কম্পাইলারঃ নোবেল
<৬,২৬৬,৪৫০-৪৫২>
সংবাদপত্রঃ অভিযান ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
.
খেলা সমাপ্তির শেষ ঘণ্টাধ্বনি
সুদির্ঘ আট মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে একদিকে যেমন বাংলাদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক সংগঠনগুলো বাংলার মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে পাকিস্তানী শাসন-শোষণের অবসানকল্পে করেছেন মরনপণ সংগ্রাম, অন্যাদিকে তেমনি জামাত, পিডিপি, মুসলিম লীগ প্রভৃতি রঙবেরঙের পার্টিগুলো ইয়াহিহার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতির্ণ হয়েছে।
.
বাংলাদেশের এই সব পার্টি গুলোর বর্তমান ভূমিকা আপাতদৃষ্টিতে একটু বেমানান ঠেকলেও এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। ঐতিহাসিক ভাবে এই পার্টি গুলো তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করছে মাত্র।
.
আজ ২৩ বছরের শাসন- শোষণের ফলে যে ঘৃণা বাঙ্গালীর মনে জমে উঠেছে তারই শেষ পর্যায় হলো আজকের এই স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাকিস্তানের বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ব বাংলাকে তাদের শোষণের আবাসভূমি হিসেবে রাখতে চেয়েছে। আর তার জন্যই তারা পূর্ব বাংলায় তাদের নিজেদের বাছাই করা লোকদের ব্যাবহার করছে। এই বাছাই করা লোকেরাই হচ্ছে নুরুল আমীন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, গোলাম আজম, ফরিদ আহমেদ, মোনেম খাঁ, মাহমুদ আলী, সবুর খান, অয়াহিদুজ্জামান প্রভৃতি লোকেরা।
.
এরা কখন কখন খোদ সরকারী পক্ষ নিয়েছে আবার কখনও বা বিরোধী দল হিসেবে কাজ করেছে। পাকিস্তান এক রাখার ব্যাপারে এরা সকলেই একমত। ধর্মের দোহাই তুলে পূর্ব বাংলার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে কেউবা। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই তাদের এই ভূমিকা প্রত্যক্ষ বা পরক্ষ ভাবে ধরা পড়েছে। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন এবং সবশেষ বর্তমান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যেকটিতেই তাদের ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণ অত্যন্ত ঘৃণার সাথে স্মরণ করে।
.
১৯৫২ সালে প্রথম আঘাত আসে পূর্ববাংলার জনগণের উপর। বাঙলার মানুষের নিজস্ব বিকাশ যাতে না হয় তার জন্য পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীলরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার সম্মানে ভূষিত করবার সংকল্প নেয়। বাঙলার মানুষ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালে তদানীন্তন নুরুল আমীন সরকার একে কঠোর হাতে দমন করার জন্য ঢাকার মিছিলে লেলিয়ে দেয় তাদের পিটুনি বাহিনী। এ দিকে অন্যান্য লোকেরা তখন এর মধ্যে হিন্দুয়ানী গন্ধ পেতে শুরু করে। আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের ভারতের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাঙলার জনগণ তাদের এই অপকৌশল বুঝতে পারায় সেই সময়টাতে এরা খুব সুবিধা করে উঠতে পারে না।
.
১৯৫২ সালের আন্দোলনে সুবিধা করতে না পারলেও তারা নিষ্ক্রিয় বসে রইল না। হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তারা তখন সর্বশক্তি নিয়োগ করলো। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের পরাজয়ের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা বাতিল করার জন্য তারা ৯২ (ক) ধারা জারী করে। সাথে সাথে যুক্তফ্রন্টের ভাঙ্গন সৃষ্টির কাজে এই সব দলগুলোকে সক্রিয় করে তোলা এবং পরবর্তিকালে তথাকথিত বাঙ্গালী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে দিয়ে নয়া মন্ত্রীসভা গঠন করে। কিন্তু ধামাচাপা দেয়া মন্ত্রীসভার আসল চরিত্রও জনগণের কাছে ফাঁস হয়ে যায়।
.
কোনমতেই যখন পূর্ব বাঙলার জাতীয়তাবাদী জনগণকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছিল না তখন তারা শেষ অস্ত্র নিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে অবতীর্ণ হয়। দেশে সামরিক শাসন জারী করে মুসলিম লীগকেই আবার চাঙ্গা করে তোলে। ১৯৬২ সালে নয়া শিক্ষানীতি পূর্ব বাংলার উপর চাপিয়ে দিতে গেলে বাংলার ছাত্র সমাজ রুখে দাড়ায়। শিক্ষানীতির পিছনে একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল, পূর্ব বাংলার জনগণকে শিক্ষার আলো থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে রাখা। এই শিক্ষানীতি চালু করার জন্য তার তাদের দুটি লেজুড় ছাত্র সংগঠন এস,এস,এফ এবং ইসলামী ছাত্র সংঘকে কাজে লাগায়। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই পূর্ব বাংলার সবচেয়ে সচেতন অংশ ছাত্রসমাজের উপর পর পর আক্রমণের কারণ হলো এই যে, প্রতিক্রিয়াশীল চক্র খুব ভালভাবেই জানতো যে বাংলার ছাত্র সমাজই পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং এদের আমল দিলে অচিরেই পাকিস্তান রাষ্ট্র অবলুপ্তি ঘটবে। তাই ছাত্র তরুণের প্রাণ বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত কোন দাবীই তারা মেনে নেয়নি।
.
১৯৬৪ সালে চন্ড মোনায়েম খাঁকে দিয়ে সমাবর্তন উৎসব অনুষ্ঠানের চেষ্টা করলে সাধারণ ছাত্র সমাজ আবার রুখে দাঁড়ায়। তখন মুসলিম লীগ ও জামাত ইসলাম তাদের ছাত্র সংগঠনকে দিয়ে এই উৎসব সফল করে তোলার জন্য পাল্টা উদ্যোগ নেয় কিন্তু স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছাত্রসমাজ এই উদ্যোগে সাড়া না দিয়ে সমাবর্তন বর্জন করে। তখন শাসকচক্রের দালাল ছাত্র সংগঠন ও ভাড়া করা গুন্ডা নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
.
এই ঘটনার পর পরই মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলাম প্রভৃতি দলগুলো জনগণের সংগ্রামী ধারাকে অন্যখাতে প্রবাহিত করার জন্য এই পুর্ব বাংলার বুকে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাধায়। নিরিহ হিন্দুদের বাঁচাতে গিয়ে এ সময় অনেক রাজনৈতিক কর্মীও প্রাণ হারান। দাঙ্গার পরপরই তারা কাশ্মীর সমস্যার ধুঁয়া তুলে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব জনগণের মধ্যে ছড়াতে শুরু করে। এভাবে পুরো দশটি বছর একেরপর এক আক্রমণ চালিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে প্রতিরক্ষামূলক আন্দোলনে ব্যাপৃত রাখে। কিন্তু প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনই পূর্ব বাংলার জনগণকে রাজনইতিকভাবে অনেক বেশী সচেতন করে তোলে।
.
তাই যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দোহাই দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করা হয় তখন বাঙলার মানুষ আর চুপ করে বসে থাকে না।
.
১৯৬৯ সালে পূর্ববাংলার ছাত্র সমাজ ১১ দফার ভিত্তিতে ব্যাপক গণআন্দোলনের আহবান জানালে পূর্ববাংলার জনগণ স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সিময় পিডিপি, জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগ যৌথভাবে ১১ দফার পাল্টা হিসাবে আট দফা দাবী জনগণের সামনে পেশ করে। আন্দোলনের নামে পূর্ব বাংলার জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যেই এই আট দফা উত্থাপন। কিন্তু সকল আন্দোলনে এদের ভূমিকা সম্পর্কে জনগণ সচেতন হওয়ায় আট দফা জনগণের মধ্যে সাড়া জাগাতে সম্পূর্নরূপে ব্যার্থ হয়।
.
এই ভাবে প্রতিটি আন্দোলনেই তাদের নির্লজ্জ ভূমিকা জনগণকে অনেক বেশী সচেতন করে দিয়েছে। তাই যখন নুরুল আমিনের মুখে উত্তরবঙ্গের স্বায়ত্বশাসনের দাবী উঠতে দেখা যায়, জনগণের পক্ষ থেকে তখন তেমন কোনরূপ সাড়া পরিলক্ষিত হয় না।
.
পূর্ব বাংলার বিগত আন্দোলনে পিডিপি, জামাত, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলগুলো যেমন একদিকে জনগণের থেকে আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন হয়েছে অন্য দিকে তেমনি তারা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে পড়েছে।
.
২৩ অছরে যে ঘৃণা আস্তে আস্তে জমে ঊঠেছে তারই চরম পর্যায় হচ্ছে আজকের এই স্বাধীনতা যুদ্ধ। পাকিস্তানী শাসন শোষনের অবসানকল্পেই এই যুদ্ধ। বাংলার মানুষ বাঁচতে চায় অন্যান্য স্বাধীন জাতির মতোই। তারা যেমন করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে বাঙ্গালীদেরকেও তাই করতে হচ্ছে। যতো দিন যাচ্ছে, স্বাধীনতাযুদ্ধ তত জোরদার হচ্ছে। পাকিস্তানের পতনও অনুরুপভাবে ঘনিয়ে আসছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ‘পাকিস্তান’ থাকবে না। তার রাজনিতিও থাকবে না। সুতরাং এই সব দলের অস্তিত্বও বিলুপ্ত হবে।
.
এমতাবস্থায় নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখাতে হলে পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে হবে, বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। অতএব এরা সরকারী বা বিরোধী পক্ষ নয়, এবার সব রকম ক্ষমতার কামড়াকামড়ি ভুলে গিয়ে সবাই এক হয়ে অর্থাৎ সবাই আসল চেহারা নিয়ে সামরিক বাহিনীর সাথে একাত্ম হতে এগিয়ে এসেছে।
.
এই অন্তর্নিহিত সত্যকে উপলব্ধি করেই আজ নুরুল আমীন, গোলাম আজম, ফজলুল কাদির চৌধুরী, ফরিদ আহমেদ শ্রেণীর লোকেরা বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সামরিক বাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পূর্ব বাংলার সকল অঞ্চলে তাদের এজেন্টরা হত্যা ধর্ষন আর লুটতরাজ। কিন্তু খেলা সমাপ্তির শেষ ঘণ্টাধ্বনি তাদের কানে কি পৌছায়নি এখনও।