১২। ১৯ মে সম্পাদকীয়ঃ আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট
শিরোনামঃ সম্পাদকীয় “আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট”; সংবাদপত্রঃ জয়বাংলা; ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা; তারিখঃ ১৯ মে, ১৯৭১।
আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট
রাওয়ালপিন্ডি—ইসলামাবাদ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই মর্মে এক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক। তবে দুটি মাত্র শর্তে। তা হলো সামরিক সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা নেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সকলকে তারই দেয়া একটি অন্তর্বর্তিকালীন শাসনতন্ত্র মেনে নিতে হবে। তারপর জাতীয় পরিষদ যে শাসনতন্ত্র রচনা করবে তাও হুবহু অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্রের অনুরূপহতে হবে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানি পত্রিকা সমূহে প্রকাশিত সংবাদের উপর আদৌ গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যথার্থ গুরুত্ব না দিয়ে পারছি না। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ইয়াহিয়া বা অন্য কারো দেয়া শাসনতন্ত্র গ্রহণ করবে কি করবে না, তা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তারা যদি রোজ কেয়ামত পর্যন্ত সামরিক আইনে শাসিত হতে চায় তাহলেও আমাদের বলার কিছু নেই। কেন না, ওটা তাদের ঘরোয়া ব্যাপার। তারা একটা আলাদা রাষ্ট্র।
আমাদের বিশ্বাস, সামরিক সরকারের ইঙ্গিতেই পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলো আলোচ্য সংবাদটি গুরুত্বসহকারে বাজারে ছেড়েছে। কেননা, পাকিস্তানের সংবাদপত্রসমূহের উপর সামরিক আইনের যে খড়গ উদ্যত হয়ে আছে তার প্রেক্ষিতে কোন সংবাদপত্রের পক্ষেই সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ ধরণের কিছু প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে উল্টাপাল্টা সংবাদ ছাপিয়ে পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকদের ক্ষেপিয়ে তুলবে ?
বিশ্বের ইতিহাসে যখনই কোন বিদেশী শক্তি অস্ত্রের জোরে পরের দেশ দখল করেছে তখনই তারা চেষ্টা করেছে সেদেশে একটি শিখন্ডি সরকার খাড়া করার। ইয়াহিয়া-ভুট্টো-টিক্কা খানও আজ সেই মহাজনী পন্থার আশ্রয় নিয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা, তাদের মনোবল নষ্ট করা, চূড়ান্ত বিজয় সম্পর্কে তাদের মনে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করা। অতীতে কোন দখলদার শক্তি সাময়িকভাবে সফল হলেও তাদের সফলতা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি-ইয়াহিয়া-ভূট্টো চক্রেরও হবে না, হতে পারে না। শোষক, নিপীড়ক, বর্বর এই পশ্চিম পাকিস্তানি চক্র হয়তো ভেবেছে যে, আওয়ামী লীগকে অবৈধ ঘোষণা করে শিখন্ডিদের দ্বারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করাবে। তাই তারা আজ সওয়ার হয়েছে নূরুল আমীন, হামিদুল হক, সবুর খান, ফকা চৌধুরী, ফরিদ আহমদ, মাহমুদ আলী, সোলায়মান। খয়ের উদ্দীন প্রমুখ কুখ্যাত, গণধিক্কৃত, সুবিধাবাদী ও জনগণবর্জিত লোকের ঘাড়ে। এদেরকে বাঙ্গালীরা ডাস্টবিনের আবর্জনা ছাড়া কিছুই মনে করে না।
আমরা দ্ব্যররথহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে, ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা হস্তান্তর বা পাকিস্তানের শসনতন্ত্র রচনার সাথে বাংলাদেশের মানুষের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা যখন ক্ষমতা চেয়েছিলাম তখন দেয়া হয়নি। তার বদলে আমরা পেয়েছি গুলী। এতে প্রাণ দিয়েছে আমাদের লাখ লাখ ভাই-বোন, ইজ্জত হারিয়েছে আমাদের মা-বোনেরা, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়েছে লাখ লাখ পরিবার, গ্রিহহারা হয়েছে দেড় কোটির মত বাঙালী সন্তান। লাখো শহীদের লাশের তলায় লাখো মায়ের তপ্ত অশ্রুর অতল তলে কবর হয়ে গেছে পাকিস্তানের। আমরা ঘোষণা করেছি স্বাধীনতা। আমাদের সন্তানরা ধরেছে অস্ত্র, বহাচ্ছে খুনের বন্যা। আমরা লিপ্ত হয়েছি এক মরণপণ সংগ্রামে- হয় স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঁচবো না হয় মরবো। আজ আমাদের একটি মাত্র কথা- মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন।
তাই আজও যারা ইয়াহিয়ার কাছ থেকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট গ্রহণের জন্য ঢাকা পিন্ডি- ছুটাছুটি করছে, এক পা কবরে রেখে আরেক পা নিয়ে সংহতির নামে বিবৃতি দানের জন্য রেডিও পাকিস্তানে দৌড়াচ্ছে, তাদেরকে আমরা হুঁশিয়ার করে দিতে চাই- বাঙ্গালীদের স্বার্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার দিন আর নেই। ১৭ জন সৈন্য নিয়ে বাংলাদেশ দখলের দিন ফুরিয়ে গেছে। এক মীরজাফরকে হাত করে পলাশীর যুদ্ধ জয় করার দিন অতীত হয়ে গেছে। শত মীরজাফরকে মসনদে বসিয়েও বাংলাদেশকে আর পদানত রাখা যাবে না।
বাঙালী আজ জেগেছে। শেখ মুজিবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছে। পশ্চিমা বর্বর সৈন্যদের ঝরানো রক্তের প্রতি ফোঁটায় জন্ম নিয়েছে হাজার হাজার মুজিব। প্রয়োজনবোধে তারাই দেবে জাতিকে নেতৃত্ব। মীরজাফর বিশ্বাসঘাতকদের বাংলার ব্যাপারে নাক গলানোর প্রয়োজন বা অধিকার নেই। বাঙালী জাতি নিজেকে মুক্ত করবেই করবে। টিক্কা খান ৩০ লাখ বাঙালী কেন তিনশ’ লাখ বাঙালী সন্তানকে হত্যা করেও শান্তিতে ঘুমুতে পারবে না। একটি বাঙালী তরুণ বেঁচে থাকা পর্যন্তও সে অস্ত্র চালিয়ে যাবে বিদশী হানাদারদের বিরুদ্ধে। কেননা, বাঙালী আজ বেঁচে মরতে চায় না, সে মরে বাঁচতে চায়।
নূরুল আমীন, হামিদুল হক প্রমুখরা অতীতে বাংলাদেশ ও বাঙ্গালীর অনেক সর্বনাশ করেছে। আর সে সুযোগ তাদেরকে দেয়া হবে না। নূরুল আমীন মাতৃভাষায় কথা বলার দাবী করার অপরাধে আমাদের সন্তানদের গুলি করে মেরেছে। বাংলাদেশ পক্ষে কথা বলার কোন অধিকার বাঙালী তাকে দেয়নি। গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত গণভোটে বাঙালী এ অধিকার দিয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার দলকে। “অতি বুদ্ধিমান” ও ধনকুবের হামিদুল হক চৌধুরীর পরামর্শেই যে পাক ফৌজ বর্বরের মত ঢাকাসহ বাংলাদেশের সমস্ত বস্তি এলাকা ধ্বংস করে দিয়েছে তাও আমাদের জানা হয়ে গেছে। অতীতেও বহুবার হামিদুল হক বাংলা স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়েছে। ফরিদ আহমদ, মাহমুদ আলী ও সোলায়মানের মত সামাজিক কীটগুলো তো দালালের দালাল তস্য দালাল। উপসংহারে আমরা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই যে, পাকিস্তান ,মরে গেছে। সেজন্য আমরা দায়ী নই-দায়ী ইয়াহিয়া ভূট্টো চক্র। তার কবরও দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান যথারীতি সামরিক কায়দায়। কবর থেকে লাশ তুলে আহাজারি করাতে কারো কোনো লাভ হবে না। যারা বাঙালী হয়েও এ লাশ নাড়াচাড়া চেষ্টা করবে তাদেরকে আমরা জাতীদ্রোহী বলেই গণ্য করবো। সাথে সাথে জাতিদ্রোহিতার যে একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড তাও আমরা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেব।