সাক্ষাৎকারঃ আঃ গনি তালুকদার
(১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের স্বাধীনতা সময় রাজারবাগ (রিজার্ভ) পুলিস লাইনে ওয়ারলেস অপারেটর ছিলেন)
অফিস সহকারী (পুলিশ), রমনা থানা, ঢাকা (সদর)
৯-১-৭৪
সিপাহী আব্দুল খালেক খালেক, মোজাম্মেল হক, মুখলেসুর রহমান, মির্জা মহিউদ্দিন এবং আরো অন্যান্য বন্ধু ও সহকর্মীসহ আমরা ২৫ শে মার্চ রাত দশটার সময় খাওয়া-দাওয়া করে ১৪ নং ব্যারাকে বসে ছিলাম। রাত পৌনে এগারোটার সময় ঢাকা পিলখানা ইপিআর হেড কোয়াটার থেকে টেলিফোনে পাক হানাদার কর্তৃক রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ ও ইপিআর হেডকোয়াটার আক্রমনের সংবাদ পাই। টেলিফোনে ইপিআর হেডকোয়াটার থেকে আমাদের সশস্ত্রভাবে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য থাকতে বলা হয়। আমরা আমাদের ১৪ ব্যারাকে মোট পঞ্চাশজন সিপাহী এএসআই, হাবিলদার ও সাধারণ সিপাহী উপস্থিত ছিলাম। এসংবাদ দ্রুত রাজারবাগ রিজার্ভ পুলিশের আরআই ও এসপি হেডকোয়াটারকে জানানো হয়। এ সংবাদ পেয়ে রিজার্ভ পুলিশের সকল অফিসার ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবাই ডিউটিতে এসে সকল সিপাহী, সুবেদার, এএসআই, এসআই, হাবিলদার সবাইকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিতকরে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য তৈরী করেন এবং প্রত্যেক ডিউটিতে মোতায়েন করেন। তৎকালীন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ সুপার মিঃ শাহজাহান ও আরআই মিঃ মফিজউদ্দিন আমাদের এই সশস্ত্র প্রস্তুতিতে নেতৃত্ব দান করেন।
পুলিশ সুপার ও আরআই উভয়েই শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ে যাবার জন্য জ্বালাময়ী ভাষায় সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দান করে নিজ নিজ দায়িত্বে চলে যান। এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। আমরা সবাই সিপাহী, হাবিলদার, সুবেদার, এএসআই, এসআই, সবাই সশস্ত্রভাবে পজিশন নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর অপেক্ষা করতে থাকি। এসময় অয়ারলেস এবং টেলিফোন সবকিছু অচল করে দেওয়া হয়েছিল। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাইরে সহ ছাত্র-জনতা বড় বড় গাছ লাইটপোষ্ট, ইট-পাটকেল ফেলে ব্যারিকেট তৈরী করে। রাজারবাগে প্রবেশ করার পথে পথে বহু প্রশস্ত ড্রেন কাটা হয় হানাদার বাহিনীর অগ্রগতি প্রতিরোধ করার জন্য। এভাবে প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ তৈরী করার মধ্য দিয়ে সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। পাক হানাদাররা রাত সাড়ে এগারোটার সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চারিদিক থেকে লাইট বোম মারতে মারতে অগ্রসর হয়। এরমধ্যে চলছিল বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ, কামান ও ট্যাংকের গর্জন। পাক হানাদার হামলার সাথে সাথে আমরা সবাই আমাদের সামান্য রাইফেল বন্দুক নিয়ে ওদের হামলার প্রাণপণ জবাব দিতে থাকি। ওরা আমাদের দৃঢ় মনোবল দেখে এরপর যুগপৎ কামান ও ট্যাংক ব্যবহার করে। আমরা টিকতে না পেরে ক্রমে পিছু হটতে থাকি। আমাদের অধিকাংশ বীর যোদ্ধা লড়তে লড়তে শহীদ হন। অনেকে দারুণভাবে আহত হয়ে মৃতবৎ সেখানেই পড়ে থাকেন। আর অনেকে আহত দেহ নিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে সমর্থ হন। পাক হানাদার পশুরা আমাদের লৌহকঠিন মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সকল ব্যারাকে লাইট বোমা ও প্রেট্রোল দ্বারা আগুন লাগিয়ে দেয়। আমাদের বহু আহত যোদ্ধা ঐ সকল ব্যারাকে আটকা পড়ে জলন্ত আগুনে দগ্ধীভূত হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন। আনুমানিক রাত তিনটার সময় অবিরাম গোলাবর্ষনের মধ্য দিয়ে আমি আমার অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মরক্ষা করার জন্য ঢাকা শহরের বাইরে চলে যাই।