(১) কুমিল্লা-নোয়াখালির সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ(২) ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সশস্ত্র প্রতিরোধ: সাক্ষাৎকার- মেজর আবদুল গাফফার

<৯, ৩.৩, ১৩৪-১৩৭>

কুমিল্লানোয়াখালীর সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকার- মেজর গাফফার

(১৯৭১ সালে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংকলিত)

২৮০৮১৯৭৩

 

আমি মনে করেছিলাম কুমিল্লা ব্রিগেডের ইকবাল মোঃ শফি আমাদের ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বিভক্ত এবং দুর্বল করে দিয়ে ধ্বংস করে দিবে। সেহেতু ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিনটি কোম্পানীকে বাইরে পাঠিয়ে সিলেটে অবস্থানরত ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত ২৪তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স-এর ৩ কমান্ডো ব্যাটালিয়ন দিয়ে আক্রমণ ও ঘেরাও করিয়ে ধ্বংস করাই তারা শ্রেয় ভেবেছিলো। তারা একাজ ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছিলো, কিন্তু আল্লাহর রহমতে তাদের পরিকল্পনা সফল হয় নি। এ পরিস্থিতিতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে অন্যান্য কোম্পানীর সাথে যোগ দেয়া শ্রেয় মনে করি। আমি ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম কমাণ্ড লেঃ কর্নেল খিজির হায়াতকে বুঝাতে থাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে গিয়ে অন্যান্য কোম্পানীর সাথে মিলিত হবার জন্য। তিনি খুব ভালো লোক ছিলেন এবং আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন। তিনি আমার কথায় কনভিন্সড হন এবং নির্দেশ দেবার জন্য ব্রিগেড কমান্ডারের কাছে যান। ব্রিগেড কমান্ডার তাকে তার বাহিনী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার নির্দেশ দেন। লেঃ কর্নেল খিজির হায়াত ফোনে আমাকে ২৩শে মার্চ ১টার মধ্যে বাকী কোম্পানী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাবার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। আমি দ্রুততার সঙ্গে ৩০টি ৩ টনের গাড়িতে বেশী পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র এবং অতিরিক্ত লোক নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হই। আমি একটা প্লাটুন জাঙ্গালিয়াতে রেখে যাই এবং আরেকটা প্লাটুনকে ভিতরে রেখে যাই ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত বাঙালি অফিসারদের পরিবার পরিজনের প্রতি খেয়াল রাখার জন্য। আমরা আমাদের পরিবার পরিজনকে নিরাপদ জায়গায় সরাতে পারি নি। কেননা এটা করলে আমাদের উপর তাদের সন্দেহ হত এবং আমাদের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যেতো। যাবার আগে ক্যাপ্টেন উদ্দিনের (বর্তমানে মেজর) সাথে কথা বলি এবং তাকে অনুরোধ করি আমাদের পরিবারগুলির প্রতি খেয়াল রাখার জন্য এবং পারলে নিরাপদ জায়গায় যেন সরিয়ে দেন। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে সে সময় চট্রগ্রামে নবম বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলী করা হয়েছিলো। আমরা তাকে ক্যান্টনমেন্টে রেখে যাই। ২৭শে মার্চ শত্রুরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে আমাদের পরিবারদের গ্রেফতার করে এবং তাদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। ১০ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে ফেললে শত্রুরা তাদের ছেড়ে দেয়। ২৮শে মার্চ ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের সাথে এসে যোগ দেন।

 

৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আসার জন্য আমি লেঃ কর্নেল খিজির হায়াতকে নির্দেশ দেবার অনুরোধ করি। তিনি আমার কথামত সবাইকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে আসার নির্দেশ দেন। একমাত্র সমশেরণগরে অবস্থিত মেজর খালেদ মোশাররফের বাহিনী ছাড়া সবাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া আসে।

 

২৪শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমসিএ জনাব লুৎফুল হাই আমার সঙ্গে দেখা করে জানতে চান আমরা কি করবো। আমি তাকে বলি, ঠিক সময়ে আমরা আমাদের কর্তব্য সাধন করবো। তিনি চলে যাবার পর আমাদের ব্যাটালিয়নের পাঞ্জাবী অফিসারেরা এসে জিজ্ঞেস করে লুৎফুল হাই কেনো এসেছিলো। আমি তাদের বলি, সে আমার আত্মীয় এবং আমার সাথে এমনি দেখা করতে এসেছে। মিথ্যা বলে তাদের সন্দেহ দূর করি। আমি মেজর শাফায়াত জামিলকে সমস্ত পরিকল্পনার কথা বলি। সেভাবেই তিনি সমস্ত বাঙালি অফিসার, জেসিও এবং এনসিও’দের নিয়ে একটা সভা ডেকে বলেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ- সেহেতু সবাইকে সজাগ এবং প্রস্তুত থাকতে হবে। ২৫শে মার্চ রাতে আমি মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে অয়ারলেসে কথা বলি এবং সমস্ত পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানাই। তিনি বলেন, আমরা সমশেরনগর থেকে আজ রাতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে অগ্রসর হব এবং তোমরা যদি পারো পাঞ্জাবী অফিসারদের গ্রেফতার করো।

 

-(উপরে হলুদ চিহ্নিত ২৫ শে মার্চ তারিখটুকু খালেদ মোশাররফের সাক্ষাৎকারের সাথে কনফ্লিক্ট করে যা এই দলিলেই খালেদ মোশাররফের সাক্ষাৎকারে উল্লিখিত আছে। মূল দলিলের পৃষ্ঠা নাম্বার ৯৯। আমাদের হিসেবে এটা ২৬ শে মার্চ হবে। পড়ে দেখতে পারেন)

 

রাত ২টার সময় লেঃ কর্নেল খিজির খান, মেজর সাদেক নেওয়াজ, লেঃ আমজাদ সাইদ এবং অন্যান্য অবাঙালি সৈনিকদের গ্রেফতার করার পরিকল্পনা নেই। সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। কেননা মেজর সাদেক নেওয়াজ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিএণ্ডবি রেস্ট হাউসে আমার রুমে আমার পাশে ভর্তি করা একটা চাইনিজ স্টেনগান নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসে ছিল।

 

২৬শে মার্চ সকাল সাড়ে ৯টার সময় সভাকক্ষে সমস্ত অফিসারদের ১টা সভা ডাকা হয়। কিন্তু এর আগে ভোর সাড়ে চারটার সময় আমি অয়ারলেস সেটটি ধ্বংস করে দেই কেননা এই অয়ারলেসের মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে কুমিল্লা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের কথাবার্তা হতো। সমস্ত টেলিফোন যোগাযোগও নষ্ট করে দেয়া হয়। আমাকে এটা করতে হয়েছিলো, কেননা অয়ারলেস অপারেটরদের ৩ জনের মধ্যে ২ জনই পাঞ্জাবী ছিলো। অয়ারলেসের মাধ্যমে শেষ যোগাযোগ করি মেজর খালেদ মোশাররফের সাথে। তাকে অনুরোধ করি অতিসত্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য।

 

আমরা সবাই তাঁবুতে এসে জড়ো হই। সাড়ে ৯টার সময় মেজর শাফায়াত, লেঃ কবীর, লেঃ হারুন, আমি ও জেসিও’রা তাবু ঘিরে ফেলি। আমরা বিদ্রোহ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করি এবং মেজর শাফায়াত জামিল তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমরা আর পাকিস্তানী সৈন্য নই, আমরা এখন বাংলাদেশ সরকারের সৈনিক। আপনারা আমাদের বন্দী। পালাবার চেষ্টা করবেন না, করলে মারা যাবেন।” মুহুর্তের মধ্যে সবকিছু ঘটে যায়। ৭২ জন পাকসেনাকে হত্যা ও ৩ জন পাক অফিসারকে গ্রেফতার করে ২৬শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করি।

 

-(উপরে হলুদ চিহ্নিত ২৬ শে মার্চ তারিখটুকু খালেদ মোশাররফের সাক্ষাৎকারের সাথে কনফ্লিক্ট করে যা এই দলিলেই শাফায়েত জামিলের সাক্ষাৎকারে উল্লিখিত আছে। মূল দলিলের পৃষ্ঠা নাম্বার ১৩৩। আমাদের হিসেবে এটা ২৭ শে মার্চ হবে। পড়ে দেখতে পারেন)

 

মেজর খালেদ মোশাররফ এবং লেঃ মাহবুব রাত সাড়ে ১১টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌঁছেন। মেজর খালেদ মোশাররফের হাতে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেতৃত্ব দেয়া হয়। এরপর মেজর খালেদ আমাদের সবাইকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চারপাশে অবস্থান নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ার নির্দেশ দেন, কেননা শত্রুরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া আক্রমণ করে আমাদের ধ্বংস করে দিতে পারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের হেডকোয়ার্টার করা হয়।

 

আমাকে ১৮ জন সৈন্য দিয়ে গোকনঘাটে পাঠানো হয়। ঢাকা থেকে ভীতসন্ত্রস্ত জনতা পালিয়ে আসতে থাকে। আমি ২ দিনের মধ্যে ২৫০ জন পলায়নপর পুলিশ, ইপিআর’দের নিয়ে একটা কোম্পানী তৈরী করে ফেলি। তৃতীয় দিন পাক বিমানবাহিনী ৪টা স্যাবর জেটের সাহায্যে আমার এলাকায় স্ট্রাফিং করতে থাকে। এতে আমার বাহিনীর একজন আহত হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় স্থলপথে কোনো আক্রমণ তখনো শুরু হয় নি।

 

এক সপ্তাহের মধ্যে আমি আমার কোম্পানীকে ৩০৩ রাইফেলের দ্বারা সজ্জিত করে ফেলি। ৫ই এপ্রিল মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকে আমার বাহিনী ক্যাপ্টেন মাহবুবের (পরে শহীদ হন) হাতে দিতে বলেন। তিনি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দেন। তার হাতে দায়িত্ব দিয়ে আমি ৫ই এপ্রিল সকাল ৯টায় অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মেজর মোশাররফের কাছে যাই।

 

মেজর খালেদ মোশাররফ আমাকে বলেন, ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সিলেট থেকে নদীপথে ভৈরব হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে আসছে। সেজন্য ৪র্থ বেঙ্গলের একটা কোম্পানী নিয়ে আজবপুর ঘাটে যাই এবং সন্ধার মধ্যেই পজিশন নিয়ে নেই। এখানে এসে আমি ২য় বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন নাসিমের (বর্তমান লেঃ কর্নেল) সাথে যোগাযোগ করি।, যিনি আশুগঞ্জ এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলেন। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর কাজী মোঃ শফিউল্লাহর নেতৃত্বে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে। ময়মনসিংহ হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে তিনি আমাদের সাথে যোগ দেন। আমরা সে সময় বিরাট এলাকা কোম্পানীগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সিলেটের খোয়াই নদী পর্যন্ত শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন রেখেছিলাম।

 

৭ই এপ্রিলে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। আমি ভেবেছিলাম শত্রুরা বড় নৌকা ও লঞ্চের সাহায্যে পালানোর চেষ্টা করবে। সেহেতু আমি নৌকা তল্লাশি করার নির্দেশ দেই। অতি প্রত্যুষে একটা মটর লঞ্চ আশুগঞ্জের দিকে যাচ্ছিলো। আমি তাদের থামতে বলি। লঞ্চটি না থেমে বরং আরো দ্রুত গতিতে চলতে থাকে। ওর ভিতরে পাঞ্জাবী সেনা আছে ধরে নিয়ে আমরা এমএমজি ও ৭৫ এমএমআর-এর সাহায্যে গুলি ছুঁড়তে থাকি। লঞ্চটি থেমে যায় এবং আশ্চর্যের ব্যাপার লঞ্চটি বেসামরিক ব্যক্তিদের দ্বারা ভর্তি দেখলাম। একজন আহত হয় ও তার প্রাথমিক চিকিৎসা করে সারেংকে সাবধান করে ছেড়ে দেই। এই সময় পাক বিমান আমাদের উপর আকস্মাৎ হামলা শুরু করে দেয়।

 

৩/৪ দিন পর ক্যাপ্টেন মতিন (বর্তমানে মেজর) ১টি কোম্পানী নিয়ে এসে আমাদের অব্যাহতি দেন। আমি আমার বাহিনী নিয়ে তেলিয়াপাড়া যাই। পরবর্তী নির্দেশ দেওয়া হয়। দুইদিন বিবিরবাজারে অবস্থানের পর তৃতীয় দিনে ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানীকে নিয়ে মনতলি যাবার নির্দেশ দেন মেজর খালেদ মোশাররফ।

 

১৪ই এপ্রিল প্রথম সাফল্যজনক আক্রমণ চালাই শত্রুর বিরূদ্ধে। ঐদিন রাতে গঙ্গাসাগরে ৪টা প্লাটুন ও ১টা ৩” মর্টার সেকশনের সাহায্যে শত্রুর অবস্থানকে ঘিরে আক্রমণ চালাই। মেজর খালেদ মোশাররফ মর্টার সেকশনে নেতৃত্ব দেন। তার উপস্থিতি আমার সৈনগযদের মনোবল বাড়িয়ে তোলে। রাত দুইটার সময় শত্রুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৩১ জন শত্রুসৈন্য ও ১৫/২০ জনকে আহত করি। আমরা সবাই নিরাপদে ফিরে আসি। ২ জন সামান্য আহত হয়।

 

চারদিন সেখানে অবস্থানের পর আমাকে কসবা-শালদানদী এলাকায় যেতে বলা হয়। ১৮ই এপ্রিল আমি কসবার পথে রওয়ানা হই এবং সেখানে ঘাটি গড়ে তুলি। গঙ্গাসগরে শত্রুদের মার দেবার পর কসবা-শালদানদীর গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিলো। আমার পৌঁছতে একটু দেড়ি হয়। এর আগেই শত্রুরা কসবা বাজার ও কসবা রেলওয়ে স্টেশনে ঘাঁটি গেড়ে ফেলেছে। আমি আমার ক্যাম্প ইয়াকুবপুর জাতুমুরা এলাকায় স্থাপন করি। আমি রেকি করে বুঝতে পারি আমার অবস্থান খুব একটা সুবিধাজনক নয়। ভারতে আশ্রয় না নিয়ে নিজ অবস্থানে থেকে শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকি। পাক সেনারা কসবা এসে নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধর্ষণ চালাতে থাকে। ইতিমধ্যে হাজার হাজার লোক পাকসেনাদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যাচ্ছিলো।

 

১৮ই এপ্রিল রাতেই আমি কসবা বাজার ও কসবা রেলওয়ে স্টেশন আক্রমণ করার পরিকল্পনা করি। ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে হঠাৎ করে শত্রুদের উপর আক্রমণ শুরু করে দেই। শত্রুরা যেহেতু প্রস্তুত ছিলো না সেহেতু তারা এই আক্রমণে হকচকিত হয়ে পড়ে। এ অপ্রত্যাশিত যুদ্ধ দেড় ঘন্টা ধরে চলে এবং এর সাফল্য অপ্রত্যাশিত ছিলো। শত্রুরা তখনো পর্যন্ত কোনো বাঙ্কার তৈরি করেনি। ফলে তারা গাড়ি বোঝাই অস্ত্র ফেলে রেখে বাজারের কুঁড়েঘরে এবং দোকানে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

 

রাত সাড়ে চারটাকে আবার আক্রমণ করার সময় হিসেবে বেছে নেই। আমি একটা লম্বা গাছের উপর উঠে শত্রুদের অবস্থান দেখে নেই এবং আমার সৈন্যদের প্লাটুনে ভাগ করে তিন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলি। একটি মাত্র পথ শত্রুদের জন্য খোলা থাকে। ৩.৫ ইঞ্চি রকেট লাঞ্চার এবং ছোট অস্ত্র ও মর্টারের সাহায্যে শত্রুদের উপর গোলাগুলি ছুড়তে থাকি। এই গোলাবর্ষণের ফলে শত্রুদের ৭টা গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। ৪৫/৫০ জন নিহত হয় এবং ৭০/৮০ জন আহত হয়। শত্রুরা এ আকস্মিক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে কসবা ছেড়ে আড়াইবাড়ি কুটির দিকে পালিয়ে যায় এবং সেখানে গিয়ে অবস্থান নেয়। যাবার সময় তারা বিধ্বস্ত গাড়ি ও অনেক মৃতদেহ ফেলে রেখে যায়।

 

এ যুদ্ধ জয়ের ফলে আমাদের সৈন্যদের মনোবল অনেক বেড়ে যায়। কসবা নতুন বাজার দখল করার পর আমার হেডকোয়ার্টার কসবাতেই স্থাপন করি। অবশ্য আমি জানতাম, শত্রুরা কসবা দখল করার জন্য আবার বিপুল শক্তি সঞ্চয় করে আমাদের উপর আক্রমণ চালাবে।

 

জুন মাসে মেজর খালেদের নির্দেশে মুন্সিরহাট, ফেনী, নোয়াখালী এলাকায় যাই। যাবার পূর্ব পর্যন্ত তারা কসবা দখল করতে সক্ষম হয়নি। এই ব্যাপক বিপর্যয়ের পর শত্রুসেনারা স্থানীয় দালালদের সহযোগীতা ছাড়া বাংকার থেকে বের হতো না।

Scroll to Top