২৭১. ২৫ নভেম্বর পাক দুতাবাসগুলিতে শয়তানের অনুচর

লাল কমল

<৬,২৭১,৪৬৩-৪৬৪>

শিরোনাম সংবাদপত্র তারিখ
পাক দূতাবাসগুলিতে শয়তানের

অনুচর

অভিযান

১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা

২৫ নভেম্বর, ১৯৭১

 

পাক দূতাবাসগুলিতে শয়তানের অনুচর

পাকিস্তানের সমরনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া তখত তাউস টলমল করে উঠেছে। তাই তার মেজাজ সবসময় চড়ে থাকে। এক বৃটিশ সংবাদদাতার মতে গত তিন মাস ধরে তিনি নাকি ভয়ংকর রকম চটে আছেন। এ সময়ের মধ্যে একবারও নাকি শান্ত অবস্থায় তাঁকে দেখা যায়নি। এই মনোবৈকল্যটা তাদের বাঙ্গালীবিদ্বেষ হিসাবে ভারী উদ্ধত এবং অশোভনভাবে মার্চের পঁচিশ তারিখের পর থেকে প্রকাশ পেতে আরম্ভ করেছে। প্রতিটি নাজী যেমন হিটলার বলে মনে করতো নিজেকে, তেমনি ইয়াহিয়ার প্রতিটি অনুচরও নিজেকে ইয়াহিয়া বলে ভাবতে শুরু করেছে। তাদের ভাবভঙ্গী, আচার-আচরণ সবকিছুই জেনারেল ইয়াহিয়ার মতো।

 

নয়াদিল্লী থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকা দিল্লীর পাকিস্তান হাইকমিশনের জনৈক ব্রিগেডিয়ার গোলাম হাসানের কাহিনী প্রকাশ করেছেন। এই গোলাম হাসান লোকটির নামের আগে ব্রিগেডিয়ার দেখে যে কেউ তাকে সামরিক বাহিনীর লোক মনে করতে পারে। আসলে সে হচ্ছে পাকিস্তান হাইকমিশনের এট্যাচি। কয়েক সপ্তাহ আগে দিল্লীর পাকিস্তানী হাইকমিশনের বাঙ্গালী কর্মচারীরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে বেরিয়ে আসার সময় হাইকমিশনের পাকিস্তানী কর্মচারীরা তাঁদের সামনে নানা বাধার সৃষ্টি করে এবং প্রলোভনে মুগ্ধ করতে চেষ্টা করে। তা সত্ত্বেও বাঙ্গালী কর্মচারীরা খুনি ইয়াহিয়া সরকারের কাজ করবেন না বলে দূতাবাস ছেড়ে চলে আসেন। প্রকাশ, তখন এই হাসানই বাঙ্গালী কর্মচারীদের বলেছিলো, মনে রাখবে আমি পাঠান, দরকার হলে তোমাদের গুলী করে মারবো। বাঙ্গালী জনাব হোসেন আলীকে পাকিস্তান হাইকমিশনে গুম করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর মুক্তির জন্য বার বার আবেদন নিবেদন করেও কোন ফল পাওয়া যায়নি। পাকিস্তান হাইকমিশন এই আবেদন নিবেদন এবং বিক্ষোভে কোনরকম কর্ণপাত করেননি বললেই চলে। পিতার মুক্তির জন্য জনাব হোসেন আলীর দুই শিশু পুত্রের প্রার্থনাও বৃথা গেছে। বস্তুতঃ বাঙ্গালী কর্মচারী হোসেন আলী পাকিস্তান হাইকমিশনের জিন্দানখানায় বন্দী। তাঁকে মুক্ত করা এখনও সম্ভব হয়নি।

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ঘোষণার পর থেকে প্রতিটি দূতাবাসের বাঙ্গালী কর্মচারীবৃন্দ একে একে দূতাবাস ছেড়ে চলে এসেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদান করেছন। জনাব হোসেন আলীর ভাগ্য এবং হাসেনের পাশবিক কীর্তির কথা প্রকাশ হওয়ার পরে, কারো অনুমান করতে অসুবিদা হওয়ার কথা নয়, দূতাবাসগুলোতেও পাকিস্তান ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। যে সকল বাঙ্গালী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদান করতে ব্যাগ্রভাবে ইচ্ছুক তাঁদেরকে অনেক ক্ষেত্রে জোর করে আটক রাখা হয়েছে। নয়াদিল্লীর পাকিস্তানী হাইকমিশনের ঘটনাই তার প্রমাণ।

 

নয়াদিল্লী পাক হাইকমিশনের এই নব্য নায়ক গোলাম হাসান কেমন অমানুষ তার চাকরীজীবনের নথিপত্র ঘাঁটলেই তার বিস্তর প্রমাণ পাও্যা যাবে বলে প্রকাশ। বাঙ্গালীবিদ্বেষই ছিল তার পদোন্নতির মুখ্য সোপান। ১৯৬৯ সালের জংগীলাট আয়ুবের আমলে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পর্দার অন্তরাল থেকে যারা কলকাঠী নেড়ে ছিল এই গোলাম হাসান তাদের একজন। আগরতলা মিথ্যা মামলার ঠেলায় আয়ুব খানকে সিংহাসন ছাড়তে হয়। কিন্তু গোলাম হাসান ইয়াহিয়ার সুনজরে পড়ে যায়।

 

এই গোলাম হাসান এবং তার মতো মানুষেরা কতদূর কাপুরুষ একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই তা পরিষ্কার হবে। গত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাসহ বিজয় অর্জন করেছিলেন এবং ইয়াহিয়া ঘোষণা করেছিল, তিনিই দেশের “ভাবী” প্রধানমন্ত্রী, তখন গোলাম হাসান তাঁর কাছে করজোড়ে দারিয়ে বলেছিল, ‘স্যার আমি একজন সরকারের সামান্য নওকর মাত্র।’ পাকিস্তানের দূতাবাসগুলিতে বাঙ্গালী কর্মচারী গোলাম হাসান শ্রেণীর লোকদের হাতে এতকাল কিভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে তা অনুমান করাও দুঃসাধ্য।

Scroll to Top