<১০, ১৪.৫, ৩৫৭-৩৬৪>
৭নং সেক্টর আওতাধীন বগুড়া জেলায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা
পশ্চিমবঙ্গ হইতে সামরিক ট্রেনিং লইয়া সাইফুল ইসলাম বগুড়া জেলার পূর্বাঞ্চলে ফিরিয়া আসে। সাইফুলের নেতৃত্বে পরিচালিত গেরিলা দল জুলাই মাসে ধুনট থানা আক্রমণ করে। থানাতে বেশ কিছু সংখ্যক পাঞ্জাবী পুলিশ ছিল। এই অতর্কিত হামলায় ৭ জন পাঞ্জাবী পুলিশ নিহত হয় এবং গেরিলা দল পূর্ব বগুড়ার কয়েকটি সামরিক কনভয় এবং হানাদার সৈন্য বোঝাই ট্রেনের উপর আক্রমণ চালায়।
জুলাই মাসে গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হারুনুর রশিদের দল ভেলুরপাড়া রেল স্টেশনে সিচারপাড়ার উত্তর ধারে মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া একটি মিলিটারী স্পেশাল ট্রেন বিধ্বস্ত করার ফলে চারজন অফিসারসহ সাতাশজন পাকসৈন্য নিহত হয়।
৭ই আগষ্ট সকাল ৮টা ৩০ মিনিটের সময় ৭ নম্বর সেক্টরের গেরিলা প্রধান আহসান হাবিব (ওয়ালেস) – এর নেতৃত্বে তাহার দল সাবগ্রামে এএকটি মাইন বিশস্ফোরণ ঘটাইয়া একটি মিলিটারী লরী সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে। ঘটনাস্থলেই তিনজন পাকসৈন্য নিহত ও একজন আহত হয়। পুনরায় ৯ই আগষ্ট তারিখে বেলা ১১টার সময় পাক সৈন্যরা বিধ্বস্ত লরীটি উদ্ধার করিতে যায়। ঐ দিনই মাইন বিস্ফোরণের ফলে ৫ জন পাকসৈন্য নিহত ও ৬ জন আহত হয়।
বগুড়া শহরেরে ওয়াপদা পাওয়ার হাউস সাব-সেকশন উড়াইয়া দেওয়ার অভিপ্রায়ে সাইফুল ইসলাম মাত্র দুইজন সঙ্গী লইয়া ১১ই আগষ্ট হাটসেরপুর হইতে বগুড়া শহরের দিকে রওনা দেয়। তাহারা ৯ ঘটিকায় মাদলার ঘাটে আসিয়া পৌঁছে। তখন কোন নৌকা না থাকায় কলাগাছের ভেলা তৈয়ারী করিয়া ৩ জন সূর্যসৈনিক করতোয়া নদী পার হয়। পরিকপ্লিত পথে মালগ্রামের ভিতর রাতের অন্ধকারে অগ্রসর হইতে থাকে। হানাদার বাহিনী প্রহরীররা তাহাদিকে চিনিয়া ফেলে। আত্মরক্ষার কোন পথ নাই জানিয়া সাইফুলেরা হানাদার বাহিনীর দিকে গ্রেনেড ছুড়িয়া মারে। হানাদারদের রাইফেল তখন গর্জিয়া ওঠে। তিনজনি অন্ধকারের মধ্যে তিনদিকে দৌড় দেয়। খান সেনাদের এলোপাতাড়ি গুলি আসিয়া সাইফুলের মাথায় লাগে। সাইফুল তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটাইয়া পড়ে। অর্ধমৃত অবস্থায় হানাদার বাহিনী সাইফুলকে ধরিয়া ফেলে।
আগষ্ট মাসের মধ্যভাবে একদিন রাত্রি তিন ঘটিকার সময় গেরলা বাহিনী কর্তৃক বগুড়া- সারিয়াকান্দি রাস্তায় লাঠিমাররঘোন গ্রামের নিকটবর্তী ব্রীজটি ডিনামাইট দ্বারা উড়াইয়া দেয় এবং ব্রীজের দুই ধারে ৫০/৬০ গজ দূরে মাইন মাটির নীচে পুঁতিয়া রাখিয়া তাহারা চলিয়া যায়। পরের দিন সকালে ব্রীজের দুই ধারে পশ্চিম দিকের মাইনটি পাকসেনারা সন্ধান পাইয়া তুলিয়া নিয়ে যায় কিন্তু পূর্ব দিকের মাইনটির সন্ধান পায় নাই। তার পরের দিন ভোরে কয়েকটি গরুর গাড়ি পাট লইয়া গাবতলী বন্দরে যাইতেছিল। একটি গরুর গাড়ীর চাপ মাইনের উপর পড়িলে মাইনটি বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে গাড়ীটি ছিন্নভিন্ন হইয়া উড়িয়া যায়। একজন গাড়োয়ান সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যূবরণ করে। আর একজন গুরুতররূপে আহত হয়। এর পরের দিন সারিয়াকান্দি ক্যাম্প হইতে পাকসেনারা আসিয়া ব্রীজের অবস্থাদৃষ্টে লাঠিমাররঘোন গ্রামে প্রবেশ করিয়া গ্রামের লোকদিগকে অমানুষিকভাবে মারপিট করে এবং কয়েকটি বাড়িতে আগুন লাগাইয়া পুড়াইয়া ফেলে। তৎপর তাহারা কালুডাঙ্গা, শাহবাজপুর এবং সাতটিকরি গ্রামে প্রবেশ করিয়া কতকগুলি বাড়ি আগুন লাগাইয়া ভস্মীভূত করে। এই ব্রীজ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করিয়া বর্বর পাক বাহিনী লাঠিমারঘোন গ্রামে পরপর তিনবার প্রবেশ করিয়া বাড়িঘর লুটপাট করে।
১৬ই আগষ্ট সৈয়দ ফজলুর আহসান দিপুর দল সারিয়াকান্দি থানার নিকটবর্তী রামচন্দ্রপুর গ্রামে পাক বাহিনীর সহিত এক ভীষণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। প্রচুর গোলাগুলির পর ময়নুল হক নামে সারিয়াকান্দি থানার এক দারোগা, ৫ জন পাক সৈন্য ও কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়।
আগষ্ট মাসের মধ্যভাগে কমান্ডার আবুল হোসেন (বালুরঘাট), মোস্তফা রেজানুর (দিনাজপুর), এস, এম, ফারুক (বগুড়া), প্রভৃতির দ্বারা হিলিতে ট্রেন অপারেশন হয়। ইহার ফলে বহুসংখ্যক এবং কিছু সংখ্যক অবাঙ্গালী নিহত হয়। লাইন অপারেশনের সময় আবুল হোসেন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়।
আগষ্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্বে গেরিল দল বগুড়া-সারিয়াকান্দি রাস্তার একটি ব্রীজে এক্সপ্লোসিভ লাগাইয়া সম্পূর্ণ ধ্বংস করে এবং ব্রীজের এক মাইল দূরে রাস্তায় মাইন পুঁতিয়া রাখে। পরে মাইন বিস্ফোরণে একটি মিলিটারী জীপগাড়ী ধ্বংস হওয়ার ফলে একজন অফিসারসহ ৬ জন পাক সৈন্য নিহত হয়।
২০শে আগষ্ট মাসুদ হোসেন আলমগীর নবেলের দল সারিয়াকান্দি থানার আওলাকান্দী গ্রামের পূর্বে যমুনা নদীতে একটি মিলিটারী লঞ্চ রকেট দ্বারা বিধ্বস্ত করে।
২রা সেপ্টেম্বর বর্বর পাকবাহিনী গাবতলী থানার জাত হলিদা গ্রাম অতর্কিত আক্রমণ করে। তখন সৈয়দ আহসান হাবিব দিপুর দল পালটা গুলিবর্ষণ করার ফলে একজন পাকসৈন্য নিহত হয়। পাকসৈন্যরা নিরীহ ৫ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। পরে সমস্ত গ্রামটাই আগুন জ্বালাইয়া পোড়াইয়া দেয়।
৪ঠা সেপ্টেম্বর ৬ জন পাক পুলিশ খাদ্য লইয়া বগুড়া হইতে সারিয়াকান্দি যাইতেছিল। পথে পাক পুলিশেরা যখন ফুলবাড়ি ঘাটে খেয়া নৌকায় উঠে তখন মোফাজ্জল হোসেন (লাঠিমারঘোন), গোলাম জাকেরিয়া রেজা (ধাওয়া) সাইদুল ইসলাম (বাইগুলি), মন্টু (হুমাকুয়া) এবং গেরিলাবাহিনীর সৈয়দ আহসান হাবিব দিপুর নেতৃত্বে নৌকা মাঝনদীতে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তাহারা রাইফেল, মেশিনগান দ্বারা গুলিবর্ষণ করিতে থাকে। ফলে দুইজন পুলিশ নিহত হয়। আর ৪ জন জীবন্ত অবস্থায় দৌড়াইয়া পালাইয়া যাইবার কালে ধড়া পড়ে। জনগণ তাহাদিগকে লাঠিসোটার দ্বারা পিটাইয়া হত্যা করে। পাক পুলিশদের রাইফেল ও কিছু খাদ্য সামগ্রী মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
গেরিলা বাহিনী কমান্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্ব সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৭নং সেক্টর হেড কোয়ার্টার থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ নৌকা পথে আনিবার কালে বাহদুরাবাদ ঘাটের নিকট সশস্ত্র সংঘর্ষে শত্রুদের একটি টহলদার গানবোট সম্পূর্ণ ধ্বংস করিয়া দেয়।
১৮ই সেপ্টেম্বর ই-পি-আর কমান্ডার সালেক (বগুড়া), বেঙ্গল রেজিমেন্টের মান্নান, ঢাকা পুলিশের হাবিলদার রজব আলী এবং ছাত্র রঞ্জি কুমার মহন্ত, প্রদীপ কুমার কর (গোবিন্দগঞ্জ) প্রভৃতির নেতৃত্বে হিলির পার্শ্ববর্তী স্থানে পাকহবাহিনির সহিত ভীষণ সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষে পাকবাহিনীর বহু সৈন্য হতাহত হয়। ঘোড়াঘাটের ফিলিপস-এর (সাঁওতালী) নেতৃত্বে মাইন বিস্ফোরণে পাকসেনাদের একটি বেডফোর্ড মটর কার ভীষণভাবে ধ্বংস হয়।
গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সুফীর নেতৃত্বে ১৯শে সেপ্টেম্বর সারিয়াকান্দি থানার তাজুরপাড়া গ্রাম অনুপ্রবেশকারী একদল পাকবাহিনীকে ঘেরাও করা হয়। প্রচন্ড গোলাগুলির পর ঘটনাস্থলে শত্রুপক্ষের কতক সেনা নিহত ও বাকী সেনা পলায়ন করিতে বাধ্য হয়।
২৪শে সেপ্টেম্বর আহসান হাবিব ওয়ালেসের নেতৃত্বে বেলা দুপুর সাড়ে বারোটার সময় হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করিলে সুখনাপুকুর রেলস্টেশন গৃহে আগুন ধরিয়া যায় এবং তাহাতে টেলিফোন লাইন নষ্ট হয়। একটি রাইফেল ও কিছু গুলি, সাত জোড়া পাকসেনার পোশাক উদ্ধার করা হয়। কিছু সৈন্য ও রাজাকার পালাইতে সক্ষম হয়।
২৭শে সেপ্টেম্বর কমান্ডার মোত্তালিব এবং কমান্ডার এস, এম ফারুকের নেতৃত্বে হিলিতে পাকবাহিনীর সহিত প্রচন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আড়াই ঘন্টা যাবত যুদ্ধ চলিতে থাকে। কমান্ডার মোত্তালিব মর্টারের গুলিতে আহত হয় এবং ৪ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। ঐ সময় বগুড়ার এক ১৪ বৎসরের অসমসাহসী ছেলে সাইদুর রহমান (চুটকু) হিলি স্টেশনে রেললাইনের মাইন বিস্ফোরণ ধ্বংস করিয়া দেয়। সেইদিন রেল চলাচল সম্পূর্নরূপে বন্ধ হইয়া যায়। এই ঘটনায় একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন আসাম রেজিমেন্ট ও বর্ডার সিকিউরীট ফোর্স।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষভাগে মুক্তিবাহিনী নশরতপুর রেলস্টশনের পশ্চিম ধারে একটি এন্টি-ট্যাঙ্ক মাইন পুঁতিয়া রাখে। তাহার বিস্ফোরণে একটি মিলিটারী ট্রেন আক্রান্ত হয়। ফলে হানাদার পাকবাহিনী ক্ষিপ্ত হইয়া লাইনের ধারের লক্ষীপুর, পূর্ব ডালম্বা, কোটকুরী ও শিতলাই গ্রাম আক্রমণ চালায় এবং কফিরউদ্দিন মিস্ত্রী, আবেদ আকন্দ, আজিজ প্রাং (লক্ষীপুর), মহীরউদ্দিন প্রাং (পূর্ব ডালম্বা), ভোলা প্রাং, কোরবান আলী (কোচকুরী), শরিফউদ্দিন সরকার (শিতলাই) প্রভৃতি লোকদিগকে লাইন করিয়া গুলি করিয় হত্যা করে।
অক্টোবর মাসের প্রথম ভাগে গাবতলী থানার শিহিরপুর গ্রামে সরকার বাড়িতে মুক্তিবাহীনী ঘাঁটি ছিল। মুক্তিবাহিনী রাত্রি নয় ঘটিকায় সরকার বাড়ির পিছনে রেললাইনে একটি মাইন পুঁতিয়া রাখে। কারণ মুক্তিবাহিনী জানিতে পারে যে সৈয়দপুর হইতে বোনারপাড়া জংশন হইয়া একটি সৈন্যবাহী ট্রেন আসিতেছে। সেই ট্রেনটি ধ্বংসই তাহাদের লক্ষ্য ছিল কিন্তু ১৫ মিনিট পূর্বেই মাইনটির বিস্ফোরণ ঘটে। সেই সৈন্যবাহী ট্রেনটি ঐদিন আর আসে না।
পরের দিন রাত্রী ১১টার সময় সৈন্যবাহী ট্রেনটি সুখানপুকুর স্টেশন অতিক্রম করিবে জানিতে পারিয়া মুক্তিবাহিনী সরকার-বাড়ির অর্ধ মাইল দক্ষিণে মাইন পুঁতিয়া রাখে। মাইন বিস্ফোরণে সৈণ্যবাহী ট্রেনটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ফলে ৪ জন পাক ইঞ্জিনিয়ারসহ ১৪৬ জন পাকসেনা নিহত হয়।
অক্টোবর মাসের মধ্যভাগে ওয়াপদার নিকট কৈচোর রেললাইনের ব্রীজের দুই পাশে মাসুদ হোসেন আলমগীর (নোবেল) মাত্র ৬ জন সঙ্গী লইয়া পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। বহু গুলি বিনিময়ের পর ৬ জন খানসেনা ও ১০ জন রাজাকার নিহত হয় এবং কতকগুলি পাকসৈন্য অস্ত্রশস্ত্র ফেলিয়া কাহালুর দিকে পালাইতে বাধ্য হয়।
অক্টোবর মাসের মধ্যভাগে মুক্তিবাহিনীর দল গাবতলী থানা জয়ভোগা গ্রামের নিকটস্থ সারিয়াকান্দি রোডের উপর মাইন পুঁতিয়া রাখিয়া যায়। পরে তাহা বিস্ফোরণ ঘটিয়া ৫ জন পাকসৈন্যের মধ্যে ৩ জন নিহত ও ২ জন আহত হয়।
১৮ই অক্টোবর বগুড়া শহরের পশু ডাক্তার থানা নিকটস্থ ট্রান্সমিটারটি গ্রেনেড দ্বারা ধ্বংস করিবার জন্য গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। ট্রান্সপিটার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পার্শবর্তী দোকানদার মুন্সি নজরুল ইসলামকে বর্বর হানাদারবাহিনী ধরিয়া ক্যাম্পে লইয়া যায়। ৪ দিন অমানুষিক নির্যাতন করার পর মুক্তি দেয়।
২০শে অক্টোবর নারচী ও পার্শ্ববর্তী গণকপাড়া গ্রামে পাকসৈন্যদের সহিত গেরিল বাহিনীর চারটি দলের এক ভীষণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে সকাল ৭টা হইতে পরের দিন সকাল ৭টা পর্যন্ত চলে। এইসব দলের মধ্যে তোফাজ্জল হোসেন মকবুল (চরহরিণ), সৈয়দ ফজলুল আহসান দিপু, শোকরানা (রানা), আবদুস সালাম (বুলবুল), রেজাউল বাকী, গোলাম মোস্তফা (গাবতলী), কামাল পাশা (বৃন্দাবনপাড়া), রিজাউল হক মঞ্জু (ধাওয়া), স্বপন এবং হুয়াকুয়ার রেজাউল করিম মন্টু, আখতার হোসেন বুলু, আতোয়ার হোসেন গামা, আব্দুর রাজ্জাক হানজু, আবদুল বারী ও আরও অন্যান্য গেরিলাদের সহিত পাকবাহিনীর প্রচন্ড গোলাগুলি বিনিময় হয়। সেই সময় গ্রামের নারী পুরুষ নির্বিশেষে জীবনের ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে গ্রাম ছাড়িয়া পালাইতে থাকে, তখন এলোপাতাড়ি গুলি চলিতে থাকে। পাকসেনার দল দিপুর দলকে ঘিরিয়া ফেলে। উপায়ান্তর না দেখিয়া দিপুর দল গ্রেনেড নিক্ষেপ করিয়া ধুম্রজাল সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়। তৎপর গণকপাড়া ঈদগাহ মাঠে গেরিলাবাহিনী পজিশন লইয়া তুমুল গোলাগুলি বর্ষন করতে থাকে। পাকসৈন্যরা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র দ্বারা প্রবল আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে গেরিলা বাহিনী টিকতে না পারিয়া অবস্থান পরিবর্তন করিতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় বহু বাড়ি জ্বালাইয়া-পোড়াইয়া দেয়। এদিকে শোকরানা রানার দল ও অন্যান্য দলের ৫০/৬০ জন্য গেরিলা যোদ্ধা টিউরপাড়া গ্রামের দিকে অগ্রসর হইয়া পজিশন নেয়। হানাদার বাহিনীর সহিত গেরিলাবাহিনীর পালটা গোলাগুলি চলিতে থাকে। ঐসময় হানাদারবাহিনীর টিউরপাড়া গ্রামের ১২ জন গ্রামবাসীকে গুলি করিয়া হত্যা করে। গেরিলাবাহিনীর গোলাগুলিতে পাকবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ৯ জন নিহত হত। তৎপর সারা রাত্রি পাকবাহিনীর সহিত গেরিলাবাহিনী বাঁশগাড়ি ও নারচীতে প্রচন্ড গোলাগুলি চলার পর ভোরবেলা পাকবাহিনী ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ন করে। এই ঘটনার দুই দিন পরে তিন দিক হইতে পাকসেনা নারচী গ্রামে প্রবেশ করিয়া গ্রামের বহু বাড়িঘর পুড়িয়া ভস্মীভূত করে।
১০ই নভেম্বর নারচীর আবদুল হাসিম বাবলুর দল বগুড়া সারিয়াকান্দি রোডের বাইগুনী গ্রামে মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া কর্নেলসহ ৫ জন পাকসৈন্য নিহত করে। ঐ দিন গেরিলাবাহিনীর কমান্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সূফীর নেতৃত্বে বগুড়া শহরের নিশিন্দারায় ১১ হাজার কিলোওয়াট ভোল্টের ট্রান্সমিটার ধ্বংস করা হয়।
১২ই নভেম্বর ইন্ডিয়ান মারহাট্টা রেজিমেন্ট, আসাম রেজিমেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধারা হিলি সীমান্তে পাকহাবিনীর সহিত মোকাবিলা করার জন্য উপস্থিত হয়। হিলিতে পাকবাহিনী তখন ঘোড়াঘাট হইতে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স আনিয়া পালটা আক্রমণ করিবার প্রস্তুতি নেয়। তখন ৬নং আসাম রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন রায়সিং ডোগরা ও মুক্তিযোদ্ধা এস,এম, ফারুক (বগুড়া), আবুল কাশেম (জয়পুরহাট), মোজাহার (গাবতলী), মোস্তফা রেজানুর (দিনাজপুর) দলের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর সহিত প্রবল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে বহু পাকসৈন্য ও কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়। পাকসৈন্যদের সঙ্গে মেশিনগান, ভারী কামান, ট্যাঙ্ক এবং বিমানবিধ্বংসী কামান ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে স্টেনগান, টমিগান, রাইফেল প্রভৃতির দ্বারা যুদ্ধ চলে। ঐদিন বিমান হইতে প্রচন্ড বোমাবর্ষন হয়।
১৩ই নভেম্বর মহিমাগঞ্জের দুলুর নেতৃত্বে ও সিহিপুরের বাবলু, খালেক, হামিদ, খলিল, নুরুল, শুকু ফিনু, জগলু, হাল্লু, লিন্টু ও আরও অনেকের সহযোগিতায় সুখানপুকুর রেল স্টেশনের ধারে শিহিপুরের নিকট একটি পাকসৈন্যবাহী স্পেশাল ট্রেন ডিনামাইট দ্বারা ধ্বংস করিয়া দেয়। ফলে প্রায় দেড়শত পাকসৈন্য মৃত্যুবরণ করে।
১৫ই নভেম্বর গেরিলা বাহিনী কমান্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সুফির নেতৃত্বে সুখানপুকুর রেলস্টেশনে শত্রুদের খাদ্যবাহী একটি ট্রেন মাইন বিস্ফোরণ ঘটাইয়া ধ্বংস করে।
২৫শে নভেম্বর গাবতলীর নিকটস্থ জয়ভোগ গ্রামের রেলওয়ে ব্রীজ পাকবাহিনীর নিকট হইতে দখল করিবার জন্য একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকসৈন্যদিগকে আক্রমন করিয়া গুলি বিনিময় করিতে থাকে। ফলে পাকসৈন্যরা গাবতলী থানাস্থ ক্যাম্পের দিকে পলায়ন করিতে বাধ্য হয়। দুই ঘন্টা পর পাকসৈন্য বোঝাই একটি ট্রেন গাবতলী স্টেশনে থামিলে পাকসৈন্যরা ট্রেন হইতে নামিয়া জয়ভোগা ও বইগুনী গ্রামের দিকে গুলিবর্ষণ করিতে করিতে অগ্রসর হয়। ফলে বাইগুনী গ্রামের আবুল হোসেনসহ কয়েকজন গ্রামবাসী গুলির আঘাতে নিহত হয়। পরে নেপালতলী গ্রামের দিক হইতে গেরিলাবাহিনীর একটি দল আসিয়া পালটা আক্রমন করিবার ফলে পাকসৈন্যরা গাবতলী ক্যাম্পে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য হয়।
২৮শে নভেম্বর সারিয়াকান্দি থানা আক্রমণ করা হয়। এক আক্রমণের নেতৃত্ব দেয় নারচীর আবদুল হাসিম বাবলু, আবদুর রশিদ, চরহরিণার তোফাজ্জেল হোসেন মকবুল, হুয়াকুয়ার আবদুর রাজ্জাক, রামচন্দ্রপুরের মহসিন। মৌরের চরের সরুজ্জামান। ৭নং সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা দল ও গেরিলাবাহিনী প্রবল গোলাবর্ষণ করে। পাকবাহিনী পালটা আক্রমণ চালাইবার ফলে দুইজন পাকসৈন্য নিহত হত। গেরিলাবাহিনী অদম্য সাহসে মাতৃভূমির পাবিত্র মাটি থেকে বর্বর পাকবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার দৃপ্ত পণ লইয়া যুদ্ধ করিতে থাকে। বেলা ১১টার সময় ব্রাশফায়ারে কয়েকজন পাকসৈন্য মাটিতে পড়িয়া যায়।
পরের দিন সকাল ৮টায় গেরিলা বাহিনী সারিয়াকান্দী থানা পুনঃ আক্রমণ করিয়া ৪৪ জন রাজাকারকে নিহত করে। থানার অফিসার ইনচার্জসহ ১৮ জন পাকসৈন্য নিহত হয়। এই প্রচন্ড গোলাগুলির ফলে গেরিলা বাহিনীর ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। সমস্ত দিবারাত্রি প্রচন্ড গোলাগুলি চলিতে থাকে।
গেরিলা বাহিনীর খাদ্য ও পানীয় সরবরাহে কোন অসুবিধা হয় নাই। পার্শ্ববর্তী গ্রামের জনসাধারণ স্বতঃফূর্ত হইয়া খাদ্যদি সরবরাহ করিতে থাকে। পরিশেষে রাজাকার ও পুলিশেরা আত্মসমর্পন করে। কিছু সংখ্যক পুলিশ অন্ধকারে গ্রামের দিকে পালাইয়া প্রাণ রক্ষা করে। গেরিলা বাহিনীর যে ৩ জন শহীদ হয় তাহার হইতেছেন বালিয়ার তাইরের মমতাজ উদ্দীন, সাত বেকীর মোজাম্মেল হক ও আর একজন। এই প্রচন্ড যুদ্ধে সারিয়াকান্দি থানা দখল হয়। গেরিলা বাহিনী কর্তৃক ৫৩ জন রাজাকার ও ১৯ জন পুলিশ বন্দী হয়। ১৯ জন রাজাকারকে গুলি করিয়া হত্যা করে। গেরিলা বাহিনী ১১৮টি রাইফেল, ৪২টি এলএমজি, ১টি রিভলবার, ১টি গ্রেনেড ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করে। ঐদিন বিমান আক্রমণ হয়, তাহার ফলে কয়েকজন জনসাধারণ নিহত হয়। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দীনের দল এই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে।
নভেম্বর মাসের শেষভাগে পাকসৈন্যরা ভেরুরপাড়া রেলস্টেশনে যাইবার কালে পথিমধ্যে ট্রেন থামাইয়া জোড়গাছা গ্রামের কতকগুলি বাড়িতে আগুন জ্বালাইয়া দেয়। সংবাদ পাইয়া পার্শ্ববর্তী গ্রাম হইতে মুক্তিযোদ্ধা দল আসিয়া হানাদার বাহিনীকে ঘিরিয়া ফেলিয়া গোলাগুলিবর্ষন করিতে থাকে। পাক সৈন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া দৌড়াইয়া ভেলুরপাড়া স্টেশনে বাঙ্কারে আশ্রয় লয়। মুক্তিযোদ্ধাগণ সেখানেও তাহাদিগকে ঘিরিয়া ফেলিয়া গুলিবর্ষন করিতে থাকে। ফলে ৪ জন পাক সৈন্য নিহত হয়।
পরের দিন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হুয়াকুয়ার রেজাউল করিম মন্টুর নেতৃত্বে আব্দুস সালাম, আতোয়ার হোসেন প্রভৃতি এবং স্থানী গেরিলা বাহিনী ও জনসাধারণ রেল স্টেশনটি পোড়াইয়া দেয়। পরে চকচকে ব্রীজ সম্পূর্নরূপে ধ্বংস করিয়া ফেলে। তৎপর রেলওয়ে স্লিপার উঠাইয়া রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয়।
ডিসেম্বর মাসের প্রথমভাগে রংপুর পলাশবাড়ী হইতে পলাতক একদল শত্রুসৈন্য গাবতলী থানার রামেশ্বরপুর গ্রামে প্রবেশ করিয়ে গ্রামবাসীর উপর অত্যাচার শুরু করে। পার্শ্ববর্তী গ্রাম জাগুলির প্রাক্তন সৈনিক গোলাম ছারওয়ার খানের নেতৃত্বে তাহার দল প্রতিরোধ আক্রমণ চালায়। ইহাতে প্রচুর গোলাগুলির বিনিময় হয় ফলে ২ জন শত্রুসৈন্য নিহত, ২ জন শত্রুসৈন্য আহত এবং ১২ জন্য পাকসৈন্য আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়। এই ঘটনার পূর্ব দিন সকাল বেলা পীরগাছা মিলিটার ক্যাম্প হইতে একটি সৈনিক প্রাণের ভয়ে পালাইয়া আসিলে লস্করী পাড়ার নিকটস্থ জেলা বোর্ডের রাস্তার ব্রীজের নিকট শফিউল আলম স্টেনগানের গুলিতে তাহাকে নিহত করে। ঐদিন মহাস্থান হইতে ৫ জন হানাদার সৈন্য পালাইয়া আসিবার কালে গাবতলী থানার কদমতলী গ্রামে প্রবেশ করিবার সময় ৭ জন গ্রামবাসীকে গুলি করিয়া হত্যা করে। ঐ সময় চরহরিণার তোফাজ্জল হোসেন মকবুল ও তাহার দল ৫ জন পাক সৈন্যকে ধরিয়া ঘটনাস্থলেই গুলি করিয়া হত্যা করে।
৪ঠা ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার জাহেদুর রহমান (বাদল) ও আরও অনেকে রংপুর জেলার ভরতখালি বাঁধের পার্শ্বে পাকসৈন্যদের সহিত এক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ফলে রাজাকারসহ ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে জাহেদুর রহমানসহ ৫ জন শহীদ হয়। এই ৫ জনের লাশ ভরখালী স্কুল প্রাঙ্গণে কবরস্থ করা হয়।
৬ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার আবুল হোসেন (কলসা) এর নেতৃত্বে তাহার দল পাকহানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে। তুমুল লড়াইয়ে পর পাক সৈন্যরা নঁওগা অভিমুকে পশ্চাদপসরণ করে। কিছু সংখ্যক পাকসৈন্য হতাহত হয়।
১০ই ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী সম্মিলিত বিমান আক্রমণে সান্তাহার রেলওয়ে জংশন পাওয়ার হাউস মেকানিক্যাল ওয়ার্ক্স ও রেলওয়ে জংশন লোকোশেডের উপর বোমাবর্ষণ করে। ফলে কিছু পাকসৈন্য হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর আনসার আলী নামে একজন বিমান কর্মচারী আহত হন।
১২ই ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনী রংপুরের পলাশবাড়ী অতিক্রম করার পর পাকসৈন্য ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়ে। তাহারা বগুড়া শহরের এতিমখানা হইতে অনবরত শেলবর্ষণ করিতে থাকে। তাহার ফলে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহের বহু লোক হতাহত হয়। উপর হইতে ভারতীয় বিমান বাহিনী ঘন ঘন বোমাবর্ষন করিতে থাকে। তখন পাকসৈন্যরা বাঙ্কারে লুকাইয়া পড়ে। কিছু পাকসৈন্য পালাইয়া গ্রামের দিকে ধাবিত হয়। গ্রামবাসী তাহাদিগকে ধরিয়া যে যেখানে পারে হত্যা করে।
১৩ই ডিসেম্বর কিছু সংখ্যক সৈন্য জয়পুরহাট হইতে পালাইয়া আসিয়া সদর থানার সরলপুর গ্রামের পাঁচ পীরের দরগায় আশ্রয় নেয়। মুক্তিফৌজের কমান্ডার আবদুস সোবহান খান বাবুল ও তাহার দল জানিতে পারিয়া তাহাদিগকে ঘেরাও করিয়া ফেলে। মুক্তিফৌজের সহিত প্রচন্ড গোলাগুলিতে দুইজন মুক্তিসেনা ঘটনাস্থলে শহীদ হন। তন্মধ্যে ছিলেন মুক্তিফৌজের কমান্ডার আবদুস সোবহান খান বাবুল।পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজন দা, কুড়াল খন্তা প্রভৃতি অস্ত্র লইয়া আসিয়া পাক বাহিনী সমস্ত সৈন্যকে হত্যা করে।
ঐদিন গাবতলী থানার কদমতলী গ্রামে পীরগাছা মিলিটারী ক্যাম্প হইতে কয়েকজন পাকসৈন্য পালাইয়া আসিবার সময় কদমতলী গ্রামের রহিমউদ্দিন প্রামানিক নামে একজন লোক ভিটার মধ্যে মিলিটারীর ভয়ে হামাগুড়ি দিয়া লুকাইয়া থাকে। তখন একজন মিলিটারী তাহার পিঠে গুলি করে। তাহার পাশেই গোবর্ধন রবিদাস নামে একজন মুচিকে গুলি করিয়া হত্যা করে। নিকটস্থ গেরিলা বাহিনী আসিয়া তাহাদিগকে ঘিরিয়া ফেলে।
প্রচন্ড গোলাগুলি হওয়ার পর পাকসৈন্যদের একজন নিহত হয়। বাকী পাক সৈন্যরা একটি গর্তের মধ্যে লুকাইয়া পড়ে। পরে তাহারা সন্ধ্যার পর পালাইয়া যায়। ঘটনাস্থলে সারিয়াকান্দি থানার বোহালী গ্রামের রফিক নামের একজন মুক্তিসেনা শহীদ হন। এই প্রচন্ড লড়াইয়ে হাট ফুলবাড়ি, জাতহলিদা, বাইগুলি ও নারচী গ্রামের গেরিলা বাহিনী অংশ নেয়। পাক সেনারা মৃত দেহটি পরে নারচীরে গেরিলা দল মহিষের গাড়ী করিয়া লইয়া যাইয়া নারচীর সমুখস্থ বাঙ্গালী নদীতে ফেলিয়া দেয়। দীঘলকান্দির চান্দ কশাই ও চরকাধিকার একজন গ্রামবাসী পাক বাহিনীর গুলিতে মৃত্যূবরণ করে।
১৩ই ডিসেম্বর বর্বর পাক বাহিনীর সবিত মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সহিত হিলি সীমান্তে এক তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ছিল মেশিনগান, ভারী কামান, ট্যাঙ্ক এবং বিমানবিধ্বংসী কামান ও বোমা। আমাদের বাংলাদেশের কতকগুলি দামাল ছেলের সঙ্গে ছিল, সামান্য স্টেনগান, এসএলআর রাইফেল, এলএমজি আর পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ছিল কতকগুলি মানব হত্যার মারণাস্ত্র।
এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হইয়াছিল আলম বাহিনী, সেলিম বাহিনী এবং এবাদ বাহিনী। প্রথম মিত্রবাহিনী পাকসৈন্যদের উপর বিমান থেকে গুলি বর্ষন করিতে থাকে। তারপর শুরু হয় এক ঐতিহাসিক তুমুল যুদ্ধ। পৃথিবী থাকিবে, বাংলাদেশ থাকিবে, তাহার সহিত এই হিলির যুদ্ধ চিরদিন বাংলার ইতিহাসের পাতায় লিখা থাকিবে। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর সাতশত সৈন্য নিহত এবং কতকগুলি অস্ত্রশস্ত্র, ট্যাঙ্ক, মেশিনগানসহ আড়াইশত পাক সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর অল্পসংখ্যক যোদ্ধা হতাহত হয়। হিলি দখল করার পর বিবরঘাঁটি থেকে তিনশত নির্যাতিত নারীকে উদ্ধার করা হয়।
ঐদিন বগুড়ার পুলিশ লাইন হইতে অহরহ শেলবর্ষণ হইতে থাকে। শহরের এবং কলোনীর বিহারীরা ভীত সন্ত্রস্ত হইয়া যেখানে পারে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহন করে। পাকসৈন্যরা পরাজিত মনে করিয়া তাহার করতোয়া রেলওয়ে ব্রীজ ও ফতেআলী ব্রীজ ধ্বংস করিবার উদ্দেশ্যে ডিনামাইট পুঁতিয়া রাখে। ঐদিন মিত্র বাহিনীর একশত সাতাশটি ভারতীয় ট্যাঙ্ক ত্রিমুখী সাঁড়াশী আক্রমণ করিবার জন্য গাবতলী হইয়া মাদলার পথে এবং মহাস্তান ও দুপচাচিয়া হইয়া বগুড়া শহরের উপকন্ঠে আসিয়া পৌঁছে। তুমুল ট্যাঙ্ক যুদ্ধ ও বোমা বিস্ফোরণে সমস্ত শহর প্রকম্পিত হয় এবং আগুনের লেলিহান শিখা দৃষ্ট হইতে থাকে। দুই একটি বোমার আঘাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামের কিছু সংখ্যক লোক হত ও বাড়ীঘর বিধ্বস্ত হয়।
১৪ই ডিসেম্বর বগুড়া শহর হইতে পলাতক দুইজন পাকসৈন্য সদর থানার সাবরুল ইস্কুলের মাঠ দিয়া পালাইয়া যাইতেছিল। ঐ সময় গেরিলা বাহিনীর আনোয়ার হোসেন, রফিক ও আরও অনেকে এবং গ্রামবাসী লাঠিসোটা এবং বর্শা প্রভৃতি লইয়া তাহাদিগকে আক্রমণ করে। তাহাদিগকে ধরিয়া মারপিট করিয়া হত্যা করে।
১৫ই ডিসেম্বর পলাতাক পাকবাহিনী ও কিছু অবাঙ্গালী বগুড়া শহর হইতে পালাইয়া যাইবার সময় গোলাগুলি করিতে থাকে। তাহারা সহ হইতে একটি লরী লইয়া যাইতেছিল লরীটি বিকল হইয়া গেলে তাহার মার্চ করিতে পদব্রজে অগ্রসর হইতে থাকে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন গ্রাম হইতে মুক্তিবাহিনীর দল আসিয়া পালটা গুলিবর্ষন করিতে থাকে। ফলে মুক্তিবাহিনীর একজন শহীদ ও দুইজন আহত হয়। জানা যায়। ঘটনার কয়েকদিন পূর্বে পাকসৈন্যরা ডেমাজানী আসিয়া আকস্মিক গুলিবর্ষন করিতে থাকে। ফলে কমলরাজভর নামে একজন নিহত হয়। পরে পাকসেনারা ফিরিয়া যাইবার পথে আড়িয়ার বাজারে ডঃ ফনিন্দ্রনাথ দেব, সুরেশচন্দ্র পাল, শিরিষচন্দ্র পাল, খোকা বৈরাগী, তপেন্দ্রনাত পাল ও আরও কয়েকজনকে গুলি করে।
ঐদিন বৈকালে আনুমানিক ৪ ঘটিকার সময় ডিনামাইট বিস্ফোরণে করতোয়া রেলওয়ে ব্রীজ ও ফতেআলী ব্রীজ ধ্বংস হইয়া যায়। ঐদিন মিত্রবাহিনীর সহিত পাকসৈন্যদের তুমুল যুদ্ধ চলিতে থাকে। ফলে বহুসংখ্যক পাকসেনা হতাহত হয়। ঐ সময় ভারতীয় বিমান হইতে কয়েকটি ভারী বোমাবর্ষন হলে এতিমখানার নিকটস্থ স্থানের ঘরবাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং দুটি বৃহদাকার গর্তের সৃষ্টি হয়। পরের দিন ১৬ই ডিসেম্বর আনুমানিক তিন হাজার পাকসেনা সহ উচ্চপদস্থ অফিসারেরা মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়।
**এ, জে, এম, শামসুদ্দিন তরফদার-রচিত ‘দুই শতাব্দির বুকে’ বগুড়া, ১৯৭৬ থেকে সংকলিত।