(১) কুমিল্লা নোয়াখালির সশস্ত্র প্রতিরোধ: সাক্ষাতকারঃ সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান

<৯, ৩.৬, ১৪২-১৪৭>

কুমিল্লা-নোয়াখালির সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাতকারঃ সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান

(বাংলা একাডেমির দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

১৮-৯-১৯৭৩

 

৩০শে অথবা ৩১শে মার্চ ১৯৭১ সুবেদার সিরাজুল হককে নিয়ে আমি চৌমুহনি পৌছি। এখানে পরিষদ সদস্যদের সাথে দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়। নুরুল হক ও অন্যান্য সদস্যগন ঢাকাসহ প্রদেশের সমস্ত জায়গায় পাক পশুশক্তির বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন এবং বহু প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনি। তারা সবাই আমাকে যে কোন প্রকারে যোদ্ধা সংগ্রহ করে শত্রুর উপর পাল্টা আঘাত হানার প্রস্তুতি নিতে বলেন। তারা সর্বপ্রকারে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতিও দেন এবং মাইজদীতে নিয়ে যান। সেখানে তৎকালীন এম-এন-এ এমপিএ’ দের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।

 

২রা এপ্রিল অতঃপর আমি ফেনীতে গিয়ে মেজর জিয়াউর রহমান (বর্তমান ব্রিগেডিয়ার, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ, বাংলাদেশ আর্মি) সাহেবের সঙ্গে বিভিন্ন পরামর্শ করি। মেজর জিয়াউর রহমান সাহেব আমাকে কালবিলম্ব না করে নোয়াখালিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং বঘমারায় শত্রুকে বাঁধা দিতে নিষেধ করেন। তিনি সকল প্রকার অস্ত্র সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতিও দেন। ফেনী থেকে ফিরে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইপি-আর এবং ৭৬ জন প্রক্রিত নিয়মিত সদস্য সংগ্রহ করি ও নোয়াখালীতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করি।

 

৪ঠা এপ্রিল, ১৯৭১-সর্বপ্রথম বাগমারা পরিদর্শনঃ দয়াময়কে স্মরণ করে সর্বপ্রথমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করার জন্য লাকসামের উত্তরে বাঘমারা পরিদর্শন করি এবং সুবেদার নজরুল ও সুবেদার জব্বারকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্থান নির্দিষ্ট করে দেই। এমন সময় নোয়াখালি জেলার ডেপুটি কমিশনার সাহেব এবং পরিষদ সদস্যগন এসে আমাকে জানালেন যে, দু’খান পাকসেনা বহনকারী জাহাজ রামগতির দক্ষিন পাশের নদীতে অবস্থান করছে। এ খবর শোনার পর আমি তৎক্ষণাৎ রুহুল আমিন (শহীদ), পিটি-অফিসার সাহেবসহ চারজন বুদ্ধিমান জোয়ানকে তার সত্যতা প্রমান করতে উক্ত নদীতে পাঠালাম। তারা নদী থেকে ফিরে এসে আমাকে ঘটনার নিশ্চয়তা দিয়ে জানান যে, সেখানে একখানা নৌকা ব্যাতিত কিছুই নেই। অতঃপর ৫ই এপ্রিল নোয়াখালীর অদূরবর্তী দৌলতগঞ্জের  সেতুটি ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেই। কেননা পাকসৈন্যরা তখন লাকসামের উত্তরে বাঘমারাতে অবস্থান করছিল। কয়েকজন মোজাহিদ এবং আনসারকে হালকা অস্ত্র দিয়ে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করি। বিকেলে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য সংগ্রহের উদ্দেশে ফেনীতে যাই।

 

৬ই এপ্রিল, ১৯৭১: ফেনী থানা থেকে অতিকষ্টে ১৮টি হ্যাণ্ড গ্রেনেড সংগ্রহ করে কোম্পানিতে ফিরে আসি। এক’দিনে রাত-দিনের আরাম আয়েশ হারাম হয়ে পড়ে  আমার জন্য। শুধু যোদ্ধা,অস্ত্র আর এমুনিশন সংগ্রহের চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ি। যে সমস্ত যোদ্ধা আমার সাথে ছিল তাদের হাইড-আউটের কথাও চিন্তা করি।

 

৭ই এপ্রিল, ১৯৭১: সারারাত যোদ্ধা,অস্ত্র আর এমুনিশন সংগ্রহের উদ্দেশে হাঁটাহাঁটি করে ভোর ছ’টায় ক্যাম্পে ফেরামাত্র খবর পেলাম ফেনীতে ইপিআর এবং অবাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষের। পুরা কোম্পানি নিয়ে ফেনী যাবার সিদ্ধান্ত নিলে সুবেদার সীরাজ ফেনী যাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেন। কেননা আমাদের হাতে কয়েকটি রাইফেল ছাড়া কিছুই ছিল না। তার কথামতো কোম্পানি রেখে আমি নিজে স্বচক্ষে পরিস্থিতি দেখার জন্য ফেনী রওনা হই। ফেনীর পরিস্থিতি দেখে চৌমুহনীতে ফিরে আসি এবং নোয়াখালীর পরিষদ সদস্য এবং আওয়ামীলীগ নেত্রীবর্গের সঙ্গে জরুরী পরামর্শে বসি।

 

৮ই এপ্রিল, ১৯৭১: নোয়াখালীর ডেপুটি কমিশনার জনাব মঞ্জুর সাহেব সারা দেশের পরিস্থিতি আলোচনার জন্য আমাকে ডেকে পাঠান। নোয়াখালীর প্রতিরক্ষার জন্য তাগাদা দেন। বিকেলে ক্যাপ্টেন এনামুল হক সাহেব কোম্পানি পরিদর্শন করে আমাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন।

 

৯ই এপ্রিল, ১৯৭১: শত্রুর তুলনায় সামান্য অস্ত্র এবং যোদ্ধা নিয়ে ফরোয়ার্ড লাইনের প্রায় সবটাই কভার করে দেই। এ-দিন নাথের পেটুয়া ষ্টেশনের কাছে আরও ফরোয়ার্ড ডিফেন্স স্থাপন করি।

 

১০ই এপ্রিল, ১৯৭১: লাকসামে প্রথম সামনাসামনি যুদ্ধঃ ১০ই এপ্রিল বর্বর পশুশক্তির বিরুদ্ধে শুরু হয় মুখোমুখি যুদ্ধ। নোয়াখালী পরিষদ সদস্যদের দেয়া চারশত টাকা ফরোয়ার্ড ডিফেন্স বাহিনীতে ভাগ করে দিতে যাই লাকসামে সকাল ১০টায়। বেলা ১২টার সময় খবর পেলাম পাকবাহিনী বাঘমারা থেকে অগ্রসর হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংকল্প নেই। লাকসামের সামান্য উত্তরে পশুশক্তিকে বাঁধা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে সেই অনুসারে পজসন নেওয়া হল। মাত্র ৭০ জন যোদ্ধা নিয়ে এই অভিযান চালাই। সঙ্গে দু’টো এল-এম-জি ছাড়া সবই ৩০৩ রাইফেল ছিল। তাই নিয়ে শত্রুর অপেক্ষায় বসে রইলাইম সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত। কিছুক্ষন পর শত্রুপক্ষ যখন আমাদের রেঞ্জের ভিতর চলে আসে তখনই একসঙ্গে গোলাগুলি শুরু করি। আমার এ অতর্কিত আক্রমনে পাকবাহিনীর দু’জন লেফটেন্যান্ট সহ ২৬জন সৈন্য নিহত হয় এবং ৬০ জন আহত হয়। পর মুহূর্তে সাম্লে নিয়ে পাকবাহিনীর সৈন্যরাও মেশিঙ্গান, মর্টার ও আর্টিলারির গোলাগুলি শুরু করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু হল। প্রায় ৪ ঘন্টা গোলাগুলি বিনিময় হয়। শত্রুপক্ষের দুটো ট্রাকে আগুন ধরে যায়। ক্রমেই আমাদের গোলাবারুদ শেষ হতে থাকে। সরবরাহ ও সাহায্যের কোন আশা ছিল না। অপর পক্ষে পাকবাহিনী ময়নামতি থেকে সরবরাহ ও সৈন্য পেয়ে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে আমাদের উপর। কাজেই অক্ষত সৈন্যদের নিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হই। ফলে পাকবাহিনী লাকসাম দখল করে নেয়।

 

রাতে নুরুল হক সাহেব,নাগাবাবু সহ অপর দুজন পরিষদ সদস্য ২টা এল-এম-জি আর ৪টা এস-এল-আর আমার হাতে অর্পন করেন। কিছু বিস্ফোরক দ্রব্য দিয়ে দৌলতগঞ্জ সেতু উড়িয়ে দেই এবং লাকসাম-নোয়াখালি সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হই।

 

২০শে এপ্রিল, ১৯৭১-নাথের পেটুয়ার মুখোমুখি যুদ্ধঃ ১০ই এপ্রিল সারা রাত সেতু ধ্বংস করায় ব্যস্ত থাকায় ভোরে বিপুলাশ্বরে পৌছামাত্র মাইজদি থেকে টেলিফোনযোগে খবর পেলাম যে, লাকসামে অবস্থানরত পাকসৈন্যরা নোয়াখালীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমি তৎক্ষণাৎ কোম্পানিকে ফল-ইন করিয়ে সুবেদার সিরাজ সাহেবকে প্লাটুনের কমান্ডার নিযুক্ত করি এবং সুবেদার জব্বার সাহেবকে দ্বিতীয় প্লাটুনের কমান্ডার নিযুক্ত করে দিই। আমি নিজে তৃতীয় প্লাটুনটি গেডকোয়ার্টারসহ নিয়ে নাথের-পেটুয়া অভিমুখে দ্রুতগতিতে ছুটে গিয়ে ষ্টেশনের পূর্ব দিকের দায়িত্ব সুবেদার সিরাজ সাহেব ও জব্বার সাহেবের উপর অর্পন করি এবং আমি পশ্চিম দিক রক্ষার দায়িত্ব নেই। তাদেরকে একথাও জানাই যে, আমাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের যখন কোন ব্যবস্থা নেই, সেহেতু শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যেন কেউই পশ্চাদসরণ না করেন।

 

আমি নিজের প্লাটুনকে প্রত্যেক সেকশনের পজিশন স্বহস্তে দেখিয়ে দেই। খনন কার্য শেষ না হতেই হঠাত নায়েক সিরাজ সতর্ক সঙ্কেত দ্বারা আমাকে দেখালেন যে শত্রুপক্ষ ক্রলিং করে আমাদের পজিশনের নিকটে চলে এসেছে আমি চেয়ে দেখি সত্য সত্যই শত্রুরা ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে প্রায় এক কোম্পানি ক্রলিং করে এমনভাবে আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে যা ধারনা করা যায় না। আমি তৎক্ষণাৎ এস-এল-আর এর মাধ্যমে গুলি শুরু করি। নায়েক সিরাজও এল-এম-জির মাধ্যমে শত্রুর উপর আঘাত করে। বলতে গেলে আমার সমস্ত প্লাটুনের সদস্যরা একসাথে আগত শত্রুর প্রত্যেককে আহত বা নিহত করতে সক্ষম ছিল। এরপর তাদের ফলোআপ কোম্পানি দ্বিগুণ বেগে তাদের সাপোর্টিং বা সাহায্যকারী অস্ত্রের দ্বারা দ্রুতবেগে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে বিফল মনোরথ হয়ে আহত ও নিহত সৈন্যদেরকে সরিয়ে নিয়ে পিছনে চলে যায় এবং তারপর আমাদের উপর আর্টিলারি এবং মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। পূর্ব দিকে যখন আমার দ্বিতীয় প্লাটুনের এল-এম-জির ফায়ার শত্রুপক্ষের উপর পড়ছিল তখন শত্রুরা তাদের উপরও দ্বিতীয় প্লাটুনের উপর অনবরত শেলিং করতে থাকে। পরিনামে আমার একজন সৈন্য তৎক্ষণাৎ শহীদ হন এবং একজন গুরুতরভাবে আহত হন। আমি বাধ্য হয়ে প্লাটুনকে ২০০গজ পশ্চাতে একটা ডোবার পাশে দৌড়ে পজিশন নিতে আদেশ দেই। শত্রুর দুই প্লাটুনের মতো সৈন্য আমার প্রথম পজশনটি দখল করে ফেলে। এ সময় আমি আমার প্লাটুনকে আদেশের মাধ্যমে দ্বিতীয় ডিফেন্সিভ পজিশনে নিয়ে যাই। এবং পুনরায় শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করেই গুলি আরম্ভ করি। এমন সময় হঠাৎ তিনখানা যুদ্ধ বিমান সোজা আমাদের উপর ডাইভ করে পর পর তিনবার আক্রমণ চালায়। তারা প্রচুর পরিমানে গুলি ছুড়ে এবং নাপাম বোমা ফেলতে থাকে। আমাদের সৌভাগ্য যে, সমস্ত গুলি এবং বোমাগুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং অনবরত যুদ্ধ চলতে থাকে। শত্রুদের আর এক ইঞ্চি অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা ছিল না। তখন আমি পূর্বদিকে অবস্থানরত দুই প্লাটুনের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আমার একজন জোয়ানকে তাদের খবর আনতে পাঠাই। এ সময় পূর্ব দিকের গ্রামগুলি আগুনে কেবল জ্বলতে দেখি। সংবাদদাতা ফিরে এসে জানালো যে, পূর্বদিকের দুই প্লাটুন তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে সৈন্য তুলে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। এ কথা শোনার পর আমি বাধ্য হয়ে অলরাউণ্ড ডিফেন্স করি। এভাবে সন্ধ্যে পর্যন্ত গোলাগুলি বিনিময় হয়। সন্ধের পর পাকবাহিনী রেকি পেট্রোলিং শুরু করে। তারা আমাদের উপর ফাইটিং পেট্রোল পাঠায়। আমার সঙ্গে দু’ঘন্ট পর্যন্ত যুদ্ধ হয়। তারা যাবতীয় অস্ত্র দ্বারা গুলি করতে থাকে এবং কিছুক্ষন পর তারা চলে যায়।

 

সারাদিন ধরে যুদ্ধ করার পর অনাহার আর অবিশ্রামে আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না আমাদের। এমতাবস্থায় পুনরায় যুদ্ধ করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলি এবং রাত সাড়ে দশটার সময় আমি আমার যোদ্ধাদের নিয়ে সোনাইমুড়ি অভিমুখে রওনা দেই। এ সময় রাস্তায় কোন জন্সনের সাড়াশব্দ ছিল না। প্রত্যেক বাড়ির লোক ধন-সম্পদের আশা ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়ে চলে গেছে। সোনাইমুড়িতে পৌছে ড. মফিজ সাহেবের সাক্ষাত পাই। আমাদের বিশেষ করে আমাকে দেখে তিনি জড়িয়ে ধরেন। (ড. মফিজ খবর পেয়েছিলেন যে, আমরা পাকিস্তান বাহিনীর সাথে যুদ্ধে মারা গেছি) তারপর তিনি আমাকে ও আমার সৈন্যদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

 

২১শে এপ্রিল ভোরে পুনরায় সৈন্যদের অগ্রসর হবার খবর পেলাম। পূর্বদিন যুদ্ধে আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তাছাড়া এমুনিশনও তেমন ছিল না। তব শত্রুবাহিনীর অগ্রগতি রোধ করার সিদ্ধান্ত নেই। এবং সে অনুযায়ি সোনাইমুড়ি রেলস্টেশনের আউটার সিগনালের কাছাকাছি এমবুশ পার্টি বসাই। কিছুক্ষন পর শত্রুবাহিনীর জোয়ানরা অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে আমরা গুলি চালাই। শত্রুপক্ষ ৩’’ মর্টার ও মেশিনগান থেকে গুলি চালায়। বেশ কিছুক্ষন যুদ্ধ চলে। বেলুচ রেজিমেন্টের কয়েকজন সদস্য হতাহত হয়। ইতিমধ্যে আমাদের এমুনিশন শেষ হয়ে গেলে আমি আমার বাহিনীকে উইথড্র করে চলে আসি। পাকবাহিনী সোনাইমুড়ি দখল করে চৌমুহনীর দিকে অগ্রসর হয়।

 

আমি আবিরপাড়ায় একটি গোপন বৈঠক দিই। এখানে কর্মীদের বিপুল উৎসাহ দেখা যায়। নায়েক সুবেদার ওয়ালিউল্লাহ ও ইশাক মাতৃভূমি রক্ষার্থে আমার সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।

 

২৪শে এপ্রিলঃ আওয়ামীলীগের বিশিষ্ট কর্মী জনাব আমিন উল্লাহ মিয়ার সাথে আমার সাক্ষাত হয়। তিনি বর্বর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য আমাকে সাহস দেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা ও খাওয়ার নিশ্চয়তা দেন। তিনি প্রথমবারের মতো ভারত থেকে অস্ত্রসস্ত্র আনার জন্য এবং রাস্তা ঠিক করার জন্য ভারতে চলে যান। এইদিনে সুবেদার ওয়ালিউল্লাহ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে আমার কোম্পানিতে যোগদান করেন।

 

২৬শে এপ্রিলঃ হাবিলদার নূর মোহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে বিপুলাশ্বর ষ্টেশনের এক আড়ালে এমবুশ করি। সকালে পাকবাহিনীর সিগনাল ম্যান সহ দু’খানা গাড়ি যবার সময় এম-এমজি দ্বারা ব্রাশ করলে তাদের একখানা গাড়ি নষ্ট হয়ে যায় এবং দু’জন আহত হয়। পাকবাহিনী আহত ব্যক্তিদ্বয়কে নিয়ে অন্য গাড়িসহ পালিয়ে যায়। এখানে হাবিলদার নূর মোহাম্মদ অত্যান্ত সাহসিকতার পরিচয় দেন। এখানে দুটো রাইফেল উদ্ধার করি।

 

২৮শে এপ্রিলঃ সিপাই শাহজাহানকে নিয়ে সোনাইমুড়িতে রেকি করি। ২৯শে এপ্রল নায়েক সফি তার সেকশন নিয়ে সোনাইমুই আউটার সিগনাল পুনরায় এমবুশ করে। কিছুক্ষন পর পাকবাহিনীর তিনখানা গাড়ি অগ্রসর হতে থাকলে সফি ফায়ার শুরু করে। ফায়ারের সম্মুখের গাড়িখানা অকেজো হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুপক্ষ পজিশন নিয়ে ফায়ার শুরু করে। দু’তিন ঘন্টা যাবত গোলাগুলি বিনিময় হয়। এখানে পাকবাহিনীর গুলিতে একটি ছেলে ও এক বৃদ্ধ মারা যায়।

 

১লা মে-বগাদীয়ার যুদ্ধঃ নায়েক সিরাজ এক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে বগাদীয়া সেতুর কাছে এমবুশ করে। এ জায়গায় একখানা জিপসহ তিনখানা ৩-টনি লরি কিছু দুরত্ব বজায় রেখে অগ্রসর হবার সময় নায়েক সিরাজ পাকবাহিনীর উপর চরম আক্রমণ চালায় এবং প্রথম ও শেষ গাড়িখানার উপর অনবরত গুলি চালালে ৩-টনি একখানা গাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। এখানে ১৫/২০জন খানসেনা সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয়,কয়েকজন আহত হয়। পরক্ষনে পাকসেনারা ৩’’ মর্টার ও মেশিনগান হতে অবিরাম গোলাগুলি বর্ষণ করতে থাকে। দীর্ঘ সময় যুদ্ধের পর নায়েক সিরাজ প্লাটুন উইথড্র করে। পাকসেনারা এখানে কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং একজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এ যুদ্ধে হাবিলদার নুরুল আমি ও অপর একজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হয়। নায়েক সিরাজ অসীম সাহস ও বিরত্বের সাথে এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

 

৬ই মে-ফেনাকাটা পুলে সংঘর্ষঃ চৌমুহনি-চন্দ্রগঞ্জ রাস্তায় পাকবাহিনীর চলাচল শুরু হয়। কিন্তু এমবুশ করার সুযোগ পাইনা। অবশেষে নায়েক সফির সেকশন নিয়ে এমবুশ পার্টি বসাই। বহুক্ষন অপেক্ষা করার পর তিনখানা পাকসৈন্য বোঝাই ট্রাক চন্দ্রগঞ্জ থেকে অগ্রসর হতে থাকে আমরা অতর্কিত হামলা চালাই। আমাদের এ অতর্কিত আক্রমনে পাকসেনারা কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে পড়ে। তাদের প্রস্তুতি নেয়ার পূর্বেই বেশ কয়েকজন খানসেনা ধরাশায়ী হয়। মুহূর্তের  মধ্যে তারা ভারী মেশিনগান দ্বারা আমাদেরকে পাল্টা আক্রমণ করে। পাকসেনাদেরমেশিনগানের গুলিতে আমাদের একই নামের দুজন বীর মুক্তিসেনা (ইসমাইল) শহীদ হন। তাদের একজনের বাড়ি আমিশাপাড়া বাজারের পশ্চিমে সাতঘরিয়া,অপরজনের বাড়ি নোয়াখালী জেলার রামগঞ্জে। এরপর আমি আমার সৈন্য তুলে নিয়ে শহীদদ্বয়ের দাফনের ব্যবস্থা করি। আওয়ামীলীগের বিশিষ্ট কর্মী চৌমুহনীর হোটেল জায়েদীর মালিক পদিপাড়ার নূর মোহাম্মদ সাহেবের তত্তাবধানে পদিপাড়াতে সমাধিস্হ করা হয়।

 

৮ই মে আমি মেজর খালেদ মোশারফ সাহেবের আদেশক্রমে অস্ত্র আনয়ন করি।

 

৯ই মে-পুনরায় বগাদীয়াতে যুদ্ধঃ ফেনাকাটা যুদ্ধ ও অপারেশনের পর জনসধারণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নতুন সাহসের সঞ্চার হয়। নায়েক সুবেদার ওয়ালিউল্লাহকে বগাদীয়াতে এমবুশ করার নির্দেশ দিয়ে নায়েক সুবেদার জাবেদকে সঙ্গে নিয়ে আমি শত্রুবাহিনীতে কর্মতৎপরতা ও অবস্থান লক্ষ করার উদ্দেশ্যে চৌমুহনি রওনা দেই। চৌমুহনীতে পাকবাহিনীর গতিবিধি লক্ষি করে বগাদীয়ায় ফেরার পূর্বেই নায়েক সুবেদার ওয়ালিউল্লাহ পাকবাহিনীর একখানা পিকআপ ভ্যানের একজন জেসিও সহ ছয়জনের উপর আক্রমণ করে। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুদের দুজন সৈন্য (জেসিও) নিহত হয়। গাড়িখানা রাস্তায় পড়ে যায়। ইতিমধ্যে আমরাও পৌছে গেলাম। ঠিক সেই সেই মুহূর্তে পাকবাহিনীর আরও দুখানা গাড়ি এসে পড়ল। আরম্ভ হয় উভয় পক্ষের মধ্যে আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণ। প্রায় ৪/৫ ঘন্টা গোলাগুলি বিনিময় হয়। অবশেষে শত্রুরা হতাহতদের নিয়ে চৌমুহনীর দিকে চলে যায়। এখানে শত্রুপক্ষদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। এ যুদ্ধে নায়েক সুবেদার ওয়ালিউল্লাহর কপালে গুলি লাগে এবং তিনি সামান্য আহত হন। তিনি এ যুদ্ধে অসামান্য সাহস ও বিরত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পাকবাহিনীর উক অকেজো গাড়িখানা স্বাধীনতার পরও দীর্ঘ কয়েকমাস রাস্তার পাশে উল্টে পড়ে থাকে।

 

তৎকালীন পাকিস্তান বাজারের পূর্ব দিকে যুদ্ধঃ পাকসেনাদের চৌমুহনী-লক্ষ্মীপুর বাজারে আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় সেই রাস্তায় এমবুশ করার পরিকল্পনা করি। অবশেষে ১০ই মে এমবুশ করে বসে থাকি। কিছুক্ষন পর দেখা গেল একখানা সিভিল বাসে কিছু ছদ্মবেশে ও কিছু সামরিক পোশাকে খানসেনারা লক্ষীপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই বাসে ২/৩ শত গজ পেছনে সামরিক গাড়িতে আরও বহু পাকসেনা অগ্রসর হচ্ছিলো। প্রথম গাড়িকেই আমরা আঘাত করি। ফলে কয়েকজন সৈন্য প্রান হারায়। মুহূর্তে অন্য পাকসেনারা প্রস্তুত হয়ে মর্টার ও আর্টিলারির সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালালে আমরা সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হই।

 

১১ই মে, ১৯৭১-মীরগঞ্জে পাকবাহিনীর পরাজয়ঃ এখানে রেকী করে সুবেদার ওয়ালিউল্লাহকে এমবুশ করার নির্দেশ দেই এবং নায়েক আবুল হোসেনকে রাস্তায় মাইন পুততে নির্দেশ দেই। আবুল হোসেন মাইন বসিয়ে আত্বগোপন করে থাকে। লক্ষীপুরের প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল মতিনও তার সেকশন নিয়ে এই অভিযানে অংশগ্রহন করে। কিছুক্ষণ পর শত্রুবাহিনী মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের ভয়ে একখানা গরুর গাড়ি সামনে রেখে অগ্রসর হতে থাকে। গরুর গাড়িখানা পুতে রাখা মাইনের উপর দিয়ে অতক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে প্রণ্ড আওয়াজে সেটি কয়েক হাত উপরে উঠে যায়। প্রচণ্ড আওয়াজে খানসেনারা এতোটাই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ে যে তারা কয়েকজন অস্ত্র ফেলে প্রাণপণে পালানোর চেষ্টা করে। অম্নি শুরু হয় আমাদের গোলাগুলি। কয়েকজন হতাহতও হয়। জানা যায়,শত্রুরা পালিয়ে যাবার সময় জনসাধারনের হাতে দুজন খানসেনা মাছমারা রাক্সা দ্বারা আহত হয়। শত্রুপক্ষের ফেলে যাওয়া বেশ কয়েকটি অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। এখানেও সুবেদার ওয়ালিউল্লাহ অসীম বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন।

 

১২ই মে চৌমুহনীর দেড় মাইল উত্তরে মান্দারহাটে শত্রুদের উপর চরম আঘাত হানার জন্য এক প্লাটুন মুক্তিসেনা নিয়ে এমবুশ করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। তখন চৌমুহনীতে পাকবাহিনীর বিরাট ঘাঁটি অবস্থান করছিল। এসময় পাকবাহিনী গুপ্তচর দ্বারা খবর নিয়ে অতর্কিত এক ব্যাটেলিয়ন সদস্য নিয়ে আমাদেরকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করলে আমরা সেখান থেকে কোন প্রকারে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই। কিন্তু পাকবাহিনী আমাদের ধরতে না পেরে মান্দারহাট বাজারটি পুড়িয়ে দেয়।

 

১৩ই মেঃ একদিন বিকাল দুটায় খবর পেলাম নোয়াখালীর এসডিও দুই গাড়ি পাকসৈন্যসহ লক্ষ্মীপুর পরিদর্শনে গেছেন । তাদের প্রত্যাগমনে বাঁধা দেয়ার জন্য হাবিলদার নূর মোহাম্মদ এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে চন্দ্রগঞ্জের নিকট কোন এক যায়গায় এমবুশ করেন। এ এমবুশে এসডিও সহ কয়েকজন সৈন্য আহত হয়।

 

১৪ই মেঃ নায়েক আবুল হোসেন বিপুলাশ্বর ষ্টেশনের কাছে কয়েকটি মাইন পুতে রাখে। কিন্তু পাকসেনাদের গাড়ি অতিক্রম করার পূর্বেই একখানা ইটবোঝাই ট্রাক সে স্থান অতিক্রম করার সময় ট্রাকটি পড়ে যায়। অন্যদিকে একই দিনে হাবিলদার নূর মোহাম্মদ তার প্লাটুন নিয়ে চন্দ্রগঞ্জে এমবুশ করে ৫/৬ জনকে খতম করতে সক্ষম হন। অসমর্থিত খবরে জানা যায়,একজন কর্নেলও নাকি নিহত হয়। পড়ে তারা দোয়াইরা গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।

 

১৫ই মে নায়েক সুবেদার এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ৭ মাইল পায়ে হেঁটে খিলপাড়ার পশ্চিমে মইলকার দীঘির পাড়ে পাকহানাদার বাহিনীর ছোট একটি ছাউনি আক্রমণ করে সেখান থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। নায়েক সুবেদার ইসহাক এখানে অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দেয়।

 

১৮ই মে, ১৯৭১-সাহেবজাদার পুল ধ্বংসঃ ওয়ালীউল্লাহ মাইন দারা সাহেবজাদার পুলটি ধ্বংস করে লাকসাম-নোয়াখালীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

 

১৯ শে মে- বগাদিয়াউ পুনরায় সংঘর্ষঃ নায়েক আবুল হোহেনকে মাইন বসানোর নির্দেশ দিয়ে গোপনে এমবুশ করে বসে থাকি। সকাল ৯টার সময় ৩জন পাকসেনা বেবি ট্যাক্সি করে লাকসাম যাবার সময় বগাদীয়ায় পৌছলে পোঁতা মাইন বিস্ফোরণে বেবি ট্যাক্সিটি কয়েক গজ দূরে উড়ে যায় এবং ৩জন খানসেনাই নিহত হয়। এ খবরপাকবাহিনীর কানে পৌছামাত্র এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে ঘটনাস্থনে উপস্থিত হলে আমরা গা-ঢাকা দিই।

 

২৬শে মে সুবেদার ওয়ালিউল্লাহ দালাল বাজার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে ৩০ জন রাজাকারকে হত্যা করেএবং ৬টি রাইফেল উদ্ধার করে।

 

২৮মে পুনরায় সেক্টর কমান্ডারের আদেশক্রমে ভারতে কনফারেন্সে যোগ দিয়ে কিছু এমুনিশন নিয়ে আসি।

 

২৯শে মে মীরের হাট থেকে ১৫ জনের একটি রাজাকার দল আসতে থাকলে হাবিলদার আবুল মতিন তাদেরকে আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত ১৫ জন রাজাকারই হাবিলদার আবুল মতিনের হাতে ধরা পড়ে এবং নিহত হয়।

Scroll to Top