৩২২. ২২ অক্টোবর একটি দেশত্যাগী শিশুর লেখা

অনুবাদঃ তামীম

<৬, ৩২২, ৫৫৮-৫৫৯>

শিরোনামঃ একটি দেশত্যাগী শিশুর লেখা

সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ৩

তারিখঃ ২২ অক্টোবর, ১৯৭১

.

একটি উদ্বাস্তু শিশুর লেখনী থেকে,

নাসরিন

 

দোসরা মে শেষ হয়েছিলো সুন্দর একটি বসন্তের সন্ধ্যা দিয়ে, যেই দিনটির কথা জীবন থাকা পর্যন্ত ভুলতে পারবোনা। আমরা তখনো পার্বত্য চট্রগ্রামের উপজেলা শহর রামগড়ে। আমি এখনো যখনি সেই দিনের কথা ভাবি, মনের চোখে দেখতে পাই ছোট্ট শহরটির মানুষরা সহজ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে।

মে মাসের দ্বিতীয় দিনে কর্নেল জিয়াউর রহমান আমার বাবাকে বলেছিলেন তিনি যেন পরিবার নিয়ে সীমান্তের ঐ পাড়ে চলে জান। বিএসএফ আমাদেরকে নদী পার হতে সাহায্য করেছিলো। বেলা চারটার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রামগড়ে এসেছিলো এবং তারপরেই আমি দেখি আমার কলেজের কিছু বন্ধু আর শৈশব থেকে চেনা কিছু বন্ধু হাসিমুখে সামনের দিকে হেঁটে জায়গামতো অবস্থান করলো। ইবিআর, ইপিআর এবং পুলিশরাও একই কাজ করেছিলো।

কিন্তু আমার শঙ্কিত মনের ভিতর শুধুই ভয় আর দুশ্চিন্তা কাজ করছিলো আমার বন্ধুদের জন্য। তাদের কেউ কেউ মাতৃভূমির জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলো।

 

ধীরে ধীরে আকাশে তারা ফুটে জানান দিচ্ছিলো দিন আসছে শীঘ্রই। হঠাৎ আমি একটি গুলির শব্দ শুনতে পেলাম, বুঝে উঠতে পারিনি ঠিক কোন দিন থেকে শব্দটি এসেছিলো। আমার বাবার পিওন কে দেখলাম আমার দিকে দৌড়ে আসছিলো, যিনি আমার উপর ভীষণ বিরক্ত পুলিশ স্টেশনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। আমার হাত ধরে তিনি টেনে আমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসার পরই বুঝতে পারলাম কি হয়ে গেছে!

সন্ধ্যার টকটকে লাল আকাশের নিচে আমি আমার বন্ধুদের দেখছিলাম দৌড়ে তাদের যুদ্ধের অবস্থানে যাচ্ছে। ভীষণ ভয় পেয়ে আমি দৌড়াতে শুরু করি, জীবনে প্রথম বারের মতো মর্টার শেল বৃষ্টির মতো পড়তে দেখেছিলাম আকাশ থেকে, সব জায়গায়। এই ভয়াবহ দুর্যোগের মুহূর্তেও ভীষণ কৌতূহলে আমাদের কিছু প্রতিবেশী আর আমরা তিন বোন একটি টিলায় উঠেছিলাম, দেখেছিলাম আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে।

কিন্তু তবুও আমরা আশা হারাইনি, কারণ আমরা জানতাম একদিন আমরা আমদের দেশকে মুক্ত করবোই, এই দেশের পবিত্র মাটিতে মুক্তিযোদ্ধারা একজন হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যকেও থাকতে দেবেনা।

আশাবাদী এই চিন্তার মাঝেই দেখলাম আমাদের ছোট হসপিটালের ডাক্তার আমার বোন নাসিমের দিকে দৌড়ে আসতে, সাহায্যের জন্য। আমরা তিন বোন তাকে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম। মর্টার আর মেশিনগানের শব্দ এতো কাছে চলে এসেছিলোযে আমরা ভেবেছিলাম সেগুলো আমাদের আহত ভাইদের উপর এসে পড়বে। এই ভয়াবহ যুদ্ধ চলেছিল আরও ২দিন। কিন্তু আমাদের সাহসী যুবকরা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলো কারণ পাকিস্তানি বাহিনীর ছিলো তিন গুন শক্তিশালী, সাথে অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।

কিছুদিন পর, ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে বয়ে চলা ছোট্ট ঝিরির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখতে পেলাম বন্য বর্বর হানাদার বাহিনী আমাদের দেশের কাঁঠাল খাচ্ছে। তাদেরকে শেষবারের মতো এই ফল খেতে দাও, কারণ তারা আর জীবনে কোনদিন এই সুযোগ পাবেনা।

আমাদের প্রিয় বাবা আর ভাইরা অবশ্যই এই বর্বর ইয়াহিয়ার ছেলেদের ফেরত পাঠাবে এবং আর কোনদিন যেন ফিরে আসতে না পারে এমনভাবেই ফেরত পাঠাবে। এবং আমি নিজেও এই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যদি সুযোগ পাই কমপক্ষে একজন পাকিস্তানি হানাদারকে হত্যা করবো, আমাদের দেশের শান্তিকামী প্রিয় নারী পুরুষ আর শিশু হত্যার প্রতিশোধ নিতে।

আমার মা এবং বোনরা নির্যাতিত হয়েছিল তাদের কাছে। আমি, বাংলাদেশের একটি মেয়ে হিসেবে, কখনো পাকিস্তানি বাহিনীর উপর প্রতিআঘাতের সুযোগ ছেড়ে দেবনা।

Scroll to Top