<৯, ২.৮, ৮৮-৯৫>
চট্টগ্রামের প্রতিরোধ যুদ্ধঃ
সাক্ষাৎকারঃ লেঃ জেনারেল (অবঃ) মীর শওকত আলী বীর উত্তম
(১৯৭১ সালের মার্চের মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি শামসুল হুদা চৌধুরী রচিত ‘একাত্তরের রণাঙ্গন’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)
প্রঃ কখন কিভাবে আপনি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন?
উঃ ১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাসে কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে আমাকে চট্টগ্রামের ষোলশহরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে পোস্টিং দিয়ে পাঠানো হয়। মার্চ ৭১ এর প্রথম ভাগে আমি ছুটিতে ছিলাম। ১৫ই মার্চ এর দিকে যখন অসহযোগ আন্দোলন খুব জোরদার হচ্ছিল এবং ইতিপূর্বে ৭ই মার্চ ৭১ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিলেন, তখন থেকেই আমরা বাঙালি সৈন্যরা চিন্তা করছিলাম যে একটা গণ্ডগোল বাধাবে এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। চট্টগ্রামের ষোলশহরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন তখন কর্ণেল জানজুয়া। মেজর জিয়াউর রহমান (পরবর্তীকালে লেঃ জেনারেল এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি ছিলেন এই ব্যাটালিয়ানের সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড। জেনারেল জিয়া এবং আমি ছাড়াও ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে আরো কয়েকজন বাঙালি অফিসার ছিলেন। ১৫ই মার্চ’ ৭১ এর দিকে আমি এই ব্যাটালিয়ানে যোগদান করি। ২৫শে মার্চ’ ৭১ রাতে যখন হত্যাকাণ্ড শুরু হয়, তখন স্বভাবতই আমি বাঙালি হিসেবে আমার যা কর্তব্য সেটাই করেছি। এতে জড়িয়ে পড়ার মত কিছুই নেই। একটা কর্তব্য ছিল। সমস্ত বাঙালি সৈন্যরই কর্তব্য ছিল এটা। সবাই এতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিছু কিছু সৈন্য হয়তো সুযোগ পান নি কিংবা কিছু সংখ্যক সৈন্য আগেই ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। আমাদের যেহেতু বাঙালি ব্যাটালিয়ান ছিল সেই জন্য আমরা ধরা পড়ি নি।আমরা আমাদের কর্তব্য করেছি মাত্র। ২৫শে মার্চ, ’৭১ রাতে যখন জেনারেল জিয়াকে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে পাঠানো হলো মূলত সেই সময় থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের পক্ষ থেকে শুরু হয়।
উক্ত দূর্যোগের রাত প্রায় ১১-৩০ মিনিট সময়ে আমরা টেলিফোনে জানতে পারলাম যে ঢাকায় হত্যাকাণ্ড শুরু হয়ে গিয়েছে। স্বভাবতঃই আমরা ধরে নিলাম ঢাকায় যখন হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে, নিশ্চয় এটা সারা বাংলাদেশব্যাপী শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ সেনাবাহিনী তো মাত্র এক জায়গায় তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করেনা; এ জাতীয় পরিকল্পনা সব জায়গাতেই একই সময়ে কার্যকর করাই স্বাভাবিক। আমাদের কর্তব্য আমরা আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। কারণ ২৫শে মার্চের আগে থেকেই আন্দোলন যে রুপ নিচ্ছিল, সে সবে যখনই আমাদের নিযুক্ত করা হতো ব্যারিকেড সরানোর জন্য কিংবা জনগণকে হটানোর জন্য, তখন আমরা তাদের বিরুদ্ধে কাজ কখনো ঠিকমতো করতাম না। কার্যত আমরা সেই চূড়ান্ত অসহযোগের সময় থেকেই আন্দোলনের প্রতি আমাদের সমর্থন জানাতে শুরু করি। কাজেই ২৫শে মার্চ ৭১ রাতে যখন হানাদার বাহিনী বাঙালি হত্যাকান্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন আমাদেরও তাৎক্ষণকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া বাদে অন্য কোনও বিকল্প ছিল না।
বাঙালি হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার খবর দিয়ে সম্ভবত আমাদের কাছে প্রথম টেলিফোন করেছিলেন চট্টগ্রামের হান্নান ভাই (চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি)। সম্ভবত তিনিই চট্টগ্রামে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।
আগেই বলেছি, জেনারেল জিয়া এবং আমি একই ব্যাটালিয়নে ছিলাম। তিনি যেহেতু আমার চাইতে সিনিয়র ছিলেন, সেহেতু তিনিই আমাদের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমি তার দুনম্বর হিসেবে কাজ করেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা পর্যায়ে আমরা যে একই ব্যাটালিয়নে ছিলাম, এটা অনেকেই হয়তো জানেন না। বেশীরভাগ জনসাধারণের ধারণা আমরা আলাদা ছিলাম। আমরা একই সঙ্গে ছিলাম এবং একই সঙ্গেই বিদ্রোহ করেছিলাম। জেনারেল জিয়াউর রহমানও তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেনঃ “আমি বিদ্রোহ করে পোর্ট থেকে ফিরে এসেই শওকতের কাছে এলাম, এবং শওকত আমার সাথে হাত মিলালো।”
প্রঃ এই যে দুঃসাহসিক কাজ আপনারা করলেন, এর পিছনে অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি সৈন্যদেরও পূর্ণ সমর্থন ছিল এবং তারাও আপনাদের মত এগিয়ে আসছিলেন, এটা আপনারা বুঝেছিলেন কি?
উঃ এটা আমি বলতে পারবো না। কারণ রাজনীতিতে আমি কখনো জড়াতাম না। কিন্তু এটা রাজনীতি ছিল না। এটা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ। এতে জাতির জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িতে হয়ে পড়েছিলো। তাছাড়া অন্যান্য সেক্টর থেকে বাঙালি সৈন্যরা এগুচ্ছিলেন কি না সে তথ্য আমাদের জানার উপায় ছিল না। সে তথ্য জানা না জানার গুরুত্ব দেয়ার সময়ও তখন আমাদের ছিল না। এমনকি তখন আমার বাবা মা ছিলেন আমার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েকে নিয়ে কুমিল্লায়। তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে চিন্তা করার অবকাশও তখন আমাদের ছিল না। কাজেই তাৎক্ষনিকভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমরা আমাদের কর্তব্য করেছি মাত্র। অবশ্য আমরা ভেবেছি অন্য সবাইও হয়তো আমাদের মত এগিয়ে আসছিলেন। শুধু ক্যান্টনমেন্টেই নয়, আমরা মনে করেছি সমস্ত বাঙালিই এই যুদ্ধে ছিলেন। কারণ এটা ছিল বাঙালি জাতির প্রশ্ন, বাঙালি জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন।
প্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা বেতারে কখন প্রচারিত হয়েছে বলে আপনি বলতে চান?
উঃ এটা একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণা যেটা নিয়ে সব সময় বিতর্ক চলতে থাকে যে জেনারেল জিয়া করেছেন, না আওয়ামী লীগ করেছেন। আমার জানামতে সবচাইতে প্রথম বোধ হয় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান ভাইয়ের কণ্ঠ থেকেই লোকে প্রথম শুনেছিলেন। এটা ২৬শে মার্চ’ ৭১ অপরাহ্ন দু’টার দিকে হতে পারে। কিন্তু যেহেতু চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের প্রেরক যন্ত্র খুব কম শক্তিসম্পন্ন ছিল, সেহেতু পুরা দেশবাসী সে কণ্ঠ শুনতে পান নি। কাজেই যদি বলা হয়, প্রথম বেতারে কার বিদ্রোহী কণ্ঠে স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়েছিল, তাহলে আমি বলব যে, চট্টগ্রামের হান্নান ভাই সেই বিদ্রোহী কণ্ঠ। তবে এটা সত্য যে পরদিন অর্থাৎ ২৭শে মার্চ ৭১ মেজর জিয়ার ঘোষণা প্রচারের পরই স্বাধীনতা যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়।
প্রঃ ২৭শে মার্চ ৭১ মেজর জিয়াউর রহমান কি পরিস্থিতিতে কালুরঘাট ট্রানসমিটারে সংগঠিত বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গেলেন এবং স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করলেন?
উঃ ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় হত্যাকান্ডের খবর পাওয়ার পরই আমরা চট্টগ্রামে আমাদের অধীনস্থ সমস্ত ব্যাটালিয়নকে হাতে নিয়েছিলাম। আমরা ভেবে দেখলাম যে, নতুন পাড়া ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ট্যাংক ছিল। আমরা ছিলাম ষোলশহরে মাত্র দু’মাইল দূরত্বে। আমরা দেখলাম, আমাদের হাতে কোন ও ট্যাংক ছিল না। এবং কোন অস্ত্রশস্ত্র ও আমাদের অর্থাৎ ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাতে ছিল না। ইতি পূর্বেই ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তান চলে যাবে বলে অধিকাংশ অস্ত্রই পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমাদের হাতে শুধু ছিল কিছু রাইফেল এবং এল এম জি ধরনের স্বল্প সংখ্যক অস্ত্র। ভারী কোন ও অস্ত্র ছিল না। আমার সাথেই জেনারেল জিয়া আলাপ করলেন। আমরা আলাপ করে দেখলাম যে আমরা যদি ষোলশহর বিল্ডিং এর ভিতর অবস্থান করি এবং এই অবস্থায় যদি ট্যাংক আসে, তাহলে আমরা ট্যাংক ঠেকাতে পারব না। কারণ ট্যাংক ঠেকানোর মত কোন অস্ত্র ই আমাদের হাতে ছিল না। ট্যাংক থেকে দু তিনটা গোলা ছুড়লেই আমাদের অনেক সৈন্য মারা যাবে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমাদের ঐ এলাকা থেকে বাইরে চলে যাওয়া উচিত এবং নিরাপদ দূরত্বে থেকে হেডকোয়ার্টার বেস বানানো উচিত। এ ছাড়া আমাদের অধীনস্থ জোয়ানদের শপথ নেয়া উচিত। শপথ নিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে তারপর যুদ্ধে যাওয়া উচিত। আমরা সোজা প্রথমে গেলাম কালুরঘাট। সেখানে ভোররাতের দিকে আমরা মার্চ করে গেলাম। তখন খুব কুয়াশা ছিলো এবং আল্লাহর কি ইচ্ছা সেদিন অর্থাৎ ২৬শে মার্চ’ ৭১ এর সকাল ৮টা কি ৯টা পর্যন্ত কুয়াশা ছিল। কালুরঘাটে পৌঁছে আমরা সবাই কনফারেন্স করলাম। এতে কিছু বিডিআর অফিসার এবং জোয়ানও ছিলেন। এই কনফারেনসে সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে, আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে চট্টগ্রাম রক্ষার জন্যে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাব। আমাদের আক্রমণের মূল লক্ষবস্তু ছিল পোর্ট এবং ক্যান্টনমেন্ট। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আওয়ামী লীগের কিছু নেতৃবৃন্দ আমাদের সাথে এসে যোগ দিয়েছিলেন। এই তো গেল ২৬শে মার্চ ‘৭১ এর কথা। ঐদিন আমরা খোজখবর নিয়েছিলাম কোথায় কি ঘটেছিলো। আমি একখানা জীপ নিয়ে পুরা শহর ঘুরে দেখলাম। আমি টহল দেয়ার সময় আগ্রাবাদের মোড়ে আমার জীপের ওপর একটি এল.এম.জি বার্স্ট ফায়ার এলো। আমি কোনও প্রকারে জীপ ঘুরিয়ে ফেরত গেলাম এবং জেনারেল জিয়াকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করলাম এবং সেভাবে আমাদের দলকে নিয়োজিত করলাম।
২৭শে মার্চ’ ৭১ মনে হয় জেনারেল জিয়া বুঝতে শুরু করলেন যে বেতারে একটা ঘোষণা প্রচার করা দরকার। ঐ তারিখেই সন্ধ্যায় কালুরঘাট ট্রানসমিটার থেকে এটা করলেন তিনি। বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাও ঐ সময় খুব তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর নুরুল ইসলাম, আতাউর রহমান খান কায়সার, হান্নান ভাই এবং এম আর সিদ্দিকী। তারাও সম্ভবতঃ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কিছু প্রচারিত হওয়া উচিত। অপরদিকে জেনারেল জিয়া কি বলবেন তার একটি খসড়াও প্রস্তুত করে নিলেন। ২৭শে মার্চ ৭১ সন্ধ্যার পর চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে প্রচারিত হল জেনারেল জিয়ার (তৎকালীন মেজর) ভাষণ।
প্রঃ আপনার কমান্ডে সবচাইতে ভয়াবহ যুদ্ধ কোথায় এবং কখন সংঘঠিত হয়েছিল?
উঃ প্রথম ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছিল কালুরঘাটে ১১ই এপ্রিল’ ৭১। ঐ সময় জেনারেল জিয়া আমার সাথে ছিলেন না। তিনি ৩০শে মার্চ’ ৭১ এর পর ই রামগড় চলে গিয়েছিলেন।
এই যুদ্ধ পরিচালনা আমার কমান্ডে হয়। সৈন্য ছিলেন অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট বি ডি আর এবং স্থানীয় কিছু স্বেচ্ছাসেবী যেমন ছাত্র, শ্রমিক এবং অন্যান্য যারা অস্ত্র সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন এমন কিছু লোকজন। আমার পক্ষে ছিল পাকিস্তান বাহিনীর দুটি ব্রিগেড।এ ছাড়া কর্ণফুলীতে তাদের যে নৌ জাহাজ ছিল সেটি তারা শংখ নদী হয়ে কালুরঘাটের কাছাকাছি নিয়ে এসে ওখান থেকে নেভাল গান দিয়ে আমাদের এলাকায় বম্বিং শুরু করে দিয়েছিল। তাদের ব্রিগেডের যে আর্টিলারী ছিল সেই আর্টিলারী দিয়েও তারা বম্বিং করতে থাকে ১০ই এপ্রিল ‘৭১ থেকে। ১১ই এপ্রিল তাদের কিছু সৈন্য মহিলার পোশাক এবং কিছু সৈন্য সিভিল এর পোশাক পরে জয়বাংলা বলতে বলতে আমাদের দিকে অর্থাৎ কালুরঘাটের পুলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। চট্টগ্রামে আমাদের পক্ষে এবং তাদের বিপরীতে ছিলেন ক্যাপ্টেন হারুন, শমসের মবিন চৌধুরী, লেঃ মাহফুজ এবং অন্য কয়েকজন অফিসার। এই অবস্থায় আমাদের লোকজন প্রথমে বুঝতে পারেন নি তারা পাকিস্তানী। যখন শত্রু জয়বাংলা বলতে বলতে একেবারে কালুরঘাটের পুলের ওপর চলে এলো, তখনই মাত্র আমাদের লোকজন বুঝতে পারলেন যেতারা সিভিলিয়ান বা মহিলা কেউ নন। তখন আমাদের পক্ষ ফায়ার করতে শুরু করলেন। শত্রুপক্ষের গোলার আঘাতে ক্যাপ্টেন হারুন এবং শমসের মবিন আহত হলেন। মাহফুজ চলে আসতে পেরেছিলেন। কালুরঘাট ছেড়ে আমরা পটিয়ার দিকে চলে এলাম।
প্রঃ তখন আপনারা মোট কতজন ছিলেন?
উঃ আমরা প্রায় সাড়ে তিনশর মত ছিলাম। এই যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ব্রিগেডিয়ার মিঠঠা খান হেলিকপ্টার থেকে ওদের পক্ষে এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল (পরে জেনেছি)
প্রঃ এই যুদ্ধে আপনাদের প্রধান অস্ত্র কি ছিল?
উঃ আমাদের কিছু রাইফেল ছিল, কিছু এল এম জি এবং দুটি তিন ইঞ্চি মর্টার ছিল। এই মর্টার দু’টির কোন অবলোকন ব্যবস্থা (Aiming Sight) ছিল না। আন্দাজে ছুঁড়তে হত।
প্রঃ আপনাদের পক্ষে হতাহত কেমন হয়েছে?
উঃ আমাদের পক্ষে তেমন হতাহত হয় নি, ওদের পক্ষে কতজন হতাহত হয়েছিল তাও বলা মুসকিল, তবে সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। ইতিপূর্বে ৮ই এপ্রিল আর একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তখন পাকবাহিনীর একটি দল কালুরঘাটের প্রায় এক মাইল উত্তরে একটি কৃষি ভবন দখল করে নিয়েছিল। পাকবাহিনীর শক্তি ছিল একটি প্লাটুন। পাকসেনারা ওখানে এসে পড়ায় শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত আমাদের সৈন্যের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমি কয়েকজন অফিসারকে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যুহের ওপর আক্রমণ চালাবার জন্য বললে কেউ তখন এগুতে উৎসাহিত হলেননা। তবে আমার কথা মোতাবেক লেঃ শমসের মবিন চৌধুরী কিছু সৈন্য নিয়ে আক্রমন পরিচালনা করেছিলেন, কিন্তু কৃতকার্য হতে পারেননি। উপরন্তু এই আক্রমণ পরিচালনাকালে নায়েক নায়েব আলী পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। এমনি আমি নিজে মাত্র ১০ জন সৈন্য নিয়ে ৯ই এপ্রিল হাওলাদার হামদু মিঞা, নায়েক তাহের এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন বি ডি আর সহ সকাল ৮:৩০ মিঃ সময়ে কৃষি ভবনে অবস্থানরত পাক ঘাটি আক্রমণ করি। আমার আক্রমণে প্রায় ২০ জন পাকসেনা (১জন ক্যাপ্টেন ও ১জন সুবেদারসহ) নিহত হয় এবং তারা ঐ পোস্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়।
প্রঃ তারপর?
উঃ তারপর আমি কালুরঘাট ব্রীজের চট্টগ্রামের দিক পুনর্দখল করেছিলাম। ১০ই এপ্রিল ৭১ খবর পেলাম পাক সেনাবাহিনী পটিয়ার কালাপুলের দিক থেকে আমাদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করছে। আমি তখনই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীকে কিছু সৈন্য দিয়ে পটিয়ার কালাপুলে পাঠালাম। ১১ই এপ্রিল ভোরবেলা আমি নিজে পটিয়ায় কালাপুলের অবস্থা জানতে পেলাম। ঐ তারিখ সকাল ৮-৩০ মিঃ সময়ে ক্যাপ্টেন ওয়ালি আমাকে খবর পাঠালেন পাক সেনারা প্রায় সাত থেকে আটশত সৈন্য নিয়ে কালুরঘাট আক্রমন করেছে; ক্যাপ্টেন হারুন গুরুতররুপে আহত, লেঃ শমসের মবিন চৌধুরীর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। এ সংবাদ পেয়ে আমি ওয়ালিকে বললামঃ “আমাদের লোকদের একত্রিত করবার চেষ্টা কর, পরিস্থিতি ভালভাবে জেনে নাও, আমি আসছি”. সকাল ৯টার দিকে আমি কালুরঘাটে এসে পৌঁছাই। ওখানে গিয়ে আমি মেজর জিয়ার সাথে অয়ারলেসে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম।
পরে আমি তাদের সবাইকে পিছনে সরে আসতে বললাম। লেঃ মাহফুজকে মদনঘাট ডিফেনসে অবস্থান করতে বললাম যতক্ষণ না আমার কালুরঘাটের ডিফেনসের সবাই পিছু হটতে পারে। আমরা সবাই কালুরঘাট থেকে পটিয়াতে একত্রিত হলাম। এবং সেখান থেকে সবাই বান্দরবন রওনা হই। আমার সাথে সৈন্য ছিল প্রায় ৪৫০ জন (তৎকালীন ইপিআর পুলিশ এবং বেঙ্গল রেজিমেন্ট সহ)।
আমরা ১২ই এপ্রিল বান্দরবান পৌঁছেছিলাম। ঐ তারিখেই কাপ্তাই হয়ে রাঙ্গামাটি পৌঁছি। রাঙ্গামাটিতে আমরা ডিফেনস নেবার পর মহালছড়িতে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলাম। লেঃ জেনারেল মাহফুজ শত্রুর ওপর আঘাত হেনে চলেছিল। কিন্তু পাকবাহিনীর ব্যাপক আক্রমনে টিকে থাকা দুরুহ বুঝে পার্শবর্তী নোয়াপাড়া নামক স্থানে ডিফেনস নেয়। সেখান থেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে সার্থকভাবে ডিফেনস নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করলেন। শেষ পর্যন্ত আমার নির্দেশ ১৪ই এপ্রিল লেঃ মাহফুজ তার ২০০ এর বেশি কিছু সৈন্য নিয়ে মহালছড়িতে আমার সঙ্গে মিলিত হন। ছুটি ভোগরত ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের (আর্টিলারী) আমার কাছে ঐ তারিখে আসেন। বঙ্গ সন্তান সাহসী বীর ক্যাপ্টেন কাদেরকে মেজর জিয়া আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাকে আমার সৈন্যদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অফিসারের নেতৃত্বে ডিফেন্স নিতে পাঠালাম।
আমার রক্ষাব্যুহকে যেসব স্থানে অবস্থান দিলাম সেগুলি ছিলঃ
১) ক্যাপ্টেন আফতাব কাদেরের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ সৈনি রাঙ্গামাটির খাগড়াতে।
২) ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে ১০০ সৈন্য রাঙ্গামাটির মধ্যস্থলে বুড়িঘাটে।
৩) লেঃ মাহফুজের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ সৈন্য রাঙ্গামাটির বরকলের মধ্যস্থলে।
৪) সুবেদার মুত্তালিবের নেতৃত্বে প্রায় ১০০ সৈন্য রাঙ্গামাটির কুতুবছড়ি এলাকাতে।
অপরদিকে ১৫ই এপ্রিল পাকবাহিনী রাঙ্গামাটি শহরে পৌঁছে যায়। রাজা ত্রিদিব রায় পাকবাহিনীকে আহবান করে আনলেন।
১৬ই এপ্রিল এর মধ্যে আমাদের সবাই নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান নিলেন। ক্যাপ্টেন ওয়ালিকে মেজর জিয়ার নির্দেশানুযায়ী রামগড় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ঐদিন ক্যাপ্টেন কাদের তার বাহিনী নিয়ে খাগড়া রেস্ট হাউজে কজন অফিসারসহ এক প্লাটুন পাকবাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে ক্যাপ্টেন কাদের পাকবাহিনীর অফিসারসহ প্রায় ২০ জন সৈন্যকে নিহত করতে সমর্থ হন। বাকী সৈন্য পালিয়ে যায়। অপরদিকে আমাদের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কোন ও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ক্যাপ্টেন কাদের নিরাপদে তার ঘাটিতে ফিরে আসেন। ১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনীর প্রায় ২০ জন সৈন্য একটি লঞ্চযোগে রেকি করতে বেরিয়েছিল। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ওত পেতে ছিলেন। কিছুক্ষণ পরই পাকসেনারা বুঝতে পেরেছিল যে তারা মুক্তিবাহিনীর রক্ষাব্যুহের কাছাকাছি চলে এসেছে। পাকসেনারা গুলি ছোড়া শুরু করে। কিন্তু ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তবুও চুপ করেছিলেন। সম্পূর্ণ লঞ্চটি তার এলাকায় চলে আসা মাত্র তিনি গুলি চালানো শুরু করলেন। এতে লঞ্চসহ অধিকাংশ পাকবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়। কয়েকজন পালাতে সমর্থ হয়েছিল। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ২জন মাত্র আহত হয়েছিলেন।
১৮ই এপ্রিল পাকসেনারা দুটি লঞ্চ ও একটি স্পিডবোটে সৈন্য নিয়ে চিঙ্গী নদী দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। লেঃ মাহফুজের কিছু সৈন্য হঠাৎ গুলি ছুড়ে বসলেন।
পাকসেনারা কিছু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে দূরে গিয়ে ডিফেন্স নিয়ে লেঃ মাহফুজের ওপর আর্টিলারী আঘাত হানতে থাকে। উভয় পক্ষের সংঘর্ষে লেঃ মাহফুজের কোন ক্ষতি হয়নি। তবে, পাক সেনাদের কিছু ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তাদের চাপ আমাদের ওপর ক্রমে বাড়তে থাকে।
১৮ই এপ্রিল বিকেল ৩ টায় সুবেদার মুত্তালিব তাঁর দল নিয়ে কুতুবছড়িতে পাকবাহিনীর ৬টি চলমান সৈন্যভর্তি ট্রাকের উপর এমবুশ করে। এই এমবুশে ৩০ থেকে ৪০ জন পাকসেনা নিহত ও দুই-তিনটি গাড়ী ধ্বংস হয়।
১৯শে এপ্রিল ৩ টায় পাকসেনাদের একটি বড় রকমের দল ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর ওপর বুড়িঘাটে ব্যাপকভাবে আক্রমন করে। পাকসেনারা ঐ সময় একটি জীপ থেকে তিনটি মর্টার ছুড়েছিল। তাদের বাহিনী ব্যাপকভাবে আক্রমন চালিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। এমনি পরিস্থিতিতে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান কিছুতেই থাকতে পারছিলেন না। তখন ল্যান্স নায়েক মুনসী আবদুর রব (৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট) অটোমেটিক হাতিয়ার মেশিনগান হাতে তুলে নিয়ে বললেনঃ ‘আমি গুলি চালিয়ে যাচ্ছি আপনি বাকী সৈন্যদের নিয়ে পিছু হটে যান।’ ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান প্রায় ১০০ মুক্তিবাহিনী নিয়ে নিরাপদে পিছু হটলেন। কিন্তু ল্যানস নায়েক মুনসী আবদুর রব পাকবাহিনীর শেলের আঘাতে প্রাণ হারালেন। সেদিন মুনসী আবদুর রব মুনসীকে সরকার বীর শ্রেষ্ঠ উপাধি দিয়েছিলেন। ২০শে এপ্রিল লেঃ জেনারেল মাহফুজ ঐ স্থানে যান এবংমুনসীর ছিন্ন দেহের অংশবিশেষ এবং কিছু গোলাবারুদ নিয়ে ঘাটিতে ফিরে আসেন।
ঐ দিনই আমি লেঃ মাহফুজকে বরকলে পাঠিয়েছিলাম মিজো উপজাতিকে আমাদের স্বার্থে কাজ করার পক্ষে মত বিনিময়ের জন্য। লেঃ মাহফুজ বহু কষ্টে সুবলম পর্যন্ত পৌঁছে খবর পেলেন যে, পাকিস্তানীরা মিজোদের ইতিমধ্যেই হাত করে নিয়েছে। আমি আরো খবর পেলাম পাকবাহিনী মিজোদের নিয়ে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ২১শে এপ্রিল পাকবাহিনীর একটি কোম্পানী বন্দুকভাঙ্গা নামক স্থানে লেঃ মাহফুজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংঘর্ষে পাকসেনারা পিছু হটে চলে যায়। আমাদের কোন ক্ষতি হয় নি।
২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনীর প্রায় ২০০ সৈন্য রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমি ক্যাপ্টেন কাদের এবং লেঃ মাহফুজকে পাঠালাম প্রতিরোধ করার জন্য। ২৪শে এপ্রিল কুতুবছড়ি নামক স্থানে অফিসারদ্বয় পাকবাহিনীর মুখোমুখি হন। এই যুদ্ধে পাকবাহিনী বেশ কিছু ক্ষতি স্বীকার করে।
২৫শে এপ্রিল খবর পেলাম চিঙ্গী নদী এবং নার্নিয়ার চর বাজার হয়ে পাকবাহিনী মহালছড়ি অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে। মহালছড়ি আমাদের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার ছিল।
২৬শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন কাদের, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ও লেঃ মাহফুজকে কিছুটা পিছিয়ে যেতে বললাম। ঐ তারিখেই ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে নানিয়াচর বাজারে বড় পাহাড়ের ওপর ডিফেনস নিতে বলেছিলাম। কারণ ঐ পথই পাক সেনাদের অগ্রসর হওয়ার সম্ভাব্য এলাকা ছিল। লেঃ মাহফুজকে ডিফেনসে রাখলাম রিজার্ভে পাল্টা আক্রমনের জন্য এবং প্রয়োজনে ক্যাপ্টেন জামানকে সাহায্যের জন্য। ক্যাপ্টেন কাদেরকে পাঠালাম সড়ক পথে পাকবাহিনীর গতিপথ রুদ্ধ করার জন্য।
২৫শে এপ্রিল ভোরবেলা হাবিলদার তাহের সিপাহী বারী এবং করপোরাল করিমের সঙ্গে ৮/১০ জনলোক দিয়ে রেকি পেট্রোলে পাঠালাম। এই দলটি ভুলবশতঃ মিজোদের আড্ডায় ঢুকে পড়েছিল। সৌভাগ্যবশত মিজোরা তখন একটি হাতি কেটে খাওয়াতে ব্যস্ত ছিল। রেকি পার্টি পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। আমাদের দলটি পরে হেডকোয়ার্টার মহালছড়িতে পৌঁছে। ঐ তারিখ বেলা ১২ঃ৩০ মিঃ সময়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর অবস্থানের ওপর মিজোরা আক্রমন চালিয়েছিল। ফলে উভয় পক্ষে সংঘর্ষ বেধে যায়। আক্রমনের চাপ বাড়তে থাকে মিজোদের পক্ষ থেকে। মিজোরা সংখ্যায় ছিল অনেক। এই অবস্থায় আমি লেঃ মাহফুজকে প্রায় ১০ জন সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের সাহায্যে পাঠিয়েছিলাম। লেঃ মাহিফুজ ওখানে পৌঁছেই ডিফেনস নিয়ে লক্ষস্থলে আক্রমন চালাতে থাকে। কিন্তু ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তার সাথীদের গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় ভিন্ন ভিন্ন পথে পিছু হটে আসেন। আধ ঘন্টা গুলি বিনিময়ে লেঃ মাহফুজ ১৫০ জন মিজোকে হত্যা করেছিল। কিন্তু অপর পক্ষে সব বাধাকে অগ্রাহ্য করে অসংখ্য মিজো সমুদ্রের ঢেউয়ের মত সামনের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। লেঃ মাহফুজকে মিজোরা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন কাদের এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান লেঃ মাহফুজকে উদ্ধার করে আনার জন্য অগ্রসর হলেন। আমরা তখন হেডকোয়ার্টারের চারপাশে ডিফেনস পাকা করছিলাম। এমনি পরিস্থিতিতে ২৭শে এপ্রিল অপরাহ্ণ ৩টায় পাকবাহিনীর ১১ এবং পাঞ্জাবের ২টি কোম্পানী সহযোগে প্রায় এগার শত মিজো ব্যাপকভাবে আমাদের ওপর আক্রমন চালায়। পাকবাহিনী ৬টি মর্টার দিয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। আমি ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন কাদের, ফারুক প্রমুখকে এলাকা ভাগ করে দিয়ে মহালছড়ি হেডকোয়ার্টার রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। পাকসেনারা মিজোদের নিয়ে ক্রমাগত অগ্রসর হতে থাকে আধুনিক মারনাস্ত্র নিয়ে। অথচ আক্রমন প্রতিহত করার জন্য উপযোগী কোনই ভারী মর্টার আমার কাছে ছিলনা। মাত্র থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও সামান্য হালকা মেশিনগান দিয়ে আক্রমন চালালাম। ক্যাপ্টেন কাদের তার এলাকাতে যুদ্ধ করতে করতে শত্রুর গুলিতে শহীদ হলেন। বৃষ্টির মতো গুলির মধ্যে শওকত, ফারুক ও সিপাহী ড্রাইভার আব্বাস গাড়িতে ক্যাপ্টেন কাদেরের মৃতদেহ নিয়ে রামগড় ফিরে এলেন। ক্যাপ্টেন কাদেরের মৃতদেহ রামগড় রেখে বাকী সৈন্যরা আমার কাছে চলে আসেন। আমরা তখন এমনি এক অবস্থায় ছিলাম যখন আমার সমস্ত বাহিনী নিয়ে ঐ পরিস্থিতিতে পিছু হটা সিম্ভব ছিল না। তাই সন্ধ্যা পর্যন্ত আক্রমন চালিয়ে যেতে হয়েছিল। ঐ তারিখে রাতের আধারে মহালছড়ি ছেড়ে সমস্ত সৈন্য নিয়ে আমরা খাগড়াছড়ি নামক স্থানে এসে পৌঁছলাম এবং ডিফেন্স নিলাম।
২৮শে এপ্রিল খাগড়াছড়ি থেকে আমি মেজর জিয়ার সাথে অয়ারলেসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আমাদের অবস্থার কথা বর্ণনা করলাম। ঐদিন পাকবাহিনীর একটি দল আমাদের অবস্থান দেখে গুইমারা হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হিচ্ছিল। আমি আমার বাহিনী নিয়ে গুইমারাতে ডিফেন্স নিলাম। আমাদের তখন শক্তি ছিল প্রায় ৪৫০ জন। আমি মানিকছড়ির রাজার সঙ্গে দেখা করলাম। রাজা আমাদের সাথে যোগ দিলেন। তিনি আমার সাথে বিশদ আলোচনা করে মগদের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করবেন বলে জানালেন। রাজা পাকিস্তানীদের খবরাখবর দিলেন। সমগ্র মগ উপজাতি আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। চাকমা উপজাতিদেরও হয়তো আমাদের সাহায্যে পেতাম। কিন্তু রাজা ত্রিদিব রায়ের বিরোধিতার জন্য তারা আমাদের বিপক্ষে চলে যায়। মিজোরা বেশ কিছু আগেই আমাদের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের ন’মাস মগ উপজাতি আমাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে।
২৯শে এপ্রিল রাতে মেজর জিয়া আমাদের রামগড়ে চলে আসতে বললেন। কারণ ইতিমধ্যে পাকবাহিনীর একটি দল করেরহাট-হিয়াকুল হয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। অপর দল শুভপুর ব্রীজে ক্রমাগত আঘাত হানছিলি। আর একটি দল আমাদের পিছু পিছু আসছিল গুইমারা রামগড়ের পথে। মেজর জিয়া করেরহাটে ক্যাপ্টেন ওয়ালীকে পাঠালেন এবং আমাদের চলে আসতে বললেন। আমরা ২৯শে এপ্রিল র ওয়ানা হয়ে রাত ২টায় সমস্ত সৈন্য নিয়ে রামগড়ে পৌঁছলাম। ৩০শে এপ্রিল মুক্তিবাহিবীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল (পরবর্তীকালে জেনারেল) এম, এ, জি ওসমানী রামগড়ে আমাদের দেখে গেলেন এবং চট্টগ্রামের সমস্ত খবরাখবর নিলেন। কর্নেল ওসমানী খুবই খুশী হলেন। আমাকে নির্দেশ দিলেন যে কোন প্রকারেই অন্ততঃ আরো দু’দিন রামগড়কে মুক্ত রাখার জন্য, যাতে করে নিরীহ জনতাসহ সবাই নিরাপদে ভারতে আশ্রয় নিতে পারি।
আমি, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, সুবেদার মুত্তালেব এবং লেঃ মাহফুজকে তাদের বাহিনী নিয়ে ক্যাপ্টেন ওয়ালীর সাহায্যার্থে হিয়াকুলে পাঠালাম পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে। উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। পাকবাহিনীর একটি ব্রিগেড তিন দিক থেকে রামগড় আক্রমন করে। ২রা মে আমাদের রামগড় হারাতে হয়। ঐদিনই আমরা সবাই ভারতের সাবরুমে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। সময় তখন সন্ধ্যা ৬টা।