৮৩। হানাদার বাহিনীর সহযোগী আল-বদরদের হত্যার শিকার কয়েকজন (৫০০-৫১২)
হানাদার বাহিনীর সহযোগী আল-বদরদের হত্যার শিকার কয়েকজন
সুত্র – ১৯৭৩ সালের জাতীয় দিবসে সাপ্তাহিক বিচিত্রার বিশেষ সংখ্যা
মুনীর চৌধুরী
“চৌদ্দই ডিসেম্বর খুব ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো মুনীর চৌধুরীর। হাতমুখ ধুয়ে ধীরে সুস্থে নাস্তা করলেন। তারপর আবার বিছানায়। রেডিও ছেড়ে শুয়ে শুয়ে খবর শুনতে লাগলেন। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় পাড়া নিঃঝুম। মাঝে মাঝে ভারতীয় বিমানের হামলা। দু একটা গাড়ী ভর্তি পাকিস্তানী সেনা মাঝে মাঝে ছুটে চলেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় মুনীর চৌধুরীর ফ্লাট যদিও দোতলায়, যুদ্ধের সময় তিনি নিচের একটা ফ্লাটে থাকতেন। শুয়ে শুয়ে রেডিও শুনতে শুনতে এক সময় স্ত্রীকে ডেকে বললেন, শোন, আর মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা বাকী আছে দেশ স্বাধীন হতে। সে সময় গোলার স্বরে তাঁর স্থির বিশ্বাস ফুটে উঠেছিল।
এরই মাঝে স্ত্রী এসে একবার জিজ্ঞেস করলেন তিনি আর এক কাপ চা খাবেন কিনা। সম্মতি জানালেন। তারপর চা খেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলেন।
বিছানা ছেড়ে ওঠার পর মুনীর চৌধুরী গোসল করতে ওপরে চলে গেলেন। ময়লা কাপড়-চোপড়ও কিছু ধুলেন। কারণ পরিবারের সবাই তখন ভাগাভাগি করে সংসারের কাজকর্ম সারেন। স্নান সেরে এসে স্ত্রীকে বললেন, যাও তোমার জন্য পানি গরম করে রেখেছি। তুমি গোসল করতে যাও। বলে তিনি নিজের ঘরে গিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগলেন। অসুস্থ স্ত্রীও গোসল করতে যাবার জন্য পা বাড়ালেন।
নিশ্চিন্ত মনে চুল আঁচড়াচ্ছেন মুনীর চৌধুরী। বেলা তখন বারো কি এক। এমন সময় নীচে লোহার গেটে শব্দ শোনা গেল। কে যেন দরজা ধাক্কাচ্ছে। মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী উঁকি দিয়ে দেখলেন কম বয়সী কয়েকটি বাঙালি ছেলে দরজা ধাক্কাচ্ছে। মুনীর চৌধুরী সে সময় স্ত্রীকে বললেন, থাক দেখার দরকার নেই। সরে এসো। বলে তিনি আবার চুল আঁচড়াতে লাগলেন। স্ত্রীর সাথে মুনীর চৌধুরীর ঐ ছিল শেষ কথা।
এমন সময় নীচে থেকে তাঁর ভাই ওপরে এসে বললেন, মুনীর ভাই আপনাকে নীচে ডাকছে।
মুনীর চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন, আমার নাম করে বলেছে?
হ্যাঁ।
পাঞ্জাবী পড়ে তিনি আস্তে আস্তে নীচে নেমে গেলেন। মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী লিলি চৌধুরী কিন্তু তখনও আতংকিত হননি। তাঁর স্বামীকে কেউ যে ধরে নিয়ে যেতে পারে একথাও তার মনে হয়নি। কারণ যারা তাঁকে ডাকতে এসেছে সবাই কম বয়সী, বাঙ্গালী।
তবুও লিলি চৌধুরী সিঁড়ি ধরে নীচে নামলেন। দেখলেন মুনীর চৌধুরী দাঁড়িয়ে আছেন নীচে। আশেপাশে বন্দুক নিয়ে আরেকটি অল্প বয়সী ছেলে। তিনি শুনলেন, মুনীর চৌধুরী তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের অফিসার কোথায়?
একথা বলার সাথে সাথে একটি ছেলে তাঁর পিঠের কাছে বন্দুক উঁচিয়ে বললো, আছে, আপনি চলুন। মুনীর চৌধুরী আস্তে আস্তে হেঁটে তাদের সাথে চলে গেলেন।“
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী
যুদ্ধ যখন পুরোদমে চলছে তখন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী সস্ত্রীক চলে গিয়েছিলেন ফয়জুল হকের বাসায়। শেরে বাংলার পরিবারের সাথে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু নিরিবিলি মানুষ মোফাজ্জল হায়দার ঐ বিরাট বাড়ীর হট্টগোলে থাকতে চাননি। আত্মিয়-স্বজন এমনকি স্ত্রীর অনুরোধ উপেক্ষা করে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন মালিবাগে ছোট ভাই লুৎফুল হায়দার চৌধুরীর বাসায়।
আল-বদর এবং রাজাকারেরা চৌদ্দই ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ফ্লাটে তাঁর খোঁজ করলো। পেল না। পরে তাঁর তবলীগ পন্থী চাকরের কাছ থেকে মালিবাগের ঠিকানা জেনে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো।
চৌদ্দই ডিসেম্বর দুপুরের দিকে আল-বদররা এসে হাজির হলো লুৎফুল হায়দার চৌধুরীর বাসায়। দরজায় করা নাড়ার পর লুৎফুল হায়দার দরজা খুলে দিলেন।
‘মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কোথায়?’
‘এখানেই আছেন।’
‘আমাদের অফিসার তাঁর সাথে কথা বলবেন, তাঁকে একটু ডেকে দিন।’
লুৎফুল হায়দার ডেকে দিলেন। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সাথে তাঁর স্ত্রীও এলেন বাইরের ঘরে। স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাদের অফিসার কোথায়?’
‘গাড়ীতে আছেন।’
আপনারা যে তাঁকে নিতে এসেছেন, ওয়ারেন্ট আছে আপনাদের সাথে? মোফাজ্জল সাহেবের স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।
‘আছে।’
‘আপনারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?’ ফের তাঁর স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন।
‘জানি না।’
‘বাঃ, এটা কেমন কথা’। স্ত্রী অবাক হলেন, ভয় পেলেন। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তখন বললেন, ‘ঠিক আছে আমি কাপড় পরে নেই।’
বাথরুমে তাঁর গোসলের জন্য তখন গরম পানি তৈরী। কিন্তু তিনি আর গোসল করলেন না। স্ত্রী স্যুট বের করে দিলেন। তিনি স্যুট পরে আবার বাইরের ঘরে এলেন। তাঁর স্ত্রী তখন বললেন, ‘আমি ওর সঙ্গে যাবো।’
একজন আল-বদর জওয়াব দিল, ‘আপনি তো আমাদের মায়ের মতো। আপনি আর কই যাবেন। আর উনি তো আমাদের স্যার। আমরা এখনই ওকে ফেরত দিয়ে যাবো।’
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তখন হঠাৎ বললেন, ‘আমি চাট্টি খেয়ে নিতে পারি?’
‘আমাদের ওখানে সব ব্যবস্থা আছে। আপনি চলুন।’
তিনি তখন আবার হঠাৎ বললেন, ‘ঘড়িটা পরে নেই?’
‘না, না, দরকার নেই। আপনি তো এখনই আবার চলে আসবেন।’
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী শেষ যাত্রার জন্য পা বাড়ালেন। পা বাড়াবার আগে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তো অন্যায় কিছু করিনি, তুমি ঘাবড়াচ্ছো কেন? আমি এখনই চলে আসবো।’”
অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও অধ্যাপক রাশীদুল হাসান
একসাথে আজীবন থাকতে চেয়েছিলেন। দু’জনেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রায় এক সাথে চলে এসেছিলেন। একজন চাকুরী নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, অপরজন ইংরেজী বিভাগে। আমি অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের কথা বলছিলাম।
যুদ্ধের সময় রাশীদুল হাসান নিজের বাসা ছেড়ে বন্ধু আনোয়ার পাশার বাসায় চলে আসেন। দু’বন্ধু এক সাথে থাকলে বুকে আশা থাকে, সাহস থাকে।
চৌদ্দই ডিসেম্বর সকাল সাতটায় আনোয়ার পাশার ঘুম ভেঙ্গেছে। গড়িমসি করে বিছানা ছেড়েছেন আরো পরে। তারপর দু’বন্ধু মিলে ন’টার দিকে নাস্তা করেছেন, রেডিও শুনেছেন। ন’টার খানিক পরে আনোয়ার পাশার স্ত্রী পিছনের বারান্দা দিয়ে দেখলেন একটি লাল গাড়ী এসে থামলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার চত্বরে। কয়েকজন রাজাকার নামলো।
আনোয়ার পাশা এরই মধ্যে স্ত্রীর সাথে দু’একটা খুচরো সাংসারিক আলাপ সেরেছেন। রাশীদুল হাসানের সাথে গল্পে বসার আগে হাসতে হাসতে স্ত্রীকে বললেন, কাসুটা উঠুক তারপর তোমার জন্য ভালো করে বাজার টাজার করে দেব। রাশীদুল হাসানের স্ত্রী তখন সংসারের অন্যান্য কাজে ব্যস্ত।
কিছুক্ষণ পর দরজায় নক। দরজা খুললেন আনোয়ার পাশার ছোট ভাই। তারা দরজার মুখে দাঁড়িয়ে। আনোয়ার পাশা আর রাশীদুল হাসান তখন ড্রইংরুমে। একজন আনোয়ার পাশাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার নাম আনোয়ার পাশা।’
‘হ্যাঁ।
‘আপনি বাইরে আসুন।’
এমন সময় তাদের চোখ পড়লো রাশীদুল হাসানের দিকে। জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনার নাম?’
‘রাশীদুল হাসান।’
‘আপনিও চলুন।’
সেই সময় রাশীদুল হাসানের স্ত্রী এসে দরজার মুখে দাঁড়ালেন। এ দৃশ্য দেখে তিনি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আনোয়ার পাশা এবং রাশীদুল হাসান একবার তার দিকে তাকালেন। চোখ তাঁদের ছলো ছলো। কিন্তু একেবারে নিশ্চুপ তারা। ছলো ছলো চোখে দুজনে আরেকবার তাঁর দিকে (রাশীদুল হাসানের স্ত্রী) তাকিয়ে আস্তে আস্তে আল-বদরদের সাথে পা বাড়ালেন। আনোয়ার পাশার স্ত্রী জানালা দিয়ে শুধু দেখলেন তাঁদের গায়ের চাদরে তাঁদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ডঃ সিরাজুল হক খান
যুদ্ধ যখন চরম পর্যায়ে তখন ডঃ সিরাজুল হক খান পরিবারের সবাইকে নিয়ে রাতের বেলা ফ্লাটের নীচের তলায় থাকতেন। সকালে আবার দোতলায় নিজের ফ্লাটে চলে যেতেন। ১৪ই ডিসেম্বর খুব ভোরে তিনি ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়লেন। একবার ওপরে নিজের ফ্লাটে গেলেন তারপর আবার নীচে নেমে এলেন। সে সময় তার নজরে পড়লো, একটু দূরে আল-বদর বাহিনীর কিছু লোক রুমাল দিয়ে এক ভদ্রলোকের চোখ বাঁধছে। সাথে সাথে তিনি ওপরে উঠে গেলেন। সবাইকে বললেন, ‘ওরা আমাদের এলাকায় ঢুকেছে। তোমরা সাবধানে থাকো।’ তাঁর স্ত্রী তখন তাঁর জন্য নিজের হাতে ঔষধ তৈরী করছেন। তিনি ডঃ খানকে ঔষধ খেতে ডাকলেন। জবাবে ডঃ খান ‘এসে খাবো’ বলে নীচের তলায় বোটানীর অধ্যাপক জনাব ইসমাইলের ড্রইংরুমে যেয়ে বসলেন। গল্প-গুজব করতে লাগলেন। এদিকে আল-বদর বাহিনী ওপর তলায় তাঁর ফ্লাটে এসে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা ডঃ সিরাজুল হকের বাসা?’
‘হ্যাঁ।’
‘তিনি কোথায়?’
‘নীচে গেছেন।’
‘কোন বিভাগের অধ্যাপক তিনি?’
‘শিক্ষা-গবেষণা কেন্দ্র।’
‘হ্যাঁ, আমরা তাঁকেই খুঁজছি।’
এই বলে তারা ডঃ খানের ভাইকে নিয়ে ইসমাইল সাহেবের ড্রইংরুমে উপস্থিত হলো। ডঃ খানকে তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলো। তারপর তাঁকে ঘর থেকে বাইরে এনে তাঁরই পকেটের রুমাল দিয়ে তাঁর চোখ বেঁধে অচেনা গন্তব্যের দিকে নিয়ে চললো। পরিবারের সবাই তাকিয়ে রইলো বিমূঢ় হয়ে।
ডঃ খান স্ত্রীকে বলে গিয়েছিলেন, নীচে থেকে এসে ঔষধ খাবেন। স্ত্রীর সাথে ঐ ছিলো তাঁর শেষ কথা। কিন্তু ঔষধ খেতে তিনি আর ফিরে আসেননি।
ডঃ আবুল খায়ের
ডঃ আবুল খায়েরের সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত ছিল। একদিন রাস্তা দিয়ে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ লাল বাতি। গাড়ী থামালেন। এদিকে লাল বাতি সবুজ হয়ে আবার লাল হয়ে গেছে, কিন্তু তিনি চুপচাপ গাড়ী নিয়ে বসে আছেন। এমন আপন ভোলা লোককেও আল-বদররা চৌদ্দই ডিসেম্বর তুলে নিতে ভুলে যায়নি।
ডঃ খায়েরের ফ্লাট নীচের তলায়। চৌদ্দই ডিসেম্বর সকাল আটটায় পায়জামা এবং শার্ট পরে, স্ত্রীর গরম চাদর গায়ে সিঁড়ির সামনে তিনি পায়চারী করছিলেন। ভাবছিলেন, কার্ফু উঠলেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিরাপদে কোন জায়গায় চলে যাবেন। এমনি সময় আল-বদরের লোক এসে হাজির। তারা তাঁকে ঐ পায়চারী করা অবস্থায় ধরে নিয়ে চলে গেল।
ডঃ খায়ের তাঁর স্ত্রীকে কিছু বলে যেতে পারেননি। আল-বদরের লোকের সঙ্গে কি কথা হচ্ছিল তাও কেউ শোনেনি।
সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য
সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুরাগীরা তাঁকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন দেশ ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু তিনি যাননি। স্বাধীনতা দেখে যেতে চেয়েছেন এখান থেকে।
জীবনের শেষ দিন সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য বেশ ভোরেই ঘুম থেকে উঠেছিলেন। যথারীতি নাস্তা করে রেডিও শুনেছেন। তারপর আহ্নিক করতে বসেছেন। সকাল তখন সাড়ে আট কি নয়। আহ্নিকে বসবার আগে মেয়ে স্বপ্নাকে ডেকে বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছেরে মা, খুব শীঘ্রই তোর দাদাকে দেখতে পারবি। স্বপ্নার দাদা অর্থাৎ সন্তোষ বাবুর বড় ছেলে কলকাতায় থাকতেন।
সন্তোষ ভট্টাচার্য আহ্নিকে ব্যস্ত এমন সময় দরজায় ধাক্কা। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো এক বাঙ্গালী যুবক। কাঁধে স্টেন।
উর্দুতে জিজ্ঞেস করলো, ‘কই হ্যায়?’
এমন সময় সন্তোষ বাবু বেরিয়ে এলেন। যুবকটি তাঁর নাম জিজ্ঞেস করে তাঁকে নিয়ে যেতে চাইলো।
সন্তোষ বাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার কি অপরাধ?’
‘চুপ, বেশী কথা বলবেন না।’
‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’
‘যেখানে খুশী।’
তারা তাঁকে বাসা থেকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। চোখ বাঁধলো এবং সেই শেষ বাসে নিয়ে তুললো।
ডাক্তার আলীম চৌধুরী
২৯ নম্বর পুরানা পল্টনের দোতলায় থাকতেন মিটফোর্ড হাসপাতালের ডাক্তার আলীম চৌধুরী। তাঁর নীচের তলায় থাকতেন মওলানা আব্দুল মান্নান, নীচের তলায় আগে ডাক্তার আলীমের ক্লিনিক ছিল। কিন্তু মাওলানা সাহেব একবার বিপদে পড়ে প্রাক্তন স্পীকার এ, টি, এম, মতিনকে ধরে বসেন আশ্রয়ের জন্যে। মতিন সাহেব আলীম সাহেবকে বললেন, ডাক্তার চৌধুরী, ক্লিনিক উঠিয়ে মওলানাকে আশ্রয় দিন।
১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় তখন ভারতীয় বিমান হরোদমে বোমা বর্ষণ করছে। কার্ফ্যুও চলছে। শুধু সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত কার্ফু উঠানো হল।
আলীম চৌধুরী ভাবছিলেন, এ ফাঁকে একবার অন্য কোন জায়গায় আশ্রয় নেয়া যায় কিনা দেখে আসবেন এবং একবার হাসপাতালটা ঘুরে আসবেন।
তাঁর স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল না তখন তিনি বের হন। আলীম চৌধুরী বেরুবেনই। স্ত্রীকে বললেন, আমাকে তো একবার হাসপাতালে যেতেই হবে। ডাক্তার মানুষ আমি যদি না যাই তো কে যাবে? তারপর বললেন, আমি যতো তাড়াতাড়ি পারি ফিরবো। তুমি তৈরী থেকো। আমি ফিরলে সবাইকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো। আলীম চৌধুরীর স্ত্রী বললেন, তুমি ঠিক মতো ফিরবে- তাহলেই হয়েছে। তুমিও কার্ফ্যুর সময় পার করে দিয়ে আসবে আর আমাদেরও যাওয়া হবে।
আলীম চৌধুরী স্ত্রীকে বারবার কথা দিলেন যে কার্ফুর অনেক আগেই তিনি ফিরবেন। তারপর কেরোসিনের একটি টিন নিয়ে গাড়ীতে গিয়ে উঠলেন। বাসায় তখন কেরোসিনের অভাব।
গাড়ী করে হাসপাতালে গেলেন ডাঃ চৌধুরী। হাসপাতালে তাঁর সহকর্মীরা তো তাঁকে দেখে অবাক। এই দুর্যোগ আর উনি কিনা এসেছেন হাসপাতালে। তারা বললেন, ডাক্তার সাহেব, আপনি যখন এসেই পড়েছেন তখন আর বাড়ী ফিরতে পারবেন না। এখানেই থেকে যান। ডাক্তার আলীম বললেন, ‘না, না, বাসায় সবাইকে রেখে এসেছি। বাড়ী ফিরে ওদেরকে নিয়ে আবার বেরুতে হবে।’
এরপর ডাঃ চৌধুরী গেলেন মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রিন্সিপাল ডাক্তার লতিফের সাথে দেখা করতে। উদ্দেশ্য তিনি যদি একটা সাময়িক আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করে দেন, কারণ তখন অনেক ডাক্তার সপরিবারে হাসপাতালের কেবিনগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন ডাঃ চৌধুরীও সেরকম একটা আশ্রয় চাচ্ছিলেন। কিন্তু ডাঃ লতিফ আলীম চৌধুরীকে সেরকম কোন আশ্রয় দিতে সম্মত হলেন না।
অতঃপর ডাঃ চৌধুরী বিমর্ষ মনে হাসপাতাল ছেড়ে বেরুলেন। ভাইপোর বাসায় যাবেন কেরোসিন আনতে। কেরোসিন নিলেন। ভাইপোকে তেলের দাম দিলেন। ভাইপো তো হেসে অস্থির। ডাঃ চৌধুরী তখন বললেন, ‘দেখ, মানুষের মরার কথা তো বলা যায় না। এই এখন আমাকে দেখছিস কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমি তো নাও বেঁচে থাকতে পারি।’
ডাঃ চৌধুরী বাড়ী ফেরার জন্য গাড়ীতে উঠবেন ঠিক এই সময় কার্ফুর সাইরেন বেজে উঠলো। ভাইপো তাঁর হাত ধরে তাঁকে থেকে যেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি বাসায় যাবেনই। তাকে বললেন, ‘আমার গাড়ীতে রেডক্রস চিহ্ন আছে। কিছু ভেবোনা। আমি ঠিক ঠিক বাসায় পৌঁছে যাবো।’
বাসায় ফিরলেন। স্ত্রী সাথে সাথে ঝংকার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কি বলেছিলাম, সেই কার্ফু পার করে দিয়েই তো ফিরলে।’
তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে। কাল একেবারে সক্কালেই চলে যাবো।’
বেলা দুটো থেকে আবার বোমা বর্ষণ শুরু হলো। দোতলার বারান্দায় বসে সেই বোমা বর্ষণ দেখছিলেন ডাঃ চৌধুরী। বিকাল সাড়ে চার। একটা মাইক্রোবাস এসে থামলো বাসার নীচে। কয়েকজন আলবদর নামলো। ডাক্তার চৌধুরীর স্ত্রী একটু উঁকি দিয়ে দিয়ে তাদের দেখছিলেন। তখন তিনি বললেন, অতো উঁকিঝুঁকি দিয়ো না। বোধহয় আর্মি এসেছে। বলে তিনি বাথরুমে গেলেন। ব্যাপারটার তেমন গুরুত্ব দেননি স্বামী-স্ত্রী। কারণ মওলানা মান্নানের বাসায় হরদম এ ধরনের লোকজন আসা-যাওয়া করতো।
বাথরুম থেকে তিনি বেরিয়েছেন, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো।
ডাঃ চৌধুরী হঠাৎ বিমূঢ় হয়ে গেলেন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এলোমেলোভাবে বললেন, ও, এসেছে, তা দরজা খুলে দাও।
একথা বলেই তিনি নীচে নামার উদ্যোগ নিলেন। ডাঃ চৌধুরীর মা তখন বলে উঠলেন, ‘আরে কোথায় যাচ্ছো?’
তিনি বললেন, ‘নীচে, মওলানার কাছে, কারণ মওলানা বলেছিল, এ ধরণের কোন ব্যাপার ঘটলে যেন তাকে খবর দেয়া হয়।
নীচে নেমে তিনি মওলানার দরজা ধাক্কা দিতে লাগলেন। এমনিতে মওলানার দরজা সব সময় খোলা থাকতো কিন্তু সেদিন দরজা বন্ধ। এদিকে ডাঃ চৌধুরী দরজা ধাক্কাচ্ছেন, চীৎকার করে মওলানাকে দরজা খুলতে বলছেন। কিন্তু মওলানার কোন সাড়াশব্দ নেই। খানিক পর মওলানা ভিতর থেকে বললেন, ভয় পাবেন না। আপনি যান। আমি আছি।
তিনি ফের উপরে ওঠার জন্য পা বাড়ালেন। এমন সময় আলবদরের আদেশ ‘হ্যান্ডস আপ, আমাদের সাথে এবার চলুন।’
‘কি ব্যাপার কোথায় যাবো?’ প্রশ্ন করলেন ডাঃ চৌধুরী।
‘আমাদের সাথে চলুন।’
‘প্যান্টটা পরে আসি।’
‘কোন দরকার নেই।’
আলবদররা তাঁকে ঘিরে ধরলো। আস্তে আস্তে তিনি মাইক্রোবাসের দিকে অগ্রসর হলেন।
শহীদুল্লাহ কায়সার
এমনিতে শহীদুল্লাহ কায়সার খুব কথা বলতেন। কিন্তু যেদিন যুদ্ধ শুরু হলো সেদিন থেকে তিনি চুপ। সারাদিন টেনশনে থাকেন। যুদ্ধের আগে তাঁকে অনেকে বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু তিনি রাজী হননি। কারণ তিনি ব্যস্ত ছিলেন একটি উপন্যাস রচনায়। তাই তিনি বলতেন, ‘যুদ্ধ আমাকে দেখতে হবে। কারণ তথ্যগুলো আমার উপন্যাসে লাগবে।’
চৌদ্দই ডিসেম্বর। সকাল বেলায় দেখা গেল বিদেশী দূতাবাসের নম্বর প্লেট লাগানো একটি গাড়ী এসে শহীদুল্লাহ কায়সারের বাড়ী থেকে একটু দূরে দাঁড়ালো। অনেকক্ষণ গাড়ীটা সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে তারপর একসময় চলে গেল।
সকাল ন’টা-দশটার দিকে সদরী ইস্পাহানীর টেলিফোন।
‘কি করবো কায়সার সাহেব?’
কায়সার সাহেব তাঁকে অভয় দিলেন।
বেলা তখন তিনটা। বারান্দায় স্ত্রীর সাথে বসে আছেন তিনি। এমন সময় দেখলেন টুপি মাথায় একটি লোক এক দৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এ দেখে তাঁর স্ত্রী বললেন, ‘তুমি ভিতরে যাও, দেখনা লোকটা কিভাবে তাকিয়ে আছে।’
সন্ধ্যে ছ’টা। শহীদুল্লাহ কায়সার বসে বসে খবর শুনলেন। এক সময় চাকরকে ডেকে বললেন, আমার জন্য দু’টো রুটি বানিয়ো।
শহীদুল্লাহ কায়সার প্রায়ই স্ত্রীকে বলতেন, দেখো আমাকে যে কোন সময় নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং সব সময় আমার জন্য কিছু কাগজ-কলম আর সিগারেট রেখে দেবে। আর কিছু টাকা। শহীদুল্লাহ কায়সার আর বলতেন, ‘আমি একজন সাংবাদিক। তারা আমাকে যাই করুক মারবার সাহস পাবে না।’
চাকরকে তিনি রুটি বানাবার কথা বলেছেন এমন সময় দরোজায় ধাক্কা। মিলিটারী এসেছে।
মিলিটারী এসেছে এ সংবাদ পেয়েই তিনি ইস্পাহানীকে টেলিফোন করলেন। কি কথা হয়েছে কেউ জানে না। শুধু দেখা গেল সংক্ষিপ্ত কথা শেষ হওয়ার পর তিনি চুপচাপ টেলিফোন রেখে দিচ্ছেন।
আলবদররা এদিকে দরজা ধাক্কাচ্ছে। তিনি বললেন দরজা খুলে দাও। একথা বলে উপরে বেডরুমে গেলেন; স্ত্রীকে বললেন, ‘শিগগির আমাকে কিছু টাকা দাও।’ বলে তিনি প্যান্ট পরতে লাগলেন। তাঁর স্ত্রী তখন বললেন, ‘টাকা দিতে বলে তুমি যাচ্ছো কই?’ শহীদুল্লাহ কায়সার বললেন, ‘না একটু ভালো পোশাক পরে নেই।’
স্ত্রী তাঁকে ঘরের বাইরে যেতে দেবেন না। কিন্তু তিনি যাবেনই। স্ত্রীকে বললেন, ‘আমাকে না পেলে ওরা বাসার সবাইকে মারবে।’
ইতিমধ্যে যিনি দরজা খুলে দিয়েছেন, তাকে আলবদররা সিঁড়ির কাছে বেঁধে রেখে সোজা দোতলায় উঠে তাঁর বেডরুমে ঢুকে পড়লো।
বেডরুমটা বেশ বড়। অন্য এক দরজার কাছে শহীদুল্লাহ কায়সার দাঁড়িয়ে। ঘরের মাঝামাঝি তাঁর স্ত্রী। আলবদররা ঘরে ঢুকে শহিদুল্লাহ সাহেবকে দেখতে পেলো না। তাঁর স্ত্রীকে একলা ঘরে দেখে তারা বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করলো। এমন সময় পর্দার কাছ থেকে শহীদুল্লাহ কায়সার সামনে এসে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কাকে চান?’
‘আপনার নাম কি?’ তারা পাল্টা জিজ্ঞেস করলো।
‘শহীদুল্লাহ কায়সার।’
সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত ধরলো। ‘আপনার সাথে কথা আছে।’ বলে তারা তাঁকে বারান্দায় নিয়ে এলো।
এদিকে বাসা জুড়ে হৈচৈ চীৎকার। আলবদররা তাঁকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় শহীদুল্লাহ কায়সার কঠিন কণ্ঠে বললেন, ‘আমি তো যাচ্ছিই। আপনারা আমার হাত ধরবেন না।’ এ বলে তিনি একবার পিছন ফিরে সবাইকে দেখাতে চাইলেন। কিন্তু আলবদররা তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি।
সিরাজউদ্দিন হোসেন
[ দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক জনাব সিরাজউদ্দিন হোসেনের স্ত্রী বেগম নূরজাহান সিরাজের বিবৃতির উপর ভিত্তি করে এটি লেখা হয়েছে। (ইংরেজী থেকে অনুবাদ) ]
সিরাজউদ্দিন হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা সাংবাদিক। ইত্তেফাকের ‘মঞ্চে নেপথ্যে’ কলামটি তিনিই লিখতেন।
১৯৭১ সনের ১১ই ডিসেম্বর ভোর ২-৪৫ মিনিটে পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্দেশে একদল উর্দুভাষী লোক তাঁকে তাঁর বাসা থেকে অপহরণ করে হত্যা করে। সিরাজউদ্দিন হোসেনের মৃতদেহের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
জনাব হোসেন সপরিবারে ৫ নম্বর চামেলীবাগে থাকতেন। জনৈক ডাক্তার ছিলেন এ বাসার মালিক। অন্তিম দিনে দুষ্কৃতকারীরা সেই ডাক্তারকে সঙ্গে করে তার বাসায় প্রবেশ করে। জনাব হোসেনের দ্বিতীয় ছেলে দরজা খুলে দিলে দুষ্কৃতকারীরা বন্দুক উঁচিয়ে তাকে তার বাবার ঘর দেখিয়ে দিতে বলে। ঠিক এই সময় বেগম হোসেন বেডরুমের দরজা খুলে বের হন। সিরাজউদ্দিন হোসেনের উপর তখন একজন দুষ্কৃতকারীর নজর পড়লে সে জনাব হোসেনের নাম এবং পেশা জানতে চায়। সিরাজ সাহেব জানান যে তিনি পত্রিকায় চাকরি করেন। তখন তারা তাঁকে বেডরুম থেকে বারান্দায় নিয়ে আসে। এরপর দুষ্কৃতকারীরা জনাব হোসেনের ছেলেকে একটি ন্যাপকিন আনতে বলে, পরিবারের সবাইকে ভিতরের বেডরুমে চলে যেতে নির্দেশ দেয়। তারপর সিরাজউদ্দিন হোসেনকে একটি গাড়ীতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। কোথায় কেউ জানে না।
গিয়াস উদ্দিন আহমেদ
১৪ই ডিসেম্বর, মঙ্গলবার। ঢাকা শহরে তখন চলছে একটানা কারফিউ। সকাল সাড়ে সাতটা। একটা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়ালো হলের হাউস টিউটরদের বাসার সামনে। বাস থেকে সশস্ত্র ৩/৪ জন লোক নেমে দাঁড়ালো। তারা ছিল ইউনিফর্ম পরা। তাদের দুইজন এসে প্রথমে নীচতলায় পরিসংখ্যান বিভাগের বজলুল হক সাহেবের বাসায় তল্লাশী চালায়। এরপর তারা উপর তলায় আমাদের দরজায় আঘাত করতে থাকে। আমার স্বামী (জনাব নুরুল হক সরকারী চাকুরে) দরজা খুলে দেন। একজন বন্দুক হাতে কালো মুখোশ পরা তাঁর বুকের সাথে বন্দুক লাগিয়ে জিজ্ঞেস করল, গিয়াস উদ্দিন কে ? উনি বললেন, বাসায় নেই, হলের কাজে গেছেন। লোক দুটো তখন বলে, আপনি চলুন আমাদের সাথে, তাঁকে খুঁজে বের করে দেবেন। আমরা থাকতাম আজিমপুর কলোনীতে। কলোনীতে মিলিটারী আসায় ভাই-এর বাসায় আমরা চলে আসি। আমার স্বামী তাদের বলল, আমরা এখানে নতুন এসেছি, হলের কোন কিছু জানি না। তারা বলল ভিতরে চলুন, এখানে গিয়াস উদ্দিন সাহেব থাকতেন। ভাই এর কামরায় এসে ওরা সমস্ত রুম তছনছ করে দিয়ে গেল। ঘরে আমার এক মামাতো ভাই ছিল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ওকে নিয়ে চলল-হলে ভাইকে খুঁজে দিতে। হলে গিয়ে তারা দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো, গিয়াস সাহেব কোথায়? তারা বলল, হলের পেছনে পানির পাম্প ঠিক করছেন। তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে ভাইকে ঘরে নিয়ে এল। সামনে পড়া একজন দারোয়ানের কাছ থেকে একটা গামছা ছিনিয়ে নিয়ে চোখ বেঁধে তাঁকে নিয়ে চলল। বাসে উঠার আগে মামাতো ভাইটিকে বললেন, ‘নূরুলকে বলিস টেলিফোন করতে।’ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন সাহেবের বোন।
এ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অতি পরিচিত মুখ ইতিহাস বিভাগের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এবং মহসিন হলের ছাত্রদের অত্যন্ত আপন জন হাউজ টিউটর অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন সাহেবের বদর বাহিনীর হাতে মর্মান্তিক ভাবে হত্যার পূর্বকাহিনী। এর আগেও ২৭শে রমজান তারিখে গিয়াস উদ্দিন সাহেবকে, মহসিন হলের প্রভোস্ট ওদুদুর রহমান এবং আর একজন হাউজ টিউটর জনাব জহুরুল হক সাহেবকে মিলিটারীরা এসে ধরে নিয়ে দুদিন করা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। এর কারণ যা পরে জানা গেছে হলের ইসলামী ছাত্র সংঘের ছাত্রদের যা ইচ্ছে তা করার প্রতিবাদে হল প্রশাসন নাকি তাদের সাথে সহযোগিতা করেননি। তারও আগে সেপ্টেম্বর মাসে গিয়াসউদ্দিন সাহেব যমদূত শিরোনামায় লিখিত একটি চরমপত্র পেয়েছিলেন। কিন্তু তা তিনি তখন ততোটা আমল দেননি।
-মীর শাহাবুদ্দীন মাহমুদ
দৈনিক বাংলা, ৬ই জানুয়ারি ১৯৭২।
ডঃ আবুল কালাম আজাদ
কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থানার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের ছেলে আজাদ ছাত্রজীবনে বরাবরই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে রেকর্ড ভাঙ্গা নম্বর নিয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বর্ণপদক পান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আজাদ ফ্লাইং অফিসারের পদমর্যাদা নিয়ে অধ্যাপক হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমীতে যোগ দেন।
সেখান থেকে প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়। বিমান বাহিনীতে তাঁর মেধা এবং কৃতিত্ব অবাঙ্গালীরা ভালো চোখে দেখেনি। এজন্যে তাঁর চাকুরির মেয়াদ তারা হঠাৎ শেষ করে দেয়। নিরুপায় হয়ে তিনি তখন ঢাকায় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সভাপতির কাছে চাকুরীর সন্ধান চেয়ে চিঠি লেখেন। চিঠির উত্তরে তিনি সাক্ষাৎকারের সুযোগ পান এবং পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারী মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
একসময় তিনি জগন্নাথ মহাবিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন। সেখান থেকে তিনি গণিত শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ হিসেবে উন্নয়ন বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা শিক্ষন কেন্দ্রে (আই, এ, এস, টি, টি) যান। সেখানে তিনি বৎসর খানেক ছিলেন। অধ্যাপনা জীবনে আজাদ বৃত্তি নিয়ে আর একবার যুক্তরাজ্যে যান। এবার তিনি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী, মেঘবিজ্ঞানে ডক্টরেট এবং তরল পদার্থ সম্পর্কিত বলবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা নেন।
এছাড়া গণিতশাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের জন্যে তিনি লন্ডনের রাজকীয় আবহাওয়া বিজ্ঞান সমিতি, যুক্তরাজ্যের ফলিত গণিত সমিতি এবং বোস্টনের আবহাওয়া বিজ্ঞান সমিতির ফেলো নির্বাচিত হন। ম্যানচেস্টারে তিনি কিছু দিন সার্বক্ষণিক অধ্যাপক ছিলেন। সার্বক্ষণিক এবং স্থায়ী অধ্যাপকের পদও তাঁকে দেয়া হয়। কিন্তু মা, ভাইবোনদের কথা ভেবে তিনি ফিরে আসেন।
অস্বাভাবিক পরিস্থিতির দরুন যুদ্ধের আগে কয়েকদিন আজাদের সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারিনি। হঠাৎ তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর পেলাম ১৭ই ডিসেম্বর। আমি সেদিন পাড়ার মুক্তি যোদ্ধাদের সম্বর্ধনার আয়োজনে ব্যস্ত।
কাজের চাপে সেদিন আজাদের বাসায় যেতে পারিনি, শুধু মুক্তিবাহিনীর কাছে আজাদের সন্ধানের জন্য অনুরোধ জানিয়েছি। পরদিন তার বাসায় যাওয়ার উপক্রম করছি, তখনই এলো সেই শেষ খবর। আজাদ ফিরেছেন। কিন্তু নিষ্প্রাণ, ক্ষতবিক্ষত দেহে, রায়েরবাজারের বধ্যভূমি থেকে। খবরটি শোনামাত্র আমার স্ত্রী কাঁদতে শুরু করেছিলেন।
তাঁকে নিয়ে কোনক্রমে আজিমপুরের দায়রা শরীফের দিকে ছুটছিলাম। আজাদের বাসা দরগার ভেতরে। সেই দরগার মর্যাদাহানি করে বদর বাহিনীর পাঁচটি খুনী ১৫ই ডিসেম্বর সকালে তাদের বাসায় ঢুকে পড়ে। প্রথমে তারা আজাদের সামনে রিভলবার ধরে তাঁকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে অকারণ তল্লাসী চালায়।
তারপর নিরপরাধ আজাদকে বাসি মুখে ধরে নিয়ে যায়। ছোট বোনটি তখন তাদের পায়ে ধরেছিল। মা, বার বার তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, বাবা তোমরা বাঙ্গালী, তোমরাও আমার ছেলে, ওকে তোমরা ছেড়ে দাও। কিন্তু কেউ তাঁর কথা শোনেনি, নরপশুরা এই নারীকে প্রতিবারই প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে।
সেদিন তিন ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন উঠে যায়। তখন আজাদের ছোট ভাই ‘ইভনিং পোস্ট’ –এর সম্পাদক হাবিবুল বাশার, বড় ভগ্নিপতি ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সির মালিক গোলাম রসুল আজাদের সন্ধান নেওয়ার জন্যে নানাভাবে চেষ্টা করেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে পাওয়া গেল ১৭ই ডিসেম্বর বিকেলে, ডঃ রাব্বি সহ আরো কয়েকজন জ্ঞানীগুণীর লাশের পাশে।
-আতোয়ার রহমান
দৈনিক বাংলা, ৭ই জানুয়ারী, ১৯৭২
আ, ন, ম, গোলাম মোস্তাফা
আ, ন, ম, গোলাম মোস্তাফাকে আলবদরের জল্লাদরা ১১ই ডিসেম্বর সকাল ন’টায় তাঁর গোপীবাগের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। বদর বাহিনীর তিনজন জল্লাদ বাসায় এসছিল। বলেছিল, আপনার সাথে কিছু কথা আছে, বাইরে আসুন।
মোস্তাফা তখন তাঁর নয় মাসের শিশুসন্তান অভীকে কোলে নিয়ে পায়চারী করছিলেন। বাচ্চাকে নামিয়ে রেখে তিনি ঐ জল্লাদদের সাথে বেরিয়ে যান।
বেরিয়ে যাবার পরমুহূর্ত থেকে ওর খোঁজখবর শুরু হয়। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই তাঁর খোঁজে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু আকস্মিকভাবে কারফিউ জারী করায় সেদিনের মত অনুসন্ধান কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এবং একটানা কারফিউ চলতে থাকায় এই অনুসন্ধান কাজ আর শুরু করা যায়নি। ইতিমধ্যে জামাতে ইসলামীর সদস্য বলে পরিচিত পূর্বদেশের স্টাফ রিপোর্টার চৌধুরী মঈনুদ্দীনের শরণাপন্ন হয়েছিল অনুসন্ধানকারীরা। হায় তখনও কে জানতো এই চৌধুরী মঈনউদ্দীনই ছিল আলবদর বাহিনীর অপারেশনাল ইনচার্জ।
মোস্তাফার খোঁজে বেরিয়েই জানা গেলো বদর জল্লাদদের আগ্রাসী ক্ষুধার কথা। জানা গেল এই দিনই ভোরে ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক জনাব সিরাজউদ্দীন হোসেনের গ্রেফতারের কথা। আরো অনেকের বাড়ীতে তাদের হানা দেবার কথা।
তাঁর ভাইয়েরা, আত্মীয়স্বজনেরা, বন্ধুবান্ধবেরা, রায়ের বাজারের বিলের বধ্যভূমিতে পাগলের মতো খুঁজে ফিরেছে তাঁর লাশ। কিন্তু না, কোন সন্ধান তাঁর মেলেনি।
-মনজুর আহমদ
দৈনিক বাংলা, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১
ডাক্তার মোহাম্মদ মোর্তজা
তাঁর সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল একাত্তরের মার্চ মাসের সম্ভবতঃ বাইশ তারিখে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে, উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে, কাগজ পড়ছিলেন; টুকরো টুকরো কিছু আলাপঃ অসহযোগ আন্দোলনের সম্ভাবনা, পরিণাম ইত্যাদি। তারপর ২৭শে মার্চ কারফিউ বিরতির সময় মোটরসাইকেলে তাঁকে ছুটে যেতে দেখেছিলাম। আমি ছিলাম সপরিবারের সশঙ্ক, আশ্রয়সন্ধানী। কথা হয়নি, পরে আর দেখাও হয়নি।
স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফিরে জানলাম, যে সমস্ত প্রিয় পরিচিত ঘনিষ্ঠ মুখ চিরতরে হারিয়ে গেছে, তিনি আছেন তাঁদের মধ্যে।
কেননা মোহাম্মদ মোর্তজা শুধু ডাক্তার ছিলেন না, ছিলেন সমাজ সচেতন, রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি, ছিলেন লেখক।
মোহাম্মদ মোর্তজা চব্বিশ পরগনার বাদুরিয়া থানার চণ্ডীপুর গ্রামে ১৯৩১ সালের ১লা এপ্রিল জন্মগ্রহন করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন কলকাতা বালিগঞ্জ সরকারী হাই স্কুল থেকে। তারপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে আই,এস,সি পাশ করে ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম,বি,বি,এস ডিগ্রী লাভ করেন। ডাঃ মোহাম্মদ মোর্তজা ১৯৫৫ সালের ১৯শে নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী মেডিক্যাল অফিসার পদে যোগদান করেন এবং নিহত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ঐ পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন।
শুনেছি, ডাঃ মোর্তজা কিছুকাল যাবৎ ঘনিষ্ঠভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তার কিছুটা পরিচয় মেলে ‘কপোত’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত তাঁর রাজনীতির পরিচয় প্রবন্ধে। এছাড়া অধুনালুপ্ত ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় তিনি বেনামে প্রবন্ধ লিখতেন বলে শুনেছি। তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেনঃ সমাজতন্ত্র নামে একটা বই লিখবেন। সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি।
স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর সকাল ৮-৩০ মিনিটে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় বাসভবন থেকে আলবদর বাহিনীর লোকেরা তাঁকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। অন্যান্য শহীদ বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে মিরপুর মাজারের কাছে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায় ৪ঠা জানুয়ারী, ১৯৭২ তারিখে। ৫ই জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে তাঁর মরদেহ দাফন করা হয়।
-ডঃ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৩
ডঃ ফয়জুল মহী
পাক হানাদার বাহিনী ও বদর বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেছেন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডঃ ফয়জুল মহী।
আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁর সেবার ও পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন যখন দেশের সবচেয়ে বেশী- তখনই আমরা তাঁকে হারালাম। পাক হানাদার সেনারা নিশ্চিত পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে স্থানীয় নরপশুদের সাহায্যে আরো অসংখ্য বুদ্ধিজীবীর মত ডঃ ফয়জুল মহী সাহেবকে হত্যা করে স্বাধীনতা লাভের দুই দিন পূর্বে।
১৯৬৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এম,এ পাশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার কলোরেডো স্টেট কলেজে অধ্যয়ন করার জন্য একটি বৃত্তি লাভ করেন। সাফল্যের সাথে ১৯৬৭ ও ৬৮ সনে সেখান থেকে যথাক্রমে এম,এ ও ডক্টর অব এডুকেশন ডিগ্রী লাভ করেন এবং দেশে ফিরে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্থ আই,ই, আর-এ ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টস বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন।
তিনি ন্যাশনাল এডুকেশন এসোসিয়েশন, আমারিকান ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টস এসোসিয়েশন, আমেরিকান ভোকেশনাল এসোসিয়েশন এবং আমেরিকান এসোসিয়েশন ফর হায়ার এডুকেশন এই চারটি সংস্থার প্রফেশনাল মেম্বার ছিলেন।
সেদিন ছিল ১৪ই ডিসেম্বর। বদর বাহিনীর ৬টি খুনী সকাল ৮-৩০ মিনিটে ৩৫/জি বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে আসে এবং মহী সাহেবকে ডাকে। ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘরের দরজা খুলে বের হন এবং অতি বিনয়ের সাথে বলেন আপনারা বসুন। বসতে তারা রাজী না হয়ে তাঁকে সাথে করে নিয়ে যায় এক অজানা জায়গায় চোখ বাঁধা অবস্থায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দেখবার সাধ ছিল ডঃ মহীর। মুক্তি সংগ্রামে তিনি নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন, কিন্তু স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। পেয়েছেন কেবল স্বাধীন বাংলার স্বাধীন মাটি। আজ স্বাধীন বাংলার মাটিকে জড়িয়ে ধরেই তিনি চিরকালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে ঘুমিয়ে আছেন।
-মোঃ আমিনুল ইসলাম
দৈনিক পূর্বদেশ, ৬ই ফেব্রুয়ারী,১৯৭২
এ, কে, এম, সিদ্দিক
যে সব বুদ্ধিজীবী একাত্তরের ডিসেম্বরে শহীদ ও নিখোঁজ হয়েছেন জনাব এ, কে, এম, সিদ্দিক (হেনা মিয়া) তাঁদের অন্যতম। তিনি ছিলেন ঢাকার হাইকোর্ট ও জজকোর্টের একজন বিশিষ্ট আইনবিদ এবং প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ জনাব আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি ছিলেন সত্য ও ন্যায়নীতির প্রতীক।
১৯৭১ সালের ২রা এপ্রিল কতিপয় অবাঙ্গালী তাঁর ওয়ারীস্থ বাসভবনের সামনে একজন বাঙ্গালী যুবককে ধারালো অস্ত্র দ্বারা হত্যার আয়োজন করলে জনাব সিদ্দিক তার প্রতিবাদ জানান এবং যুবকটিকে সেদিন অনিবার্য মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। এতে করে পাকবাহিনীর সহযোগিতায় সেই দালালেরা কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর বাসভবন ঘেরাও করে ৭০/৮০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। পরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে লুটতরাজ করে এবং বাড়ির ছোট থেকে শুরু করে সকলকে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড় করায়। ভাগ্যক্রমে সে যাত্রা জনাব সিদ্দিক এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা রক্ষা পান।
এ ঘটনার পর থেকেই তাঁকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন। কিন্তু উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সমস্ত বাঙ্গালী যেখানে দুর্ভাগ্যের কবলে পতিত সেখানে আমি বৃথা আত্মরক্ষার চেষ্টা করবো কিভাবে?’
আত্মরক্ষা তিনি করেননি। নিয়তি তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। আমরা সবাই যখন জল্লাদবাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম ঠিক এমনি সময়ে, ১৪ই ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় তাঁর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো আলবদরের একটি মাইক্রোবাস। যাবার সময় তিনি বললেন, ‘এপ্রিলের দুই তারিখে যখন ফিরে এসেছি ইনশাআল্লাহ্ এবারও ফিরে আসবো।’ জনাব সিদ্দিকের পরিবারবর্গ ও আত্মীয়স্বজন এখনো তাঁর ফিরে আসার পথের দিকে অধীর আগ্রহে চেয়ে আছেন।
সদালাপী, মিষ্টিভাষী ও পরোপকারী জনাব সিদ্দিকের বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৬ বৎসর। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জে।
-নার্গিস মজিদ
শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৩