১৫। ১৯ মে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্ব শক্তিবর্গের নিষ্ক্রিয়তা
শিরনামঃ বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্ব-শক্তিবর্গের নিস্ক্রিয়তা; সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা ১ম বর্ষ ২য় সংখ্যা; তারিখঃ ১৯ মে, ১৯৭১
মানবতার ক্রন্দনরোলে কাঁপছে আল্লাহ্র আরশ কিন্তু কুম্ভকর্ণদের ঘুম ভাঙবে কবে?
থোক থোক রক্তের উপর প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এই শিশু ও নবগঠিত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য, নির্মূল করার জন্য নরঘাতক জঙ্গি ইয়াহিয়া লেলিয়ে দিয়েছে তার হয়নাদের সবুজ বাংলার শ্যামল প্রান্তরে। চলছে নির্বিচারে গণহত্যা, শিশু, নারী, বৃদ্ধ, যুবক-যুবতী কোন ভেদাভেদ নেই। অবলীলায় ধ্বংস করেছে সভ্যতার পীঠস্থান শিক্ষাঙ্গনকে, মাড়িয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে মসজিদ-মন্দির জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ, শিল্প-কারখানা, বিপণীকেন্দ্র আর এই বর্বর নাৎসি হামলার মর্মান্তিক ঘটনাকে চাপা দেওয়ার জন্য বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকদের করেছে নিধন, ভস্ম করে দিয়েছে স্বাধীন সংবাদপত্র অফিসগুলো।
সাড়া বাংলাদেশ আজ রণক্ষেত্র। বাংলার মাঠে জ্বলছে আগুন বাতাসে তার রুঢ়তা, আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। আর চারদিকে ভীত, বিহ্বল ও আতঙ্কগ্রস্ত অসহায় মানুষের চিৎকারে বাংলাদেশ হয়ে পড়েছে প্রেতপুরী। মানবতার এহেন অবমাননায় আল্লাহর আরশ হয়তো থর-থর করে কাঁপছে কিন্তু বিশ্বমানবতার এবং শান্তির সোল এজেন্ট জাতিসংঘের বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের ঘুম ভাংছে না, বিবেক দংশিত হচ্ছে না।
উথানট সাহেব কি জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের কথা ভুলে গিয়েছেন ? না শুধু বৃহৎ শক্তিবর্গের স্বার্থ জড়িত না থাকলে তাঁর কণ্ঠে শান্তির ললিতবাণী বেরোতে বাধে ? শুধু বিনয়ের সাথে উথানট সাহেবের জানাতে চাই বাংলাদেশে যে মানবনিধন যজ্ঞ চলছে তা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। এ যুদ্ধ একটি স্বাধীন জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষার যুদ্ধ- তাই সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করুন, সিদ্ধান্ত নিন। যাতে জাতিসঙ্ঘের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে না ফেলে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি আমেরিকা আজ নীরব। নীরব নিক্সনের কণ্ঠ। কিন্তু কেন? তিনিও কি ভাবেন এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয়, তাই নাক গলানোর প্রয়োজন নেই? কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় নাক গলাতে তো তারা কোন পাত্রাপাত্র, স্থান, কাল বিচার করে না- তবে এখানে কেন এত চিন্তা এত ভাবনা। ফুলব্রাইট এবং এডওয়ার্ড কেনেডির মত প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ যখন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের দাবী জানিয়েছেন, তখনও নিক্সন কোন কোন ব্যবস্থা করেছে না? আমেরিকা পত্র পত্রিকাও মানবতার এই ক্রন্দন বেদনায় ভারাক্রান্ত, বিহ্বল।
কিন্তু নিক্সন সাহেব কি বাংলাদেশে সঙ্ঘটিত গণহত্যার ব্যাপারে নিজের এবং তাঁর সরকারের দায়িত্ব এড়াতে পারেন? তাঁর জানা উচিত বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে তাতে তিনি মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারেন না। নিক্সন সরকারের পক্ষ থেকে বলা যেতে পারে যে, ইয়াহিয়া জঙংগচক্র কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য প্রদত্ত মার্কিন অস্ত্র-শস্ত্র তাদের অনুমতি ব্যতিরেই বাংলাদেশে নরমেধযজ্ঞে ব্যবহার করেছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও কি তাদের কিছু করনীয় ছিল না বা নেই ? তাঁরা কি চুক্তিভঙ্গের অজুহাতে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ পারতেন না ? আসল কথা হলো ক্ষমতাসীন মার্কিন সরকারের গণতন্ত্র ফাঁকি। দেশে দেশে একনায়কত্ববাদীদের ফাকি। দেশে দেশে একনায়কত্ববাদীদের পোষণের যে নীতি মার্কিন সরকার অনুসরণ করে আসছে পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কেন না, মার্কিন সরকারের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য না পেলে পাকিস্থানের সামরিক চক্র বাংলাদেশে একদিনও যুদ্ধ চালাতে পারে তা আমাদের বিশ্বাস হয় না। মার্কিন সরকারের জেনে রাখা উচিত বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনেই আজ মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এ যুদ্ধে তাদের জয়লাভ করতেই হবে। জয় তাদের অবশ্যম্ভাবী। মাঝখানে মার্কিন সরকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষ অবলম্বন না করে চিরকালের জন্য তাদের বন্ধুত্ব হারালেন- এই আমাদের দুঃখ।
ব্রিটেনও একই পথের পথিক। ব্রিটেন বিশ্ববাসীকে শিক্ষা দিলো মানবিক মূল্যে কথা। আজও কমনওয়েলথের অন্যতম সদস্য। ব্রিটেনের কাছ থেকে সে পাচ্ছে নানারকম সাহায্য ও সহযোগিতা। সুতরাং ব্রিটেন সরকার ইচ্ছে করলে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারতো কিন্তু তারা তা করেনি। কারণ পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকচক্রের সাথে রক্ষণশীল ব্রিটিশ সরকারের বাণিজ্যিক ও অন্যবিধ সম্পর্ক জড়িত। ব্রিটিশ শ্রমিক দলের পীড়াপীড়ি স্বত্বেও প্রধানমন্ত্রী হীথ পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে পাকিস্তানে ব্রিটিশ সাহায্য অব্যাহত থাকবে।
পশ্চিমা শক্তিবর্গ ভাবছেন এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং বাংলাদেশ বিছিন্নবাদী। ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও টিক্কা চক্রের বক্তব্যও এই। ভাবখানা এই- বায়াফ্রা, নাগা ও মিজোদের মত বাংলাদেশেও একই পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু যুক্তির ধোপে তা কি টিকে ? একটু আলোচনা করে দেখা যাক। বায়াফ্রা নাইজেরিয়ার একটি ক্ষুদে অংশ-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধনের দিক থেকে নাইজেরিয়ার অন্য এলাকার সাথে কোন পার্থক্য নেই। নাগা ও মিজ্যোল্যান্ড- ভারতের বিরাট অংশের দুইটি ক্ষুদ্র এলাকা। তাদের দাবীর সংগে বাংলাদেশের বক্তব্যকে এক করে দেখার অর্থ – জেগে ঘুমানোর মত। কারণ, পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ছাপ্পান্ন জনের বাস বাংলাদেশে। ভৌগো্লিক দিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের দূরত্ব বারোশত মাইল। মধ্যবর্তী স্থানে ভারত অবস্থিত। ভাষা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক বন্ধন এবং আচার অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। এবং তথাকথিত পাকিস্তান সংহতির নামে বিগত তেইশ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাংলাদেশেকে শোষণ করেছে, গণতন্ত্রের গলা টিপে হত্যা করে রাজনৈতিক অধিকারটুকুও ছিনিয়ে নিয়েছে। ৫৪ হাজার বর্গমাইল ভূমিকে তারা তাদের বাজারে পরিণত করে। অতএব অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও মানবিক মূল্যায়নের এই সংগ্রামকে বিছিন্নবাদী আন্দোলন বলে অভিহিত করা যায় না।……
বাংলাদেশ যখন ইয়াহিয়ার হয়নাদের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত তখন রেডক্রস এগিয়ে এসেছিলো আর্তের সেবায়, কিন্তু সামরিক জান্তা যেহেতু বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেননি সেহেতু তারা মানবতার সেবা করতে নিরস্ত রয়েছেন।তা নিরস্ত রয়েছেন বলে জঙ্গীচক্রের মানব নিধনযজ্ঞ বন্ধ হয়নি, বন্ধ হয়নি মানবতার ক্রন্দন। প্রশ্ন রয়ে যায় রেডক্রসের দায়িত্ব কি শেষ হয়ে গিয়েছে ? বিশ্ব জনমতের কাছে তারা এই নগ্নতার বর্বরতা বীভৎস করুণ চিত্র তুলে ধরে বৃহৎ শক্তিবর্গের উপর আশু চাপ সৃষ্টির দাবী করতে পারেন না ? আমরা আশা করবো, তারা আর মুখ ফিরিয়ে থাকবে না। আমরা এতদিনে শুনে এসেছি চীন এশিয়ার গৌরব, নির্যাতিত নিপীড়িত সংগ্রামী জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। বিশ্ববাসী জানতো, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষও জানতো বিশ্বের যেখানেই শোষণ, বঞ্চনা আর অত্যাচার সেখানেই আছে মহাচীনের শীতল স্পর্শ। সেখানেই মহাচীন নিপীড়িত মানুষের দুঃখ মোচনের চেষ্টায় সচেষ্ট। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার দখলদার বাহিনীর বর্বরোচিত আক্রমণে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর জীবন যখন আজ বিপন্ন, অর্থনৈতিক জীবন যখন বিপর্যস্ত, তখন চীন আক্রমণকারী হানাদারদের পক্ষ অবলম্বন করেছে এটা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়।
বলা যেতে পারে যে চীনের রাষ্ট্রনায়কগণ বাংলাদেশের গণমানসের সত্যিকার পরিচয় না জেনেই জঙ্গী শাসকের সমর্থন যোগাচ্ছেন। কিন্তু তাও বা আমরা কিভাবে বিশ্বাস করবো ? কারণ চীন বিশ্বের নাড়ী- নক্ষত্রের খবর রাখেন তারা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর মুক্তি-সংগ্রামের প্রকৃতি ও পরিচয় জানবেন না তা কোনমতেই বিশ্বাস করা যায় না।
অবাক বিস্ময়ে তাকাতে হয় আরব জাহানের দিকে। ইসলামের শিক্ষা যেখানে অন্যায়, যেখানে জালিমের জুলুম তাকেই প্রতিহত করতে হবে, যেকোনো মূল্যের বিনিময়ে মজলুমকে দিতে হবে ছায়া কিন্তু তারতো কোন নমুনা বিশ্ববাসী দেখছেন না। আরব জাহানের মানবতা ও বিবেক জাগ্রত হোক, ইসলামের মূলমন্ত্র সাম্য স্বাধীনতা সৌভ্রাতৃত্বের পরশে স্নাত হোক বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ এই কথাই বিশ্ববাসীর চোখে-মুখে বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
আরব জাহানের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা উচিত যে, কেবলমাত্র ধর্মীয় বন্ধনের জোরেই বিভিন্ন মানবগোষ্ঠী এক রাষ্ট্রে বসবাস করতে পারে না। যদি তাই হতো, তাহলে একই ভাষা। একই ভূগোল একই ধর্ম ও একই সংস্কৃতির অধিকারী আরব জনগণ আজ এতগুলো রাষ্ট্রে বিভক্ত কেন ?
মানবতার এই অবমাননা ও বৃহৎ শক্তিবর্গের এই ন্যক্কারজনক পলায়নী মনোভাবের মধ্যেও সাড়ে সাত কোটির নিরস্ত্র নিরন্ন মানুষের যন্ত্রণা চিৎকারে সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করে যারা নজির স্থাপন করেছে, তাঁরা হলেন বুদ্ধ, গান্ধী, নেহেরু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মানব প্রেমিকতার আশীষে পুষ্ট মহামানবের মিলন ক্ষেত্র ভারতবর্ষ আর মহামতি লেলিনের আদর্শে পরিচালিত সোভিয়েত রাশিয়া। বিশ্ব-মানব-প্রেমিকরা এ দুইটি রাষ্ট্রকে জানাচ্ছে প্রীতিসিক্ত সালাম।