দীপংকর ঘোষ দ্বীপ
<৬,১২৮,২১২-২১৩>
শিরোনামঃ আমাদের সাধীনতা সংগ্রাম
সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১০ম সংখ্যা
তারিখঃ ২৪ অক্টোবর, ১৯৭১
আমাদের সাধীনতা সংগ্রাম
রক্তের একটা নদী পেরিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে- এ সত্য আজ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে দিবালোকের মত সুস্পষ্ট হয়ে গেছে । কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও হানাদারমুক্ত হতে পারেনি আজও । সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বর সৈন্যরা রাহুগ্রাসের মত বাংলাদেশ আঁকড়ে আছে ।
এই পশ্চিমা নাগপাশ থেকে জননী জন্মভূমিকে মুক্ত করতে হবে সর্বাগ্রে চাই একতা । মুক্তিযোদ্ধারা যেমন আজ বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে একতাবদ্ধ হতে পেরেছে তেমনি জনগণকেও একতাবদ্ধ হতে হবে । প্রতি মুহূর্তে স্মরণ রাখতে হবে একটা দেশের মুক্ত আন্দোলন তখনই সার্থক হয় যখন সে দেশের জনগণ সমস্ত সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পারে । তার চেয়েও বড় কথা, আমরা একটা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছি । যে দেশের সৈন্যরা আমাদের ঘর পুড়িয়েছে, মা-বোনের ইজ্জত ছিনিয়েছে, বাবা-ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে । এক কথায় বলতে গেলে সোনার বাংলাকে ওরা শ্মশান করেছে । কাজেই সে কথা মনে রেখেই স্বাধীনতা আন্দোলনে সবাইকে অংশগ্রহণ করতে হবে । স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জাতীয় কর্তব্য ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আজ যে সমস্যা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হল রাজনৈতিক মতানৈক্য । অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে । এতে আন্দোলন বিঘ্নিতই হবে । আজকে জাতির যুগসন্ধিক্ষণে দেশমাতৃকার মুক্তিই প্রতিটি দলের সমর্থকদের মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত । রাজনৈতিক মতামতের সময় অনেক পাওয়া যাবে কিন্তু আজকের এই পরম মুহূর্তকে যদি কোন্দলের দ্বারা অবহেলা করা হয় তাহলে আগামী দিনের বংশদররা কিছুতেই আমাদের ক্ষমা করবে না ।
কে কতটুকু ক্ষমতা আকড়ে আছে এই সংকীর্ণতার বেড়াজাল ভেঙ্গে জাতির দুর্দিনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এক কাতারে । মানুষের চেয়ে মানুষের কর্ম বড় । তাই ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয় । ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করলে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয় জাতির অঙ্গন থেকে ডাস্টবিনে, তা এই পৃথিবীর শুরু থেকে হয়ে আসছে ।
জনতাই দেশের মালিক । দেশ স্বাধীন হলে কোন দল কিংবা কোন ব্যক্তি দেশের প্রকৃত বন্ধু তার বিচার করবে দেশের জনতা, তাই আমাদের উচিত জনতার সামনে সেই দিনটি উপস্থিত করা । সেই শুভদিনটির জন্য দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে কিংবা মুক্তিযোদ্ধা হতে প্রতিটি দলের প্রতিটি সমর্থককে এগিয়ে আসতে হবে । এ সংগ্রামে যদি আমরা উত্তীর্ণ হতে পারি তবে বিশ্বে বাংলাদেশেকে নিয়ে সমস্ত ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে অচিরেই বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করা যাবে ।
বাংলাদেশের অনেক হিন্দু যুবকের মুখে শোনা যায়, “আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার হয়েছে সবচেয়ে বেশী অতএব আমরা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেব কেন?” অত্যাচার হয়েছে একথা সত্য । কিন্তু এমন ধারণা পোষণ করে এখানে যারা মুক্তিসংগ্রাম থেকে দূরে সরে আছে তাদের উদ্দেশ্যে আমরা একথাই বলব যে তারা ভুল ধারণা পোষণ করে এখনো তুচ্ছ সংকীর্ণতার আবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে । পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর স্বার্থবাদী শাসক চক্র হিন্দুদেরকে সংখালঘু বলে চিরদিন দাবিয়ে রেখেছে । ক্ষমতার রাজনীতিতে পাক স্বার্থবাদী গোষ্ঠী বার বার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে । অথচ তাঁর প্রথম থেকেই যদি শাসক চক্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন তাহলে হয়তো স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর চক্রান্ত তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে গুড়িয়ে যেত । আজো তেমনি ভুলের বশবর্তী হয়ে কিছু সংখ্যক যুবক নিরপেক্ষকের ভূমিকা অবলম্বন করেছে, এ সত্যি দুঃখজনক ঘটনা ।
বাংলাদেশে যখনি ন্যায়ের দাবিতে জনতার কন্ঠে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তখনি স্বার্থবাদী শাসক সম্প্রদায় ভারতের সঙ্গে বিরোধ নয় তো ধর্মের নামে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে জনতার কন্ঠকে স্তব্ধ করেছে । এর জন্য বার বার বলি হয়েছে নিরীহ মানুষ । বার বার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাংলার মাটি । কিন্তু স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর মুখোশ খুলে গেছে এবার । তাই বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ লক্ষ লক্ষ শহীদের বেদীমূলে দাঁড়িয়ে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা বিসর্জন দিতে সক্ষম হয়েছে । পাক সাম্প্রদায়িক সরকারের সর্ব প্রকারের উস্কানি ব্যর্থ করে দিয়েছে বাংলার সংগ্রামী জনতা ।
বাংলার মানুষ আজ বাঙ্গালী । হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান নয়, তারা বাংলার মানুষ । জাতি ধর্মের উপরে যে মানব ধর্ম সেই মহান ধর্মে উদ্ধুদ্ধ আজ বাঙ্গালী জাতি । লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে সে দেশ শুধু মুসলমানের নয় । হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সবার দেশ বাংলাদেশ ।
তাই আসুন আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশমাতৃকার শৃঙ্খল ছিন্ন করে হানাদার শেষ করে পূত পবিত্র করে গড়ে তুলি জননী জন্মভূমী বাংলাদেশকে ।