৯৫। ১০ অক্টোবর সম্পাদকীয়ঃ সোভিয়েত ভারত যুক্ত বিবৃতি

এফ.এম. খান

<৬,৯৫,১৫২-১৫৩>

সংবাদপত্রঃ স্বাধীন বাংলা

তারিখঃ ১০ অক্টোবর, ১৯৭১

 

সোভিয়েত-ভারত যুক্ত বিবৃতি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাম্প্রতিক মস্কো সফর শেষে প্রকাশিত সোভিয়েত -ভারত যুক্ত বিবৃতিটি বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের গভীর ভ্রাতৃত্ববোধ ও দৃঢ় সমর্থনের পরিচায়ক। দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগন ইহাকে সঠিকভাবেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বপক্ষে একটি মস্তবড় ঘটনা হিসাবে গন্য করিয়াছেন এবং যুক্ত বিবৃতির প্রতি দ্ব্যার্থহীন অভিনন্দন জানাইয়াছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী পরিষদ ও সোভিয়েত ভারত যুক্ত বিবৃতিতে সন্তোষ প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেন যে,ইহার মধ্য দিয়া বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে সোভিয়েত সরকারের গভীর উপলদ্বির পরিচয় ফুটিয়া উঠিয়াছে।বাংলাদেশ সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের বরাত দিয়ে কোন কোন স্বার্থসন্ধানী মহল সোভিয়েত – ভারত বিবৃতিতে বাংলাদেশ সরকার হতাশ হইয়াছেন-এই মর্মে ইতিপূর্বে যে প্রচারণা চালাইয়াছিল বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র প্রকাশ্য বিবৃতি দ্বারা উহাকে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় খণ্ডন করিয়াছেন।

অবশ্য এই কথা ঠিক যে,সোভিয়েত -ভারত যুক্ত বিবৃতিতে  প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কে কূটনৈতিক স্বীকৃতি  দেওয়ার কথা এবং স্বাধীনতা ছাড়া বাংলাদেশ সমস্যার আর কোন গ্রহণযোগ্য সমাধান যে নাই তাহা স্পষ্ট করে বলা হয় নাই। কিন্তু ইহা হইতে একথা প্রমাণিত হয় না যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবির বিপক্ষে কিম্বা বাংলাদেশের উপর সোভিয়েত সরকার যেমন-তেমন ধরনের একটা রাজনৈতিক সমাধান চাপাইয়া দিতে চায়।

বাস্তব অবস্থা তাহা নয়।প্রথমত, সোভিয়েত -ভারত যুক্ত বিবৃতিতে প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমাধানের চরিত্র সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে।এই রাজনৈতিক সমাধানকে অবস্যই বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা অনপহরনীয় অধিকার ও আইনসঙ্গত স্বার্থের সহীত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইতে হইবে।ভাষ্যকারদের মতে অনপহরনীয় অধিকার বলতে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ এর অধিকারও  বুঝায়। বিশেষত বাংলাদেশের জনগণ তথা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ এবং বাংলাদেশ সরকার ও সর্বদলীয়  উপদেষ্টা পরিষদ যখন অপরিবর্তনীয়রূপে ঘোষণা করিয়াছেন যে,পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধান তাহাদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয় সেক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে মিমাংসা করিতে হইলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়াই উহা পদক্ষেপ নিয়াছে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ পরিষ্কারভাবে সেগুলিকে উপেক্ষা করিয়াছেন।

দ্বিতীয়, বাংলাদেশ সমস্যা ও ভারতে প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তর আশ্রয়গ্রহণ ও প্রভৃতির জন্য সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীকে দায়ী করিয়াছেন এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানার্থে আয়োজিত ভোজসভায় সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কমরেড কোসিগিন ইয়াহিয়া-চক্রকেই এই অবস্থার প্রতিকারের উদেশ্যে অবলিম্বে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহণ করিতে বলিয়াছেন।ইয়াহিয়া-চক্র বিশ্ববাসীকে ধোকা উদেশ্যে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় বেসামরিক ” গভর্নর ” নিয়োগ, “সাধারণ ক্ষমা”  ঘোষণা প্রভৃতি যেসব পদক্ষেপ নিয়াছে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ পরিষ্কারভাবে সেগুলিকে উপেক্ষা করিয়াছেন।

তৃতীয়ত,সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশ সংক্রান্ত বক্তব্য বা দৃষ্টিভঙ্গী যে অনড়-অচল নয়,গত কয়েক মাসে উহার পরিচয় পাওয়া গিয়াছে।এপ্রিল মাসে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান কমরেড পদগর্নি ইয়াহিয়া সরকারকে শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করার জন্য আবেদন জানাইয়া ছিলেন।উহার মধ্যদিয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য গভীর সহানুভূতি প্রকাশ পাইলেও তখনকার তুলনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্প্রতিক বক্তব্য অনেক বেশী সুনির্দিষ্ট ও বাংলাদেশের পক্ষে আরো অনুকূল।এমনকি সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনের পর নয়া দিল্লীতে স্বাক্ষরিত গ্রোমিকোশরন সিং যুক্ত ইশতেহারের সহিত যুক্ত বিবৃতিকে মিলাইয়া দেখিলেও সোভিয়েত দৃষ্টিভঙ্গীর গতিশীলতার পরিচয় পাওয়া যাইবে।গ্রোমিকো-শরন সিং যুক্ত ইশতিহারেও বাংলাদেশে “পূর্ব পাকিস্তান ” বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছিলো।আলোচ্য যুক্ত বিবৃতিতে তদস্থলে পূর্ব বাঙলা “ব্যাবহৃত হইয়াছে।যুক্ত ইশতেহারে” সারা পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হইয়াছে।সেখানে যুক্ত বিবৃতিতে পূর্ব বাংলার জনগণের ইচ্ছা,অনপহরনীয় অধিকার ও আইনসঙ্গত স্বার্থের” ভিত্তিতে সমাধানের কথা বলা হইয়াছে।কাজেই সোভিয়েত-ভারত যুক্ত বিবৃতির রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাবকে যাহারা বাংলাদেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া বলিয়া প্রচারণা চালাইয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত বিরোধী জিগির তুলিতেছেন তাহার হয় অন্ধ না হয় মতলববাজ।

সোভিয়েত ভারত যুক্ত বিবৃতি নিছক কথার কথা কিম্বা বাংলাদেশের প্রতি লোক দেখানো সহানুভূতি নয়।জাতিসংঘে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ইয়াহিয়া-চক্রের প্রতি ধিক্কার জানাইয়া বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমতকে সংগঠিত করিতেছে।সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মস্কোতে সাংবাদিকদের নিকট খোলাখুলিভাবে যাহা বলিয়াছেন (” আমাদের সহানুভূতি পূর্ব বাংলার নিপীড়িত  জনগণের প্রতি,উৎপীড়কের প্রতি নয়”) জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে উহার সহিত সঙ্গতিপূর্ণ বাস্তব কার্যক্রম দেখা যাইতেছে।বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মুক্তির যে দাবী যুক্ত বিবৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করিয়াছে,সোভিয়েত ইউনিয়ন সে দাবীতে বিশ্বজনমত গড়িয়া তুলিতেছে।সোভিয়েতের বিভিন্ন সংগঠন যথা শান্তি পরিষদ, ট্রেড ইউনিয়ন, আফ্রো-এশিয় সংহতি পরিষদ, সাংবাদিক ইউনিয়ন, মহিলা সংস্থা প্রভৃতি গত কয়েক দিনে বাংলাদেশের প্রতি সংহতি জানাইয়া যে সব বিবৃতি প্রকাশ করিয়াছে উহা তাৎপর্যহীন নয়।সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ নয়,একেবারে প্রথম হইতে দৃঢ়চিত্তভাবে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতি ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রকাশ করিয়া আসিয়াছে।এপ্রিল মাসের প্রথম সাপ্তাহে যখন একমাত্র ভারত ছাড়া অন্য কোন দেশ বাংলাদেশ সম্পর্কে মাথা ঘামাইবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে নাই- তখনি সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্টপ্রধানের আবেদন জ্ঞাপনের ন্যায় সর্বোচ্চ কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছে।কাজেই সোভিয়েত ইউনিয়ন এর ভূমিকাকে যাহারা জল্লাদ ইয়াহিয়া চক্রের দোসর মার্কিন সম্রাজ্যবাদীদের সহিত এক করিয়া প্রচার করে তাহাদের উদেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন না তুলিয়া পারা যায় না।

পাক-ভারত যুদ্ধের আশঙ্কা প্রতিহত করিয়া বিশ্বের এই এলাকায় শান্তি অব্যাহত রাখার প্রশ্নটি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শান্তি অক্ষুন রাখার ব্যাপারে শুধু যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত আগ্রহী তা নয়,বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থের প্রয়োজন। পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইয়া জাতিসংঘ মারফত মার্কিন সম্রাজ্যবাদীদিগকে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেওয়া এবং বাংলাদেশের প্রশ্ন হইতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি পাক-ভারত বিরোধের প্রতি সরাইয়া নেওয়ার উদেশ্যে ইয়াহিয়া চক্রই কেবল পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইতে আগ্রহী হইতে পারে।বস্তুত পাকিস্তানী শাসকচক্র মুক্তিবাহিনীর হাতে ক্রমাগত মার খাইয়া পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাইবার ফিকিরই খুঁজিতেছে। কাজেই যুক্ত বিবৃতিতে যুদ্ধ প্রতিহত করিয়া শান্তি রক্ষার যে কথা বলা হইয়াছে উহা বাংলাদেশের স্বার্থের সহিত সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।

বাংলাদেশের দুই অকৃত্রিম সুহৃদ ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগীতে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অনুকূলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান সৃষ্টি করিতেছে।ভারত-সোভিয়েত যুক্ত বিবৃতি এই ফলপ্রসু সহযোগীতারই একটি অমূল্য দলিল। আমরা ইহাকে মুক্তকণ্ঠে অভিনন্দন জানাইতেছি।

Scroll to Top