(১) চট্টগ্রামের সশস্ত্র প্রতিরোধসাক্ষাৎকারঃ বিগ্রেডিয়ার হারুন আহমেদ চৌধুরী

<৯, ২.৪, ৪৪-৪৬>

চট্টগ্রামে সশস্ত্র প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ বিগ্রেডিয়ার হারুন আহমেদ চৌধুরী

(১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন)

১৭১৯৭৫

 

২২শে মার্চ আমি চট্টগ্রামে আসলে ক্যাপ্টেন রফিক আমাকে বললেন,৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অনেক বাঙালী অফিসার আছেন,তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেশের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর এবং বিদ্রোহ সম্পর্কে কথাবার্তা চালাও।আমি ক্যাপ্টেন রফিকের কথামত ২৩শে মার্চ ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেসে যাই এবং আমার কোর্স মেট ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী(বর্তমানে লেঃকঃ) ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ(বর্তমানে মেজর) লেঃমাহফুজুর রহমান(বর্তমানে মেজর),লেঃশমসের মুবিন চৌধুরী (বর্তমানে মেজর) এর সঙ্গে দেখা করে কথাবার্তা বলি।মেজর শওকত তখন মেসে ছিলেন।কিন্তু যেহেতু তিনি সিনিয়র,সেহেতু তার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পাই নি।

 

উপরের বর্নিত অফিসার বৃন্দকে নিয়ে আমি ক্যাপ্টেন রফিকের বাসায় সন্ধ্যায় আসি,এবং সেখানে থেকে ক্যাপ্টেন রফিক সহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপকের বাসায় পৌছাই-তখন রাত আনুমানিক সাড়ে ৯’টা।আমার নিজের একটি ভক্সওয়াগন গাড়ি ছিল।ঐ গাড়িতে করে আমরা গিয়েছিলাম।ঐ সভাতে এমপিএ আতাউর রহমান কায়সার ছিলেন,ডঃ মান্নান সহ আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন।সভায় দেশের সর্বশেষ অবস্থা,আমাদের ক্ষমতা,পাকিস্তান থেকে সৈন্য নিয়ে আসা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়।সামরিক বাহিনী গতিবিধি দেখে আমরা নিশ্চিত হলাম যে,পাকিস্তানি সেনারা সত্বর বাঙালীদের বিরুদ্ধে একটা কিছু করতে যাচ্ছে।সভায় ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তরুন অফিসার বৃন্দের(২ জন) মাঝে সমঝোতা হয় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে,যদি পাক বাহিনী আক্রমন করে আমরা বাঙালীরা একসঙ্গে প্রতিরোধ গড়বো এবং সমুচিত জবাব দেব।

 

২৪শে মার্চ সকালে আমি কাপ্তাই চলে যাই।কথা হয় যে,পাকিস্তানীরা যদি আক্রমন করে অথবা ইঙ্গিত দেয় তাহলে আমরা বিদ্রোহ করবো এবং ক্যাপ্টেন রফিক আগে বিদ্রোহ করলে সে আমাকে খবর দেবে।রফিক আরোও বললো যে,ইন্সপেকশনের নামে পান্জাবীদের অস্ত্রের ফায়ারিং পিন অকেজো করে দিয়েছে এবং তুমিও তোমার উইং-এ তাই করো।আমি রাজী হলাম।আমাকে কোর্ড ওয়ার্ড দিলেন,”ব্রিং সাম উড ফর মি”-অর্থ হলো চট্টগ্রামে যুদ্ধ শুরু হয়েছে।আমাকেও বিদ্রোহ শুরু করতে হবে।এবং সমস্ত অবাঙালীদের বন্দী করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে মিলতে হবে।

২৪শে মার্চ খুব ভোরে আমি কাপ্তাই চলে গেলাম।আমার উইং-এ সুবেদার মেজর ছিল (বাঙালী) নাজমুল হক।সুবেদার মেজর আমাকে সব খবরাখবর এনে দিত।অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে অবাঙালী এন-সিও এবং জে-সি ওরা রাতে গোপনে মেজর পীর মোহাম্মদের(উইং কমান্ডার) বাসাতে সলাপরামর্শ করতো।আমি সবসময় সতর্ক থাকতাম এবং বুঝতে পারতাম উইং কমান্ডার এবং অবাঙালীদের মনে আক্রমনাত্বক প্রস্তুতি চলছে।আমি ভিআইপি রেস্ট হাউসে থাকতাম।

 

২৪শে মার্চ সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন ফারুক বান্দরবন থেকে উইং হেড কোয়াটারে আসে।ক্যাপ্টেন জায়দী আমার অনুমতি নিয়ে ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় কাপ্তাইতে আসেন।ক্যাপ্টেন ফারুক এবং ক্যাপ্টেন জায়দী আমার রুমে জায়গা নিলেন।আমরা তিনজন কথাবর্তা বলে রাত ৯-৩০ থেকে ১০ টার দিকে ঘুমাতে যাই।এমন সময় আমার ওডার্রলি দরজা ধাক্কা দেয় এবং আমার টেলিফোনের কথা বলে।আমি টেলিফোন যেয়ে শুনলাম লাইন কেটে গেছে।তবে অপারেটর বলল,ক্যাপ্টেন রফিক কথা বলতে চেয়েছিলেন।আমি রুমে ফিরে যাই।এবং মিনিট দশেক পর আবার টেলিফোন আসে।টেলিফোন ধরে জানলাম এস,আর, সিদ্দিকী।জনাব সিদ্দিকী বলেন,২০-বালুচ বেঙ্গল রেজিমেন্ট আক্রমন করেছে।শহরে খুব গোলমাল,আপনি বিদ্রোহ করেন এবং চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন।আমি রফিকের সাথে কথা বলতে চাইছিলাম।তিনি বললেন,”রফিক যুদ্ধ করছে,সে এখানে নাই।এরপর আবার টেলিফোন পেলাম,করেছেন জনাব এম, আর, সিদ্দিকী।জনাব সিদ্দিকী বললেন বলেন,”রফিক যুদ্ধ ময়দানে তবে একটি কোর্ড ওয়ার্ড পাঠাতে বলেছেন,সেটি হলো, “ব্রিং সাম উড ফর মি।” তখন আমি অবস্থাটা বুঝলাম।তখনই আমার রুমে এসে পোশাক পরি এবং সিদ্ধান্ত নিই অবাঙালীদের নিরস্ত্র করবো এবং চট্টগ্রামে রওনা হব।পোষাক পড়ার সময় অবাঙালী অফিসার জেগে যায় এবং তিনি জিজ্ঞাসা করেন যে আমি পোশাক ক্যান পরছি।”লাইনে কিছু গোলমাল,এখনই ফিরে আসবো,তোমরা ঘুমাও”।এই কথা বলেই আমি চলে যাই।গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় এক অবাঙালী এনসিও আমার দিকে আসে,এবং বলে স্যার,লাইনে গোলমাল।তখন এনসিওকে তুলে নিয়ে আমি লাইনে যাই।লাইনে পৌঁছে আমি সুবেদার মেজরকে ডাকি এবং সমস্ত কথা বলি।তাকে বলি,”কোতে চাবি নিয়ে প্রস্তুত থাকুন।বাঁশী বাজালে কোত খুলে দেবেন।”ঐ রাতে গার্ড কমান্ডার ছিল একজন পান্জাবী।তাকে ডেকে আমাদের দোতলায় সমস্ত এনসিওকে ডাকতে বললাম।আমার সাথের এনসিওকে তার আগেই উপরে পাঠিয়েছিলাম।গার্ড কমান্ডার উপর তলা থেকে নিচের তলায় নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বন্দী করি।এবং অস্ত্র কেড়ে নেই।আমার কথামত কোয়ার্টার গার্ডের বাঙালী সৈনিকরা সঙ্গে সঙ্গে দোতলার সিঁড়ির মুখে পজিশন নিতে থাকে।হুইসেল দেই,সমস্ত বাঙালী সৈনিকদের উপর হতে নিচে নেমে আসতে বলি এবং অবাঙালীদের উপরে থাকতে বলি।কোন অবাঙালী নামার চেষ্টা করলে গুলি করার হুকুম দেই।বাঙালীরা প্রস্তুত ছিল,তাই হুইসেলের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বাঙালীরা নিচে নেমে আসে।কোত খুলে দেওয়া হয় এবং সকলের হাতে অস্ত্র-গোলাবারুদ তুলে দেওয়া হয়।আমি তখন উইং কমান্ডার মেজর পীর মহাম্মদকে নিরস্ত্র করতে গেলাম।কাপ্তাইতে তখন কতগুলো পয়েন্ট ছিল সে পয়েন্টে গার্ড ছিল অবাঙালী।আমি তখন পয়েন্টের গার্ডটিকে নিরস্ত্র করি এবং তারপর মেজর পীর মহাম্মদের বাসাই যাই।মেজর পীর মহাম্মদ তখন ঘুমাচ্ছিলেন।ডাকাডাকিতে উঠলেন এবং তিনি আমাকে পোষাক পড়া দেখে ঘাবড়ে গেলেন।তিনি আসলে বললাম,”আপনি বন্দী।বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে,আমি উইং এর দায়িত্ব নিয়েছি।”মেজর পীর মহাম্মদ অস্ত্র ধরার চেষ্টা করলেন।আমি হুশিয়ার করে দেই,”অগ্রসর হলে মৃত্যু।””ঘরে থাকেন,কোন অসুবিধা হবে না আপনার।”এই বলে বাইরে গার্ড রেখে আবার রুমের দিকে যাই।রুমে পৌঁছে দেখলাম ক্যাপ্টেনদ্বয় উঠে বসেছে। তাদেরকে বললাম, ‘”তোমরা বন্দী এদেশ স্বাধীন।”পান্জাবী ক্যাপ্টেন জায়দী উঠবার চেষ্টা করে,তার আগেই তাকে বন্দী করে ফেলি।ক্যাপ্টেন ফারুক পাঠান ছিল।সে খুশী হয়ে বললো।”আমি ভালোই হলো আমি তোমার অনুগত হয়ে বাংলাদেশের সেবা করবো।”রাত তখন সাড়ে এগারোটা হবে।হাজার হাজার জনতা পথে নেমেছে।আমি ই-পি আর কোম্পানীর ৪/৫ জনকে উইং হেডকোয়ার্টারে রেখে বাকী সবাইকে নিয়ে রাত সাড়ে তিনটার দিকে চট্টগ্রামের পথে রওনা হই।যাবার পূর্বে অয়ারলেস মারফত আমার অবশিষ্ট কোম্পানী গুলোতে মেসেজ পাঠাই যে,সমস্ত অবাঙালীদের বন্দী করে কাপ্তাইতে একত্রিত হয়ে চট্টগ্রামের দিকে রওনা হও।“

২৬শে মার্চ আমি যখন চট্টগ্রাম শহর থেকে ৭/৮ মাইল দূরে ছিলাম দেখলাম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন সৈন্য পটিয়ার দিকে দৌড়াচ্ছে।তাদের জিজ্ঞাসা করে জানলাম পাক বাহিনী আক্রমন করেছে।আমি অগ্রসর হলে মেজর জিয়ার সাক্ষাৎ পাই।তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বললেন”ক্যাপ্টেন রফিক শহরে যুদ্ধ করছে আমরা ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল পটিয়াতে একত্রিত হবো তারপর আবার শহরে এসে পাল্টা আক্রমন চালাবো।”আমাকে তার সঙ্গে থাকতে বললেন।আমি মেজর জিয়ার সঙ্গে থেকে গেলাম।এরপর মেজর জিয়ার কমান্ডে কাজ করতে থাকি।পটিয়াতে আমরা সবাই মেজর জিয়ার নেতৃত্বে শপথ নেই।কালুরঘাটে পাক-বাহিনী ব্যাপকভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। ১১ই এপ্রিল পাকসেনারা চারদিক থেকে বৃষ্টির মতো গোলা ফেলতে থাকে।

ঐ তারিখে আমি এবং শমসের মুবিন চৌধুরী গুরুতর রুপে আহত হই।আমাকে পটিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।ডঃ নূর হোসেন(অস্ত্র বিশেষজ্ঞ) পটিয়াতে আমার অস্ত্রপাচার করেন।তারপর আওয়ামিলীগের লোকজন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নিয়ে ফিরতে থাকে।ইতিমধ্যে কালুরঘাটের পতন ঘটে।মালুরঘাট নামক স্থানে খৃষ্টান মিশনারী হাসপাতালে পুনরায় আমার অস্ত্রপাচার করে সেখান থেকে কক্সবাজারের উখিয়া নামক স্থানে সমসের আলম চৌধুরীর বাড়িতে রাখেন।সমসের আলম চৌধুরী আমাকে ঔষধ পত্র দিয়ে এবং সেবা-যত্ম করে সুস্থ করে তোলেন। ফকরুদ্দিন (আমার ব্যাটসম্যান) সব সময় সঙ্গে ছিল।খামারবাড়ি নামক স্থানে থাকা অবস্থায় পান্জাবীরা আমাদের খোঁজে আসে।তখন আমাকে স্ট্রেচারে করে সবাই বার্মা চলে যায়।বার্মা রিফুইজি ক্যাম্পে সবাই আশ্রয় নিই।সেখানে চিকিৎসার পর আমি সুস্থ হয়ে উঠি।বার্মা থেকে পালিয়ে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে টেকনাফে আসি।টেকনাফে এসে বেশ কিছু ই.পি.আর ছেলে পেলাম এবং তাদের সঙ্গে অন্যান্যরাও ছিল।আমি ওখানে থেকে যাই এবং আবার যুদ্ধে নেমে পড়ি।

১১/১২ই ডিসেম্বরে কক্সবাজারে ভারতীয় সেনাবাহিনী নামলে আমি তাদের সঙ্গে যোগ দিই এবং দেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাই।

স্বাক্ষরঃ

হারুন আহমেদ

১৭-১-৭৫

Scroll to Top