রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৬৫,২৭৮-২৮০>
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী
তারিখঃ ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
১
আমরা কৃতজ্ঞ
আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা গভীর কৃতজ্ঞ মহান জনগণ এবং মহান নেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। যেভাবে সামরিক ও বৈষয়িক সাহায্য দিয়ে, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়া ভারত অকৃত্রিম আন্তরিকতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারামুক্তি এবং জননী বাংলার শৃঙ্খল মোচনের এই জীবনপণ যুদ্ধে বাঙ্গালী জাতির পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে উহার তুলনা নেই। শেখ মুজিবের বাংলাদেশ ইন্দিরার ভারতের কাছে চিরকাল সুগভীর কৃতজ্ঞতার ঋণের বন্ধনে আবদ্ধ থাকিবে। আমরা কৃতজ্ঞ সোভিয়েট ইউনিয়নের জনগণ ও সরকারের কাছে। যেভাবে রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়োগ করিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত বানচাল করিয়া দিয়াছে, আমাদের সমর্থনে আগাইয়া আসিয়াছে উহা চিরদিন স্মরণ থাকিবে।
আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই ভারতের সেই সব মহান বন্ধুদের যাঁরা নেপথ্যে থাকিয়া আমাদের এই সংগ্রামে অংশ নিয়াছেন।
স্মরণ থাকিবে পোল্যাণ্ডের প্রশংসনীয় ভূমিকা। আর সেই সঙ্গে আমাদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হইয়া থাকিবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনসহ বাংলাদেশ বিরোধী রাষ্ট্রসমূহ। তাদের এই মানবতাবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার বিচারের ভার আমরা ইতিহাসের উপরই ছাড়িয়া দিতেছি।
২
আর কোন পথ নেই
অবশেষে সেই ভয়াবহ আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হইয়াছে। সমগ্র বিশ্বের বিবেকবান মানুষের শান্তির লালিত বাণীকে নিদারুণ হটকারিতায় ব্যর্থ পরিহাসে পর্যবসিত করিয়া ইসলামাবাদের জঙ্গীশাসক চক্রের কূলচূড়ামনি জল্লাদ ইয়াহিয়া ভারতের উপর যুদ্ধ চাপাইয়া দিয়াছে। বাংলার মাটিতে বীর মুক্তি যোদ্ধাদের হাতে নাস্তানাবুদ জল্লাদবাহিনী এবার পরাজয়ের সুতীব্র গ্লানির জ্বালায় দিশেহারা হইয়া হিংস্র ছোবল হানিয়াছে ভারতের মাটিতে। আর স্বাভাবিকভাবেই শত্রুর মোকাবিলায় প্রচণ্ড শক্তিতে রুখিয়া দাঁড়াইয়াছে ভারত- আক্রমণের জবাবে সজোরে পাল্টা আঘাত হানিয়া চলিয়াছে। রণদামামা বাজিয়া উঠিয়াছে- শুরু হইয়াছে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। যে যুদ্ধ ছিল এতদিন বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ আজ সেই যুদ্ধেই ইয়াহিয়া খান জড়াইয়াছে ভারতকে। শনিবার সকালে পশ্চিম পাকিস্তানি জঙ্গীশাহী ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আর আশ্চর্য! ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে রণদামামা বাজিয়া উঠিতে না উঠিতেই ভিয়েতনামে গণহত্যাযজ্ঞের নায়ক মানবতার জঘণ্যতম দুশমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন চক্র এই উপমহাদেশে ‘শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কায়, বিশ্বশান্তির স্লীলতাহানির দুশ্চিন্তায়’ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকিয়া ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বিরতি এবং সেনা প্রত্যাহারের জন্য মরিয়া হইয়া ওঠে। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসিতেও বিলম্ব হয় নাই। তবে সূখের বিষয় বাংলাদেশ এবং ভারতের মহান বন্ধু রাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ার ভেটো প্রয়োগের ফলে বাংলাদেশ, ভারত বনাম পাকিস্তানের এই যুদ্ধকে আন্তর্জাতিকীকরণের মার্কিনী দূরভিসন্ধির প্রথম প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে ভারতের উপর জঙ্গীশাহীর হামলা এবং নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানের মার্কিনী প্রয়াসের মধ্যে একটি নিবিড় ঐক্যসূত্র রহিয়াছে। যোগ সূত্র রহিয়াছে প্রায় একই সঙ্গে পিণ্ডি ও পিকিং হইতে ভারতকে আক্রমণকারী আখ্যাদানের মধ্যে। আজ এই উপমহাদেশে কিছু ঘটিতে না ঘটিতেই একই সঙ্গে পিকিং-ওয়াশিংটনে মরণার্তি ধ্বনিত হয়, বৈঠক বসে নিরাপত্তা পরিষদের। কারণ, বিশ্বশান্তি বিপন্নের ধুয়া। কারণ, বিশ্বশান্তি রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব জাতিসংঘের।
কিন্তু কন্ঠ যদি আকাশ স্পর্শ করিতে পারিত, আজ চিৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিতাম, মানবাধিকার লঙ্ঘন আর গণহত্যা প্রতিরোধও কি জাতিসংঘের সুমহান প্রতিশ্রুতির অন্তর্ভুক্ত নয়? বিশ্বের মানুষ জানে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়বৃত্তি করার জন্য বা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আড্ডাখানা হিসাবে জাতিসংঘের জন্ম হয় নাই। জাতিসংঘের জন্ম হইয়াছিল মানবাধিকার ও বিশ্বশান্তি রক্ষা-গণহত্যা রোধ আর মানবজাতির কল্যাণ প্রচেষ্টার সুমহান প্রতিশ্রুতিতে। কিন্তু যেদিন মানবইতিহাসের ঘৃণ্যতম জল্লাদ ইয়াহিয়ার লেলাইয়া দেওয়া ভাড়াটিয়া ডালকুত্তা বাহিনী- দশ লক্ষ বাঙ্গালীকে হত্যা করিয়াছে, বাংলার শ্যামল মাটিতে রক্তের গঙ্গা বহাইয়াছে, নির্বিচারে মা-বোনের ইজ্জত লুটিয়াছে, ঘর-বাড়ী জনপদ জ্বালাইয়া পোড়াইয়া ছাই করিয়াছে, লক্ষ লক্ষ নর-নারী শিশুকে গৃহহারা সর্বহারা দেশান্তরী করিয়াছে আর- কারান্তরালে নিক্ষেপ করিয়াছে স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সেদিন জাতিসংঘ টুঁ শব্দটি করে নাই কেন? কেন সেদিন আজিকার এই যুদ্ধের উৎস জল্লাদী বর্বরতার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারিত হয় নাই নিরাপত্তা পরিষদ বা খুনী নিক্সনের কন্ঠে? আজো জল্লাদ ইয়াহিয়া তারই ভাষায় ‘পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী’ বাংলার মুকুটহীন সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনের মঞ্চ সাজাইয়া তাহার জীবন লইয়া তস্কর সুলভ রাজনৈতিক জুয়াখেলায় লিপ্ত, কিন্তু তবু কেন নিক্সন নীরব, কেন নিরব জাতিসংঘ আর নিরাপত্তা পরিষদ? বরং উল্টা আজ যখন বাঙ্গালী জাতির মুক্তিযুদ্ধ সাফল্যের স্বর্ণতোরণের দ্বারপ্রান্তে, যখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে জল্লাদ ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া বাহিনীর মরণদশা, তখন টনক নড়িয়া উঠিয়াছে সাম্রাজ্যবাদী দস্যুদের। ইসলামাবাদের খুনি দোসরদের পরিত্রাণের জন্য শুরু হইয়াছে প্রাণপণ প্রচেষ্টা। বাংলাদেশে ইয়াহিয়া যা করিয়াছে, তার সেই হিংস্র বর্বরতা কারা ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রচেষ্টারই শামিল। কারণ, বাংলাদেশের জনগণের কাছে শেখ মুজিব আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পার্থক্য নাই। তবু কেন আজ বৃহৎ শক্তিবর্গ ‘স্বাধীন দুনিয়ার নায়ক’ আর সুসভ্য গণতন্ত্রী বলিয়া পরিচিত পাশ্চাত্য দেশীয় শাসককুল একটিবারও ইয়াহিয়ার এই উন্মত্ত হিংস্রতার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে পারিল না? অথচ বলা হইয়া থাকে, হিটলারের বিরুদ্ধে মিত্র পক্ষের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্য গণতন্ত্র রক্ষা।
সুতরাং এত দিন যে কথা বলিয়া আসিয়াছি উহাই আজ দিবালোকের মত সত্য হইয়া উঠিয়াছে। জঙ্গী ইয়াহিয়ার ক্ষয়িষ্ণু উপনিবেশবাদী দুঃশাসনের পতনোন্মুখ সৌধটি খাড়া রাখার উদ্দেশ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশ-দেশান্তরের গণবিরোধী শাসকচক্র চায় উপমহাদেশের এই যুদ্ধকে আন্তর্জাতিকীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করিয়া দিতে। জল্লাদ ইয়াহিয়া আর তার মুরুব্বীদের ধারণা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আহবান অনুসারে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ বিরতি ঘটিলে শান্তি আলোচন টেবিলের দুই পার্শে বসিবে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান। আর শৃংখলিতা দুঃখিনী বাংলা তার স্বাধীনতার স্বপ্ন, মুক্তির দুর্মর আকাঙ্ক্ষা বুকে লইয়া এক পার্শে পড়িয়া থাকিবে অনাদৃত-অবহেলিত, শেখ মুজিব থাকিবেন জল্লাদের জিন্দাখানায়। আর এই ভাবেই নির্মূল হইয়া যাইবে বঙ্গবন্ধুর কারামুক্ত আর জননী বাংলার শৃঙ্খল মোচন করিয়া গণতান্ত্রিক চেতনা সমৃদ্ধ রাষ্ট্র ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষ শোষণবিহীন সমাজ আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের উদ্দেশ্যে পরিচালিত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাধারী বাঙ্গালী জাতির জীবনপণ মুক্তি সংগ্রাম।
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দস্যু আর ষড়যন্ত্রকারীর দল জানিয়া রাখুক, এ চক্রান্ত আমরা ব্যর্থ করিয়া দিবই। তারা জানিয়া রাখুক, আমরা একা নই- বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ পার্শ্বে আছেন মহান ভারতের ৫৬ কোটি মানুষ- আর বিবেকবান বিশ্ববাসী। শেখ মুজিবের বাংলাদেশ আর গান্ধী-নেহেরু-নেতাজি-ইন্দিরার ভারত একযোগে হানাদার জল্লাদ বাহিনীর মোকাবেলা করিয়া যাইবে, দুশমনের মারণার্তির শেষ রেশটুকু নিঃশেষে বাতাসে মিলাইয়া যাওয়ার আগে আমাদের সমরাষ্ট্রর ধ্বনি এক মুহুর্তের জন্যও স্তব্ধ হইবেনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারামুক্তি, স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি আদায় আর সেই সঙ্গে মাতৃভূমির বুক হইতে শত্রুবাহিনীকে চিরতরে উৎখাতের আগে আমরা ক্ষান্ত হইবোনা।
যারা আজ ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে যুদ্ধবিরতির আহাজারি করিয়া ছাতি ফাটাইতেছে তারা জানিয়া রাখুক, উপমহাদশে জল্লাদ ইয়াহিয়া যে যুদ্ধের দাবানল ছড়াইয়াছে উহা যদি নির্ধারিত করিতে হয় সর্বাগ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হইবে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হইবে, বাংলাদেশ হইতে সকল পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং তারপর একযোগে বাংলাদেশ-ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে যুদ্ধ বিরতির আহবান জানাইয়া প্রয়োজনবোধে শেখ মুজিব-ইন্দিরা গান্ধী-ইয়াহিয়া খানকে আলোচনা বৈঠকে মিলিত করার উদ্যোগ নিতে হইবে। ইহা ছাড়া আর কোন পথ নাই।