কম্পাইলারঃ হিমু নিয়েল
<৬,২৪,৪৮-৪৯>
.
শিরোনামঃ তাঁকে হত্যা করে বাঙালী জাতিকে স্তব্ধ করা যাবে না
সংবাদপত্রঃ জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ১৬শ সংখ্যা
তারিখঃ ২৭ আগস্ট, ১৯৭১
.
তাঁকে হত্যা করে বাঙালী জাতিকে স্তব্ধ করা যাবে না
মুজিব আজ আর কোন ব্যক্তি নয়
সাড়ে সাত কেটি বাঙালীর নাম শেখ মুজিব
(জয় বাংলা প্রতিনিধি)
.
মানব ইতিহাসের নৃশংসতা হত্যাকারী ইয়াহিয়া লাখো লাখো নিরপরাধ বাঙালীর শোণিতে দেহ রঞ্জিত করেও তার রক্ত পিপাসা নিবৃত্ত করতে পারেনি । খেঁকি কুত্তা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে যেমন দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে যা তা কিছু করে বসে তেমনি মদ্যপ দুশ্চরিত্র ইয়াহিয়াও ঝাঁকালো ডিম্পল হুইস্কির নেশায় গোলাপি হয়ে গিয়ে তার মনিব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচারের প্রহসন চালাবার জন্য উদ্ধত ঔদ্ধত্য ঔদ্ধত্যে খেউ খেউ রব ছাড়তে শুরু করেছে ।
.
মানব সভ্যতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি হুমকিস্বরূপ এই ঘৃণ্য নরপশুকে তার বিপদজনক কাজ থেকে নিবৃত্ত করার জন্য বিশ্বের মানবতাবাদী বিবেক তাদের কণ্ঠস্বরকে উচ্চগ্রামে তুলেছেন। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। উন্মুক্ত খেঁকি কুত্তাকে যেমন মুগুরের আঘাতে মাথার মগজ বের করে দিয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা পরিচালনার পথকে কন্টকহীন করতে হয় ইয়াহিয়া এবং তার ইতিহাসের শিক্ষা বিস্মৃত জান্তাকেও তেমনি প্রচণ্ডতার সাথে আঘাত করতে না পারলে আগুন নিয়ে খেলা থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না। ইতিহাসের আস্তাকুড়ের গলিজ পচা চরিত্র হিটলার, আইখম্যান মুসোলিনীদেরও মিষ্টি কথায় নিবৃত্ত করা যায় নি। যেমন কুকুর তার জন্য তেমন মুগুরের প্রয়োজন। আমাদের মুক্তি বাহিনী স্বয়ংক্রিয় মুগুর হাতে সে কাজ সমাধা করার জন্য আজ বিদ্যুতের গতিতে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তারা পথের কোন বাধা মানবে না বাঙ্গালী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষার জন্য কোন ত্যাগকেই বড় করে দেখবে না। মুজিব ভাই না বাঁচলে তাদের আলো বাতাস নিঃশ্বাস নিয়ে বেচে থাকারও কোন আগ্রহ নেই । প্রতিটি অস্ত্রাঘাতে জল্লাদদের বাচার ক্ষীণ সম্ভাবনাকেও তরুণ মুক্তি সেনারা অসম্ভব করে তুলবে ।
.
ইয়াহিয়া ঘোষণা করেছে, সে ৭৫ মিলিয়ন বাঙালীর আশা আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ অনুভূতির প্রতীক শেখ মুজিবের বিচার করবেই। বিচারের কয়েক মাস আগেই সে ২৬শে মার্চের বেতার ভাষণে রায়ও দিয়ে ফেলেছে । মদ্যপ ইয়াহিয়ার মাতাল কণ্ঠ থেকে সেদিন ঝরে পড়েছিলঃ শেখ মুজিবকে রেহাই দেওয়া হবে না । পরবর্তীকালে একই কণ্ঠ ঘোষণা করেছে, বিচারে শেখ মুজিবের প্রাণদণ্ড হতে পারে । তার পাঞ্জাবী সেনাদের বুটের আঘাতে প্রকম্পিত বেতার থেকে প্রতিদিন শেখ সাহেবকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে । খেঁকি কুকুরের দুগ্ধক্তময় নখ চাটা বাঙালী কণ্ঠ তাকে মীরজাফর বলার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে ।
.
এই পরিবেশে স্থানের নামহীন, বিচারকের নামহীন, খাকী ইউনিফর্ম ধারীর গ্যাস চেম্বারে বাংলার নয়নমণি শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে ।
.
আরও একটি চমকপ্রদ ঘোষণাও একই সাথে সাথে করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে সিন্ধুর আল্লাবক্স খোদাবক্স দ্রোহী শেখ সাহেবের পরে মামলা পরিচালনা করতে স্বীকৃত হয়েছেন । এবং তাকে শেখ সাহেবের পক্ষ অবলম্বনের জন্য অনেক চেষ্টা তদ্বির করা হয়েছে । চেষ্টা করেছেন স্বয়ং ঘাতক বিচারক ইয়াহিয়া । অনেক চেষ্টা তদ্বিরের পর জনাব ব্রোহী মামলা পরিচালনায় স্বীকৃত হয়েছেন । আহা কি নাটক কি উপাদেয় নাটক !
.
শেখ মুজিব দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, আমার বিচার করার কোন এখতিয়ার ইয়াহিয়ার নেই । কিসের অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে ? আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কি অধিকার ইয়াহিয়ার আছে, তাকে এ অধিকার কে দিয়েছে ?
.
এর পরও জনাব এ কে দ্রোহীকে নাকি শেখ সাহেবের পক্ষে মামলা পরিচালনায় নিযুক্ত করা হয়েছে এবং তিনি তার মক্কেলের সাথে আলোচনার জন্য এক অঘোষিত স্থানে রওয়ানা হয়ে গেছেন । সে স্থানের নাম তিনি প্রকাশ করবেন না কারণ তিনি গোপনতার শপথ পাঠ করেছেন ইয়াহিয়ার কাছে । ঘাতক যে শেখ সাহেবকে অপরাধী বলে পূর্বেই রায় দিয়ে ফেলেছে । যার প্রচারযন্ত্র অহরহ শেখ বিরোধী বিষ ছড়িয়ে ঝালিয়ে যাচ্ছে সেই আইনের আর ইতিহাসের জ্ঞান বর্জিত ইয়াহিয়া আবার অনেক চেষ্টার পর বিবাদী পক্ষের আইনজীবীও ঠিক করে নিয়েছেন । ইয়াহিয়া তোমাদের হাজারো গ্রামের গুহায় এ জাতীয় বিচারের প্রহসন হতে পারে কিন্তু সভ্যতার আলো বাতাসে উদ্ভাসিত আজকের বিশ্বে এ জাতীয় মধ্যযুগীয় বিচারের প্রহসন অকেজো । ইয়াহিয়া তোমাকে খেয়াল রাখতে হবে পরকীয়া প্রেম করে তোমার সাদ্দামী বেহেস্ত প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রত্যাবর্তনের পর তোমার স্ত্রীকে চোখ রাঙ্গিয়ে ঠান্ডা করার ক্ষমতা তোমার আছে কিন্তু দুর্জয় শপথের দীপ্তিতে মাথা উঁচু বাঙালীরা তোমার হুমকির কাছে যে মাথা নোয়াবার শিক্ষা পায়নি তা তুমি এবং তোমার জেনারেলরা ইতিমধ্যেই নিশ্চয়ই টের পেয়ে গেছে ।
.
মিঃ ব্রোহী মামলায় কার পথ অবলম্বন করবেন ? শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে কি অভিযোগের জবাব তিনি দেবেন এবং কার কোর্টে ? বিশ্ব জনমতের আদালতে শেখ মুজিব একটি মাত্র অপরাধ করেছেন এবং তা হলো জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা অনুভূতির সাথে তিনি বিশ্বাস ঘাতকতা করেননি-ছয় দফার সাথে বেঈমানী করে প্রধানমন্ত্রীর পদকে বড় করে দেখেননি । জনতার রক্ত নদী আর অশ্রু গঙ্গার সাথে নিজেকে একাত্ম করে নিতে সূক্ষ্মতর বিলম্ব করেননি । এই অপরাধে যদি শেখ সাহেবের বিচার হয় তাহলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকেও বিচারের কাঠগড়ায় উঠাতে হবে । কারণ শেখ মুজিব আজ ব্যক্তি নয়, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর নাম শেখ মুজিব । মুজিব মানে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী-কণ্ঠ, বাঙালী-প্রাণ, বাঙালী আবেগ । ইয়াহিয়া তোমার ক্ষমতাদর্পী সেনারা একটি জাতিকে কি নিশ্চিহ্ন করতে পারবে ? পারবে না । হিটলার পারেনি । আইখম্যানদের গ্যাস চেম্বারও একদিন ‘টায়ার্ড’ হয়ে পড়েছিল।