১৭২. ১৬ সেপ্টেম্বর সাম্রজ্যবাদের ট্রয়ের ঘোড়া পাকিস্তান

রাশেদুজ্জামান রণ

<৬,১৭২,২৯৪-২৯৫>

সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা

তারিখঃ ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
                       সাম্রাজ্যবাদের ট্রয়ের ঘোড়া পাকিস্তান
                              আলী ইমাম 

  পাকিস্তান একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্র। আর এই অবাস্তব রাষ্ট্র টিকাইয়া রাখার জন্য চাই ফ্যাসিস্ট সরকার। গত ২৪ বছরের ইতিহাস ইহার সাক্ষ্য। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পর আজ পর্যন্ত ইহার কোন শাসনতন্ত্র রচনা করা হয় নাই। কারণ পাকিস্তানের শাসকবর্গের নিকট ইহা কাম্য ছিলনা। সীমাহীন অত্যাচার নিপীড়ন, জেল-জুলুম আর গুলি চালাইয়া পাকিস্তানী শাসকবর্গ ইহার দ্বিজাতিতত্ত্বের মিথ(myth) কোন মতে ঠেকা দিয়া দাঁড় করাইয়া রাখিয়াছিল। আজ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সেই দ্বিজাতিতত্ত্বকে উপড়াইয়া ফেলিয়াছে।

  ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া চক্রটি গত ২৪ বছর যাবৎ সযত্ন লালিত বিষবৃক্ষের ফল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালে সারা পৃথিবীতে উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশ দেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম শুরু হয়। এই মুক্তি সংগ্রামের মুখে সাম্রাজ্যবাদ পিছু হটিতে থাকে। কিন্তু উপনিবেশ হইতে চলিয়া যাবার সময় বিভিন্নভাবে তাহাদের স্বার্থেরও খুঁটাটা শক্ত করিয়া রাখিয়া যায়।

  বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সুচতুর চালে এবং মুক্তি সংগ্রামের দূর্বলতার জন্য এশীয় ভূখণ্ডে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ট্রয়ের ঘোড়া হিসাবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করে। ধর্ম ও ভারতদ্বেষিতাকে মূলধন করিয়াই পাকিস্তান তাহার ঐক্য অর্থাৎ পাকিস্তানী পুঁজিপতি ও ভূ-স্বামীদের শোষণের স্বর্গ অটুট রাখিতে চাহিয়াছে। ইহাই পাকিস্তানীদের অভ্যন্তরীণ নীতি। বৈদেশিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট এই ট্রয়ের ঘোড়া সকল দেশের মুক্তি সংগ্রামের ক্ষতি সাধনে তৎপর রহিয়াছে। মিত্রের ছদ্মবেশে এবং ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের ঐক্যের বুলির আড়ালে সাম্রাজ্যবাদের এই বাহনটি ব্যবহার করা হইতেছে।

১৯৫৬ সালে বৃটেন, ফ্রান্স ও ইসরাইল যখন একযোগে মিশর আক্রমন করে তখন পাকিস্তান সরকার বৃটেনের প্রতি সমর্থন জানাইয়াছিল। ক্ষুব্ধ নাসের তৎকালীন পাকিস্তানী জনৈক মন্ত্রীকে মিসরে ঢুকিতে বারণ করিয়াছিলেন। বান্দুং সম্মেলনও পাকিস্তান ব্যর্থ করিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু সাধ্যে কুলায় নাই। পঞ্চশীলার স্থলে পাকিস্তানের ‘সপ্ত-স্তম্ভের’ নীতি পাল্টা দাঁড় করাইবার প্রয়াস হইতে ইহা বোঝা যায়। হাভানায় ত্রিমহাদেশীয় সম্মেলনেও কাশ্মীর সমস্যাকে চাল হিসাবে ব্যবহার করিতে চাহিয়াছিল।

কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের এই ট্রয়ের ঘোড়াটি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুক্তি সংগ্রামে ও জাতীয় স্বাধিকার সংগ্রামের সর্বাপেক্ষা ক্ষতি করিয়াছে ও ক্ষতি সাধন করিতেছে। মুখে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বুলি আওড়াইয়া সাম্রাজ্যবাদের এই সেবাদাসী ইঙ্গ-মার্কিন প্রভুর মনস্তুষ্টি সাধনে ব্যগ্র।

মধ্যপ্রাচ্যে বাগদাদ প্যাক্ট ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সিয়েটো চুক্তি করিয়া পাকিস্তান সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত সহচরদের মধ্যে স্থান করিয়া লইয়াছে। ইরাকে রাজতন্র বিরোধী সফল অভ্যুত্থান বাগদাদ চুক্তির ভিত্তি কাঁপাইয়া তোলে। ইরাক বাগদাদ চুক্তি হইতে বাহির হইয়া যায়। পরবর্তী সময়ে এই প্যাক্ট সেন্টো নামে অভিহিত হয়।

সেন্টোর সদস্য হিসাবে পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করিয়া চলিয়াছে। মধ্য প্রাচ্যের প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রগুলিকে সর্বতোভাবে পাকিস্তান সাহায্য করিতেছে।

  গত ১৯৭০ সালে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে জর্ডানে প্যালেস্টাইন গেরিলা বাহিনী ও জর্ডানের রাজকীয় বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধে পাকিস্তান সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছে। মুখে ইসরাইলের বিরোধীতা করিলেও পাকিস্তান সেন্টোর অংশীদার তুরস্কের মারফৎ ইসরাইলের সহিত যোগাযোগ রাখিয়া চলিয়াছে।

প্যালেস্টাইন গেরিলা বাহিনীর নেতা ইয়াসির আরাফাত অভিযোগ করিয়াছেন যে, জর্ডানের ভক্ত(?) আমার মনে হয় ‘শক্ত’ হবে??? রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সময় বাদশাহ হোসেনের রাজকীয় বাহিনীর অভিযান পরিকল্পনার রচয়িতা একজন পাকিস্তানী জেনারেল। পাকিস্তানী সামরিক অফিসারগণ উক্ত অভিযানে সরাসরি অংশগ্রহণ করিয়াছিল।

  গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝি জর্ডানের এশীয় সীমান্তে প্রচণ্ড ট্যাঙ্ক যুদ্ধ হয়। গেরিলা বাহিনীর পশ্চান্ধাবন(?) পশ্চাদগমন করিয়া জর্ডানের রাজকীয় বাহিনী সিরিয়ায় প্রবেশ করে। বিমানের ছত্রছায়ায় জর্ডানী একটি ট্যাঙ্ক বাহিনী সিরিয়া সীমান্তে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানী বিমান বহর জর্ডানকে এই সংঘর্ষে সহায়তা করিয়াছে।

  মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদের ট্র্য়ের ঘোড়া পাকিস্তানের এই কীর্তিকলাপ নতুন কিছু নয়। ইহাই পাকিস্তান মার্কা ‘ইসলামী আদর্শের’ স্বরুপ। যাহারা সময়ে সময়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথার তুবড়ি ছুটায় তাহারা মার্কিন সাম্রাজ্যাবাদের এই পদলেহী পাকিস্তান সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য অস্ত্র ও সাহায্য পাঠাইতে কসুর করেনা।

  বাংলাদেশই শুধু পাকিস্তানী বর্বর বাহিনীর নারকীয়তার শিকার নহে। ১৯৫৮-৫৯ সালে বেলুচদের স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বায়ত্বশাসনের দাবীকে ইহারা রক্তের বন্যায় ডুবাইয়া দিয়াছে। ঈদের নামাজ আদায়রত হাজার হাজার মুসল্লীর উপর বিমান হইতে বোমাবর্ষণ করিয়া “বিপন্ন ইসলাম” কে রক্ষা করিয়াছে। সেদিন ৪ শতেরও অধিক বেলুচ প্রাণ হারায়। সেদিন রক্তগঙ্গা বহাইয়া যে টিক্কা খান হাত পাকাইয়াছে তাহাকে বাংলাদেশে গণহত্যা করিতে পাঠান হইয়াছে। কিন্তু গণহত্যা চালাইয়া পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সরকার বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন দমন করিতে পারে নাই। পাকিস্তানের মিত্ররা মদদ দিয়াও শেষ রক্ষা করিতে পারিবে না। সাম্রাজ্যবাদের সাধের ট্রয়ের ঘোড়াটির খেলা শেষ হইয়া আসিয়াছে। বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের হাতে মার খাইয়া ইহার সমস্ত জারিজুরি ফাঁস হইয়া গিয়াছে।

Scroll to Top