৯৭। ৭ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের সগ্রামী ঐক্যের প্রাণবন্ত প্রতীকে পরিণত করা হউক

সাহুল আহমেদ মুন্না

<৬,৯৭,১৫৬-১৫৭>

শিরোনামঃ সম্পাদকীয় উপদেষ্টা পরিষদকে সংগ্রামী ঐক্যের প্রাণবন্ত প্রতীকে পরিনত করা হউক।

 

সংবাদপত্রঃ স্বাধীন বাংলা, ১ম বর্ষঃ ১৮শ সংখ্যা

 

তারিখঃ ৭ নভেম্বর, ১৯৭১

 

সম্পাদকীয়

 

[উপদেষ্টা পরিষদকে সংগ্রামী ঐক্যের প্রাণবন্ত প্রতীকে পরিনত করা হউক]

 

৬ নভেম্বর সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক আহ্বান করা হইয়াছে। উপদেষ্টা পরিষদকে আতুড়েই গলা টিপিয়া মারার জন্য ঐক্যবিরোধী কোন কোন মহল ও দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলরা বিশেষতঃ মার্কিন লবী যেভাবে আদা-জল খাইয়া লাগিয়াছিল উহার পরিপ্রেক্ষিতে এই বৈঠকের তাৎপর্য রহিয়াছে।

.

প্রায় দুই মাস পূর্বে সর্বদলীয় বৈঠকে মন্ত্রিসভার উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হইলে দেশব্যাপীপ্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হইয়াছিল। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সংগ্রামী শক্তিগুলির মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় বিধানের যে সমস্যাটি প্রথমাবধি রহিয়া গিয়াছে, দেশবাসী আশা করিয়া ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ফলে উহার বহুলাংশে সমাধান হইবে এবং উপদেষ্টা পরিষদ ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের স্তরে উন্নত হইবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় জনগনের এই আশা পূরণ হয় নাই। ঐক্যের ভিত্তি আরো প্রসারিত কিম্বা গভীরতর হওয়া দূরের কথা উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের মধ্য দিয়া যে সূচনাটি হইয়াছে এহাকেই অঙ্কুরে নির্দিষ্ট করার জন্য পূর্বোক্ত মহলগুলি উঠিয়া পড়িয়া লাগে। ইহার ফলে গত দুই মাসের মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের একটিও বৈঠক অনুষ্টিত হইতে পারেনাই।

.

ঐক্যের পথে এই সকল বাধা থাকা সত্ত্বেও ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ফুরাইয়া যায় নাই। বরং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাথে সাথে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা আরও তীক্ষ্ণভাবে অনুভুত হইতেছে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্য প্রয়োজন- ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন মুক্তাঞ্চলগুলো পুনর্গঠনের ক্ষেত্রেও। কাজেই উপদেষ্টা পরিষদকে একেবারে ঘুম পাড়াইয়া রাখার পরিবর্তে মাঝে মাঝে উহার বৈঠক ডাকিয়া নিয়মরক্ষা করিলেও সমস্যার সমাধান হইবে না। উপদেষ্টা পরিষদকে বাংলাদেশের সংগ্রামী শক্তিগুলির প্রাণবন্ত ঐক্যের প্রতীক হিসাবে দেশবাসীর সম্মুখে তুলিয়া ধরিতে হইবে, মুক্তিসংগ্রামকে সুসংগঠিত ও বিভিন্ন সংগ্রামী শক্তির তৎপরতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে ইহাকে যোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করিতে দিতে হইবে। তাছাড়া উপদেষ্টা পরিষদকে শুধু উপরের তলায় সীমাবদ্ধ না রাখিয়া নীচের স্তরগুলিতেও ঐক্যবদ্ধ কমিটি গঠন করিতে হইবে।

.

দেশবাসীর জঙ্গি উদ্দিপনা বৃদ্ধির জন্য সরকারের তরফ হইতে স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের একটি রূপরেখা তুলিয়া ধরা এবং বক্তৃতায় বিবৃতিতে, বেতারে, সংবাদপত্রে উহা ব্যাপকভাবে প্রচার করা দরকার। বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন সরকারি মুখপাত্র বলিয়াছেন, সরকারের লক্ষ্য বাংলাদেশে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক,ধর্মনিরপেক্ষ ও সামজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করা। কখনও বা বলা হয়, আওয়ামীলীগ উহার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করিবে। সম্প্রতি একজন সরকার মুখপাত্র বলিয়াছেন, বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকদিগকে খাজনা হইতে অব্যাহতি দেওয়া হইয়াছে। এই সমস্ত কথাবার্তার মধ্যে দিয়া স্বাধীন বাংলাদেশের রূপরেখা টুকরা টুকরা ভাবে তুলিয়া ধরার চেষ্টা দেখা গেলেও ইহা যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন যা তাহা হইল, স্বাধীন বাংলাদেশে যে আবার সাম্রাজ্যবাদ বিশেষতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় পুজিপতি শ্রেণীর অবাধ শোষণের মৃগয়া ক্ষেত্র হইয়া উঠিবেনা, স্বাধীন বাংলাদেশে যে সত্যিই সুখী সমৃদ্ধিশালী সমাজ গড়িয়া তোলা হইবে- এই আশ্বাস ও নিশ্চয়তা দেশবাসীকে দিতে হইবে। আওয়ামীলীগের কর্মসূচিতে পাকিস্তানের তৎকালীন পঠভুমিতে অনেক ইতিবাচক বিষয় সন্নিবেশিত হইলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঠভূমিতে ইহার রদবদল অত্যাবশ্যক। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আওয়ামী লীগের কর্মসূচীতে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ বন্ধ করা ও কৃষকের স্বার্থে ভূমি ব্যবস্থার সংস্কার সম্পর্কে কোন উল্লেখ নাই। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এই দুই বিষয়ই হইবে মুখ্য। কাজেই পরিবর্তিত অবস্থার চাহিদার সহিত সঙ্গতি রাখিয়া সর্বদলীয়ভাবে স্বীকৃত একটি গণমুখী কর্মসূচী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হইতে ঘোষণা করা একান্ত আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে।

.

ইয়াহিয়া চক্রের পাক-ভারত যুদ্ধের হুমকির দরুন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ক্ষেত্রে নয়া পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে এই পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধকে অগ্রসর করিয়া নেওয়ার জন্য উপদেষ্টা পরিষদের সামগ্রিক ও ঐক্যবদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। ইয়াহিয়া-চক্র যদি মরিয়া হইয়া যুদ্ধ বাধায় তাহা হইলেও শত্রু যেন পাক-ভারত যুদ্ধের মধ্য দিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে চাপা দেওয়ার কুমতলব হাসিল করতে না পারে বরং বাংলাদেশে উহার পরাজয় ত্বরান্তিত হয় সে জন্য বাংলাদেশের সকল সংগ্রামী শক্তিকে প্রস্তুত থাকিতে হইবে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং সাড়ে সাত কোটি নর-নারী যেন একটি মানুষের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ ও ক্ষিপ্রতার সহিত শ্ত্রুর উপর ঝাপিয়া পড়িতে পারে সে জন্য একটি সামগ্রিক অভ্যূত্থানের পরিকল্পনা তৈরী করা দরকার। উপদেষ্টা পরিষদের সামনে ইহাও আজ একটি মুখ্য করণীয় হিসাবে হাজির হইয়াছে। এ ব্যাপারে কাল বিলম্ব করা চলেনা ।

Scroll to Top