্তায় বার হন এবং সুবিধামত স্থানে অবস্থান করে শত্রুসেনাদের ঘায়েল করুন। মারাত্মকভাবে আঘাত হানুন। আঘাতের পর আঘাত হেনে বাংলাকে মুক্ত করুন। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়বে- এদিন আর সুদূরপরাহত নয়। পরিশেষে আমি জনগণকে আহবান জানাবো, এই দেশ এই দেশের মহামান্য জননেতা, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের দেবতা, বাংলার নয়নের করবে না এবং কোন মার্শাল ল’ বাঙালীরা মানে না। আমি আহবান জানাবো- বাংলার প্রতিটি নরনারী সকলের কাছে-আপনারা মার্শাল ল’ মানবেন
টেপ অস্পষ্ট
না, মার্শাল ল’র আইনই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা স্বাধীন বাংলার নাগরিক। স্বাধীন বাংলার মহান জননায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশ আমাদের শিরোধার্য। জয় বাংলা স্বাধীন বাংলা-জয়। …
……অনুষ্ঠান শুনছেন স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে। আমাদের পরবর্তী অনুষ্ঠান বাংলা খবর।
স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী বেতার থেকে খবর বলছি। আমাদের বিপ্লবী গণবাহিনী শত্রুর দুর্ধর্ষ আক্রমণকে প্রতিহত করে সম্মুখের দিকে এগিয়ে চলছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ সামরিক ঘাঁটিতে এখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। সামরিক বিধি-বিধান, ভয়-ভীতি সবকিছুকে তুচ্ছ করে আমাদের বিপ্লবী বাঙালী সৈন্যবাহিনী শত্রুদের হটিয়ে চলছে। বাংলাদেশের মানুষের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ফলে বাংলার মাটি আজ দুর্জয় ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা, দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, চট্টগ্রাম এবং আরও কয়েকটি জেলায় সামরিক ঘাঁটি আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাতে এসে গেছে। দুনিয়ার সমস্ত মানবতার সহায়তা আমরা পাচ্ছি। খবর শুনছেন স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে। আমাদের বীর সেনানীরা বিপুল বিক্রমে দুশমন সৈন্যকে প্রতিহত করে চলছে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে মুক্তির আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি থানার পুলিশ বাহিনী আমাদের সাথে লড়ছেন। ই-পি-আর বাহিনী, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বাংলার বীর স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী, বাংলার মা-বোনেরা, বাংলার যুবক সম্প্রদায় প্রত্যেকে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে আছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে আজকের মত খবর এখানে শেষ করছি। জয় বাংলা।
স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে আমাদের বিশেষ অনুষ্ঠান আজকের মত এখানেই শেষ হলো। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন। জয় বাংলা।
.
শত্রুবাহিনী উপায়ন্তর না দেখে ট্যাঙ্ক ও মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েছে, আঘাত হানার চেষ্টা করছে। চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বাঙালীদের আয়ত্তে (একজনের হাততালি ও বাহবা) কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট দখল করে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈন্যবাহিনী ইতিমধ্যেই চট্টগ্রামে পৌঁছে গেছে। এদেশের অন্যান্য সকল স্থান বাঙালীদের সম্পূর্ণ আয়ত্তাধীনে এসে গেছে। বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। এখন খবর পড়ছি-
বাংলাদেশের পথে পথে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের প্রচণ্ড লড়াই চলছে। স্বাধীন বাংলার বিপ্লবী সৈন্যবাহিনী ও পুলিশ জনতার সাহায্য নিয়ে আক্রমণের পর আক্রমণ করে চলেছে। ঢাকার সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, পাকিস্তান হানাদার সেনাবাহিনীর কর্মাধ্যক্ষ টিক্কা খান দলবলসহ নিহত হয়েছেন। কিছুক্ষণ পূর্বে হানাদার সৈন্যদের মুখপত্র পানিস্তান রেডিও থেকে যে খবর পৌঁছেছে যে শেখ মুজিব ধৃত হয়েছেন, সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক। টিক্কা খান তার দলবলসহ নিহত হয়েছেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট সম্পূর্ণভাবে বাঙালীদের আয়ত্তাধীন। কুমিল্লা থেকে একদল সৈন্য চট্টগ্রামের পথে পালাবার সময় বাংলার বিপ্লবী ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর ও পুলিশ বাহিনী তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে ও তারা এখন তাদের আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে না পেরে বিভিন্ন অবস্থায় পালিয়ে রয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধু এক নির্দেশ জারি করেছেন যে পলায়িত সৈন্যরা যাতে কোনক্রমেই রেহাই না পেতে পারে। চট্টগ্রামের অবস্থা সম্পূর্ণভাবে বাঙালী সৈন্যদের আয়ত্তাধীন। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের হানাদার পাকিস্তানী সৈন্য বিভিন্ন অবস্থানে লুকিয়ে রয়েছে। চট্টগ্রামের বীর জনতা, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর, পুলিশ তাদের ধ্বংস করে দেয়ার কাজে লিপ্ত রয়েছে। গতকাল চট্টগ্রামের বিভিন্ন অবস্থান থেকে হানাদার বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালানো হয় এবং এতে করে
হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকটা ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। যশোর, রংপুর সিলেট এসব শহরেও এখন পর্যন্ত প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে এবং হানাদার সৈন্যদের এখন মূল লক্ষ্যস্থল হলো বেতার কেন্দ্রগুলো। তারা বেতার কেন্দ্রগুলো দখল করে সেখান থেকে ভুয়া প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু বাংলার বীর জনতা তাতে মোটেই বিভ্রান্ত না হয়ে তাদের যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন। ঢাকার পথে পথে এখন মুক্তিসেনা এবং বেংগল রেজিমেন্ট, ই-পি-আর ও পুলিশদের সাথে হানাদার সৈন্যদের প্রচণ্ড লড়াই চলছে এবং সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, টিক্কা খান তার দলবল সহ নিহত হয়েছেন। সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যের নির্দেশ অমান্য করে জনসাধারণ স্বাধীন বাংলার পাহারাদার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশক্রমে চলছেন এবং তারা বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত প্রত্যেকটি নির্দেশকে হুবহু মেনে চলছেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতিসংঘের কাছে এক আহবানে বলেছেন, যেহেতু পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা বাংলাদেশ আক্রমণ করেছে তাই জাতিসংঘের এখন উচিত বিদেশী সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে হটানোর ব্যাপারে বাংলার মুক্তিকামী মানুষকে সহযোগিতা করা। আপনারা এ খবর শুনছেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে।
টিক্কা খান সদলবলে নিহত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তার নির্দেশ জারি করে চলেছেন। তার সর্বশেষ নির্দেশ হলো যে, আপনারা জনসাধারণ যে যেখানে আছেন সেখান থেকেই পশ্চিমা সেনাবাহিনীর অবস্থান নির্দেশ করুন। এবং পশ্চিমা সেনাবাহিনী কোথায় আছে সেটা জেনে তাদের ধ্বংসকাজে লিপ্ত থাকুন। ই-পি-আর, বেংগল রেজিমেন্ট ও পুলিশ বাহিনীকে খাদ্য-পানীয় দিয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করুন। যার ঘরে যা আছে, বন্দুক, পিস্তল, রিভলভার, প্রয়োজনবোধে সেটা ই-পি-আর অথবা বেংগল রেজিমেন্টের হাতে তুলে দিন আর আপনারা যারা চালানো জানেন তারাও তৈরী হয়ে থাকুন এবং যেখানে পশ্চিমা সেনাবাহিনী দেখবেন তাদের উপর আক্রমণ করুন। তবে একটি জিনিস মনে রাখবেন যে, কোথাও বাংগালী বা অন্য কেথাও কোন সৈন্য দেখা গেলে তার প্রতি গুলি করবেন না এবং এসব করার আগে ই-পি-আর, বেংগল রেজিমেন্ট অথবা পুলিশ বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করুন। গত রাত্রেও সারা বাংলাদেশের উপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চলেছে কিন্তু বাংলার বিপ্লবী বীর জনতা পশ্চিমা হানাদার সৈন্যদের উপর আঘাতের পর আঘাত হেনে চলেছে। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিদেশের কাছে এক আবেদনে জানিয়েছেন যে, পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা বাংলাদেশ আক্রমণ করে এটাকে দখল করে নিতে চাইছে। তাই প্রত্যেকটি দেশের উচিত এ অবস্থায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা ও সাহায্য করা এবং পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর উপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে করে তারা অবিলম্বে এখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর এক নির্দেশে এ কথাও জানিয়েছেন যে … পাকিস্তানী সৈন্য যারা যেখানে আছেন তারা যদি আত্মসমর্পণ করেন তাহলে তাদেরকে ক্ষমা প্রদর্শন করা যেতে পারে। অন্যথায় বাংলার মাটি থেকে তাদের সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে এবং যাতে করে তারা বাংলাদেশ থেকে পালাতে না পারে তারও সম্পূর্ণ নির্দেশ তিনি জারি করেছেন। জয় বাংলা। বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে খবর প্রচার আপাতত এখানে শেষ হলো।
স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত একটি ঘোষণা। আমাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এখন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই পাকিস্তানী বিপক্ষ শক্তি পাগলা কুকুরের মতো আচরণ করছে এবং গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, এভাবে বাংলাদেশে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সাহসী মানুষেরা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তানিদের দেশছাড়া করার জন্য লড়ে যাচ্ছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনীর সাথে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ মিলে তাদের প্রতিহত ও প্রতিআঘাত করছে সারা বাংলাদেশজুড়ে। চট্টগ্রাম পুরোপুরি বাংলা রেজিমেন্টের দখলে চলে এসেছে পাশাপাশি কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট, যশোর ও রংপুরও । ঢাকায় তীব্র যুদ্ধ হচ্ছে এবং আমাদের সাহসী যোদ্ধারা বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
আমরা শহরে ও সদরে অবস্থানরত সবাইকে অনুরোধ করবো শহর ছেড়ে না যেতে এবং তাদের যা কিছু আছে তা দিয়েই শত্রুপক্ষের আসার সম্ভাবনা আছে এমন রাস্তার প্রতিটি মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে রাখার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে। তাদের এক ইঞ্চিও আগাতে দেয়া যাবে না বাঁধা ছাড়া। গ্রামের সকল মানুষ যাদের কাছে যেকোনোপ্রকার আগ্নেয়াস্ত্র আছে তাদের শহরের দিকে আসার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। সর্বসাধারণকেই অনুরোধ করা যাচ্ছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য, বিশেষ করে খাবার দিয়ে আমাদের সাহসী যোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য।
এখন, স্বাধীন বাংলাদেশের তরফ থেকে বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় দেশ, বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে যতটুকু সম্ভব সাহায্য প্রার্থনা করছি যেন আমরা আমাদের দেশকে আমাদের করে নিতে পারি। আমরা বিশ্বের ক্ষমতাবান শক্তিদের হস্তক্ষেপ আশা করছি এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষ যেন অবিচার, কষ্ট, আইনি অধিকার থেকে বঞ্চনা ও শোষণ এবং পাকিস্তানী শক্তির অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে পারে সেটি দেখতে বলছি। আমরা আরও অনুরোধ জানাই জাতিসঙ্ঘকে তড়িৎ…