কম্পাইলারঃ বুটেবল ঈশরাক
<৬,২৩৯,৪০২-৪০৩>
সংবাদপত্রঃ দেশ বাংলা
তারিখঃ ১৮ই নভেম্বর,১৯৭১
অধিকৃত বাংলায় চাকমারা দমে গেছেঃ বিদ্রোহী মিজো লালডেঙ্গা
পাক ছাউনিতে
পার্বত্য চট্রগ্রাম এলাকার উপজাতীয়দের নানাভাবে প্রলব্ধ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা ফলপ্রসু হয়নি। আমাদের চট্রগ্রাম সংবাদদাতা চট্রগ্রাম থেকে ঘুরে এসে জানিয়েছেন যে, পার্বত্য চট্রগ্রামের চাকমা উপজাতির প্রধান রাজা ত্রিদিব রায় এবং পার্বত্য চট্রগ্রাম থেকে নির্বাচিত পরিষদ সদস্য আউংশে এলাকাকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে চাকমা নেতারা সে ফাঁদে পা-ও দিয়েছিলেন এবং সে অনুযায়ী কিছু সংখ্যক চাকমাকে ট্রেনিংও দেওয়া হয়।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই পরিকল্পনা একাধিক কারনে মোটেই কাজে আসেনি। প্রথমত” চাকমারা সংখ্যায় খুবই নগণ্য। সমগ্র পার্বত্য চট্রগ্রামে উপজাতীয়দের সংখ্যা আশি হাজার। দক্ষিণের বোমং ও উত্তরে মং রাজার অনুগামিরা চাক্মাদের কোনকালেই সুনজরে দেখেনি। কারণ, চাকমারা তুলনামূলকভাবে কিছুটা উন্নত এবং অন্যান্য উপজাতীয়দের ঘৃনার চোখে দেখে থাকে।
এদিকে রামগড়ের মং রাজা মুক্তিবাহিনীর পক্ষ নিয়েছেন। এপ্রিল-মে মাসে রামগড় যখন মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল, তখন তিনি সর্বতোভাবে সহায়তা করেছেন। তাঁর ধনুকধারী টিপরা বাহিনী পাহাড়ে-জঙ্গলে পাহারাদারের কাজ করেছে। রামগড়ে পাক-বাহিনীর প্রবেশের পর তিনি সপরিবারে মুক্তাঞ্চলে চলে যান এব্বং তাঁর অনুগামীরা গভীরতর জঙ্গলে আশ্র্য নেন।
বোমং উপজাতীয়রা তুলনামূলকভাবে আরো অনুন্নত ও অসংহত।
পার্বত্য চট্রগ্রামের অবস্থানগত কারণে এবং উপজাতীয়দের সংখ্যাল্পতা ও বিচ্ছিন্ন অবস্থানের ফলে তাদের কার্যকলাপ নিজ নিজ এলাকাতেই সীমাবদ্ধ। ফলে এই মুহূর্তে তাদের নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন মুক্তিবাহিনীর আদৌ আছে বলে মনে হয় না। মুক্তিবাহিনীর সামগ্রিক বিজয়ের পথে উপজাতীয়দের মাধ্যমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রচেষ্টা পাক-বাহিনীর নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। কারণ আজ হোক কাল হোক, মুক্তিবাহিনীর সামগ্রিক বিজয়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে আসলে অস্ত্রধারী উপজাতীয়রা তাদের অস্ত্র গুড়িয়ে ধরবে নিজেদের প্রয়োজনেই। বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে তাদের পৃথক অস্তিত্ব একেবারেই অসম্ভব। আর একমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশেই উপজাতীয়রা তাদের পরিপূর্ন নাগরিক অধিকার এবং উপজাতীয় স্বার্থের রক্ষা কবচ পেতে পারে, এ সত্য উপজাতীয় নেতাদের অজানা থাকার কথা নয়। এতদসত্বেও যে দু’একজন উপজাতীয় নেতা বর্তমানে পাক-বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়েছে, তারা চিরদিনই স্রোতের শেওলার মত এধার ওধার করে এসেছে। উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে নয়, ব্যক্তিগত লোভ লালসা থেকেই এরা পাক-সরকারের পক্ষ নিয়েছে। বলাবাহূল্য সে জন্যই এদের ভূমিকার কোন রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই। চাকমা নেতা ত্রিদিব রায় স্বতন্ত্রপ্রাথী নিসাবে নির্বাচিত হয়ে কনভেনশন মুসলিম লীগের মন্ত্রি হয়েছিলেন। গতবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে তিনি জয়ী হয়েছেন। জয়ী হবার পর আওয়ামী লীগের দুয়ারে ধরনা দিতে দেরী করেন নি। কিন্তু ২৫শে মার্চের পর পুনরায় ভোল পালটে ফজলুল কাদেরের বৈঠকখানায় হাজিরা দিয়েছেন। সংগতভাবেই বলা যায়, পাক-বাহিনীর গাত গুটাবার লক্ষ্ণ দেখা দিলে তিনি আবারও ডিগবাজী খেতে দেরী করবেন না।
ভারতের মিজোদের নিয়ে পাক-সরকার কিছুটা জটিলটা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিল। মিজোদের মনে স্বাতন্ত্র্যবোধ জেগে উঠেছিল বেশ কিছুকাল পূর্ব থেকে এবং তার পেছনে পাক-উস্কানীও ছিল। পার্বত্য চট্ট্রগ্রামের সীমান্তবর্তী মিজো এলাকা থেকে বিদ্রোহীদের বাংলাদেশের ভেতর নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং সেখানে তাদের সামরিক শিক্ষা দেওয়া হয়। পরে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মিজোরা দেশে ফিরে নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হলে ভারত সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। বিদ্রোহী মিজোদের নেতা লালডেঙ্গা এখন বাংলাদেশের ভেতরে পাক-সামরিক ছাউনীতে বেশ কিছুসংখ্যক অনুগামীসহ অবস্থান করছেন। মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে পার্বত্য চট্রগ্রামে হামলা পরিচালনার সময় পাক বাহিনী কয়েকশত মিজো পরিবারএকে কয়েকটি মাত্র বন্দুক হাতে নিয়ে অগ্রবর্তী বাহিনী হয়ে এগিয়ে যেতে বাধ্য করে। তাদের গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগুতে বলা হয়, যাতে করে পাল্টা জবাব থেকে মুক্তিবাহীর অবস্থান নির্ণয় করা যায়। তাদের পিছু পিছু পাক-বাহিনী নিরাপদ দূরত্বে এগুতে থাকে। ফলে এই হতভাগ্যরা অধিকাংশই সপরিবারে ক্রস ফায়ারিং-এর শিকার হয়।
ভারত সরকার কতৃক কেন্দ্র শাসিত মিজোরাম ষ্টেট গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হবার পর মিজোদের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব দূর হতে চলেছে। বিদ্রোহীদের মধ্যে অনৈক্য দেখা দিয়েছে অনেক দিন থেকে, স্বায়ত্বশাসিত মিজো ষ্টেট পেলেই তাঁদের অনেকে খুশী। লালডেংগার সমর্থন তাই দিন দিনই কমে আসছে এবং তাকে নাগা নেতা ডঃ ফিজোর ভাগ্যই বরণ করে নিতে হচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। পাকিস্তানি ছাউনিতে পাক-বাহিনীর বর্বরতার নমুনা দেখে লালডেঙ্গার ঘনিষ্ঠ সহচরদের তিনজন হতাশ হয়ে স্বদেশে ফিরে গেছেন। তাঁদের মধ্যে তথাকথিত স্বাধীন মিজোরাম সরকারের “পররাষ্ট্রমন্ত্রী” লালমিনখাংগা এবং “অর্থমন্ত্রী” লালথাওলিয়া রয়েছেন। মিজো জেলাকে “ইউনিয়ন টেরিটরি”তে রূপান্তরিত করা এবং আসাম সরকার কর্তৃক গণ-ক্ষমা প্রদর্শনের ঘোষণায় তাঁরা সন্তুষ্ট হয়েছেন। প্রসংগত উল্লেখযোগ্য যে, মিজো জাতীয় ফ্রন্টের সহ-স্বভাপতি লালনুনমাউইয়ার নেতৃত্বে চমরপন্থীদের একাংশ পূর্বেই বিচ্ছিন হয়ে এসেছেন।
পাক-ছাউনীতে লালডেঙ্গার অনুগামীদের মধ্যে অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছে। পাকবাহিনী তাদের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করছে। মিজোদের স্বাধীনতা”র প্রশ্নটি চাপা দিয়ে, পাক-বাহিনী তাদের ভারত ও বাংলাদীর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি ও নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। এ সব ব্যাপারে মতভেদ হওয়ায় লালডেঙ্গা আটজন কমান্ডারের ছয়জনকে সম্প্রতি বরখাস্ত করেছেন।
কেন্দ্রশাসিত মিজো ষ্টেটের আনুষ্ঠানিক উদ্ভোদনের সাথে লালডেঙ্গার রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটবে তা” এখন নিশ্চিতভাবে বলা যায়; সেই সাথে ঘটবে পূর্বাঞ্চলের উপজাতীয়দের নিয়ে পাক-বাহিনীর দীর্ঘ দিনের ষড়যন্ত্রেরও অবসান।