সহুল আহমদ মুন্না
<৬,২২১,৩৭৩-৩৭৪>
শিরোনামঃ গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মৈত্রী
সংবাপত্রঃ জাগ্রত বাংলা, ১ম বর্ষঃ ৮ম সংখ্যা
তারিখঃ ১৬ ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মৈত্রী
সম্পাদকীয়
মনে হইতেছে, অনেক শব্দের যথাযথ অর্থ আমাদের জানা নাই। বিশেষ করিয়া বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর হইতেই যে শব্দের যে অর্থ হওয়া উচিত, কিংবা আমাদের যাহা জানা ছিল, তাহা বাস্তবের সাথে ঠিক মিলিতেছে না।
কথাটি আরও ব্যাখ্যা করিয়া বলার দরকার। বিশ্ব রাজনীতিতে বৃহৎ শক্তির বিশেষ ভূমিকা রহিয়াছে। ছোট বড় সব রাষ্ট্রেরই আইনগত অধিকার সমান হইলেও ক্ষমতা অনুযায়ী প্রভাব ইহাদের বেশী। ইহারা নিজেদের রাজনীতি তথা অর্থনীতিসমূহের একেকটি নাম দিয়াছে। কথা হইতেছিল ঐ সকল নাম লইয়া।
আমেরিকা দাবী করে তাহার নীতি শুদ্ধ গণতান্ত্রিক; চীন বলে যে সমাজতান্ত্রিক; এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নকেও বলা হয় সমাজতান্ত্রিক দেশ। যতদূর জানি গণতন্ত্র কথাটার তাৎপর্য রাজনৈতিক; সমাজতন্ত্র মূলতঃ অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি আদর্শ বিশেষ। গণতন্ত্রে মানুষের মৌলিক রাজনৈতিক অধিকারসমূহ – যেমন, বাকস্বাধীনতা ও ভোটাধিকার – ইত্যাদি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সমাজতন্ত্র মানুষকে অর্থনৈতিক শোষণ হইতে মুক্ত করে। প্রসঙ্গত বলা যায়, মানুষের দ্বারা মানুষের উপর যতরকম রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক অবিচার ও উৎপীড়ন, তাহা একমাত্র অর্থনৈতিক শোষণের ভিত্তি ভূমির উপরই দন্ডায়মান। সেহেতু সত্যিকার সমাজতন্ত্রে গণতন্ত্রও নিহিত থাকে।
আমেরিকায় সমাজতন্ত্র নাই। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমেরিকার চিরাচরিত যুদ্ধ ঘোষণার কথা কে না জানে। তথাপি মার্কিনী অপপ্রচারের বদৌলতে অনেকের একটা ধারণা জন্মিয়াছিল, হয়ত সেই দেশে গণতন্ত্র আছে কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার উলঙ্গ গণবিরোধী ভূমিকা দেখিয়া তাহারা নিশ্চয়ই এই সিদ্ধান্তে আসিবে যে, হয় আমেরিকা মিথ্যাবাদী, নতুবা গণতন্ত্র ইহাকেই বলে। আমরা বলিতে চাই, শেষোক্ত অনুমানটি ভুল নহে। কারণ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সহিত সংশ্লিষ্ট না থাকিলে ‘নির্ভেজাল’ গণতন্ত্রের ইহাই চেহারা।
গণচীনের ভিতরের খবর বাইরের পৃথিবী খুব কমই জানিতে পারে। পিকিং বেতারের যে সকল গালিগালাজ শোনা যায় এবং পিকিংয়ে প্রকাশিত যেইসব বিপ্লবী পুস্তকাদি পাওয়া যায়, তাহাতে অবশ্য না বুঝিয়া উপায় নাই যে, চীন একটি বিশুদ্ধ সমাজতান্ত্রিক দেশ; শোষিত, অনুন্নত জাতি এবং সর্বহারার সংগ্রাম সর্বত্রই তাহার সমর্থন উন্মুক্ত। কিন্তু এইবার আমাদের একটু খটকা লাগিয়াছে এই জন্য যে, বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে চীন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীন ব্যাপার বলিয়া অভিহিত করিয়াছে, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বলিয়াছে দুষ্কৃতিকারী, তদপুরি ‘সম্প্রসারণবাদী’ ভারতকে দিয়াছে হুমকি।
চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় যতটা জানা যায় তাহাতে দেখি, ব্যাক্তিপূজাই চীনা নীতির বিশেষত্ব। ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইতে গিয়া লিও শাউচী’র ন্যায় অসংখ্য সৎ ও প্রবীণ কমিউনিস্ট মাও সে তুংয়ের নিজস্ব বাহিনী লাল রক্ষীদের হাতে লাঞ্চিত। লাল রক্ষীরা চীনের সবচেয়ে সুবিধাভোগী একটি দল। মাও ও তাহার চীনা সমাজতন্ত্রকে টিকাইয়া রাখিবার জন্য উহারা যে কোন কাজ করিতে পারে। মাওয়ের এই বাহিনী তাঁহার দুর্বলতারই পরিচায়ক। নিশ্চয়ই চীনা অর্থনীতিতে এমন কোন ত্রুটি রহিয়াছে যাহা সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ হইতে কঠোর সমালোচনার যোগ্য; এবং এই সমালোচনাকে মাও সে তুং ভয় পান বলিয়াই সেইখানে গণতন্ত্র পর্যদুস্ত।
সুতরাং ইহাই প্রমাণ হয় যে, আমেরিকার সমাজতন্ত্রহীন গণতন্ত্র যেমন একটি ভাঁওতা। উভয় দেশের নীতিই প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদ। আজ গণচীন ও আমেরিকা যে বিশ্ব – রাজনীতিতে হাতে হাতে মিলাইয়াছে তহা নূতন হইলেও বিচিত্র কিছু নহে।