কম্পাইলারঃ রবিউল হাসান সিফাত
<৬,২৯,৫৯-৬০>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
সেই পুরাতন খেলা (সামরিক জান্তা কতৃক একজন অসামরিক ব্যক্তিকে বাংলাদেশের গভর্নর পদে নিয়োগ প্রসঙ্গে) |
জয় বাংলা ১ম বর্ষঃ ১৯শ সংখ্যা |
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ |
সেই পুরাতন খেলা
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় একটি নতুন নাটকের অভিনয় চলছে। নাটকটি যদিও নতুন কিন্তু তার বিষয়বস্তু অত্যন্ত পুরনো। এই বিষয়বস্তু হল, একজন অসামরিক তাঁবেদার বাঙ্গালীকে গভর্নরের পদে বসিয়ে বিশ্ববাসীকে বোঝানো, বাংলাদেশে আর সামরিক শাসন নেই। এমন চেষ্টা আইয়ুব খাঁও করেছিলেন। তার দশ বছরের স্বৈরাচারী শাসনে মোনেম খাঁ নামক এক বটতলার উকিলকে গভর্নরের পদে বসিয়ে দুনিয়ার মানুষকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ বাঙ্গালীদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে। মোনেম খার বদলে এবার ভাড়া পাওয়া গেছে আবদুল মোতালিব নামক এক দাঁতের ডাক্তারকে।
*
ঢাকার লাটভবনে শুধু তাঁবেদার গভর্নর বসিয়ে নয়, পিণ্ডির জঙ্গীচক্র বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার আসল অবস্থা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য আরো ছল চাতুরীর আশ্রয় নিচ্ছে। হঠাৎ খুনি ইয়াহিয়া একেবারে “মহানুভব” ব্যক্তি সেজেছেন এবং তাদের কথিত এক শ্রেণীর “রাষ্ট্রবিরোধী” বাঙ্গালীর প্রতি সাধারণ অনুকম্পা ও ঘোষণা করেছেন। দখলীকৃত ঢাকা বেতার থেকে বলা হয়েছে, কিছুসংখ্যক আটক লোককে নাকি জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই কিছুসংখ্যক লোক কারা, তাদের নাম ধাম কি, তা কিছু বেতার ঘোষণায় বলা হয়নি। সুতরাং আশঙ্কা হয় শিয়ালের কুমীর ছানা প্রদর্শনের মত এই ‘ক্ষমা প্রদর্শনের’ মহড়াটিও জঙ্গীচক্রের কোন নতুন শয়তানি অভিসন্ধির বহিঃপ্রকাশ কিনা।
*
এইদিকে এইসব লোক দেখানো ভড়ং, অন্যদিকে দখলীকৃত বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের বর্বরতা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এখনো বাঙ্গালী মেয়েদের ইজ্জত নাশ করা হচ্ছে এবং এক একজন অশিক্ষিত সেপাইকে বাঙ্গালী মেয়েদের বলপূর্বক পত্নী (উপপত্নী) হিসাবে গ্রহণে উৎসাহ জোগানো হচ্ছে। দখলীকৃত এলাকায় এখনো চলছে গ্রামের পর গ্রাম লুণ্ঠন, হত্যা ও অগ্ন্যুৎসব। দখলীকৃত এলাকায় বাঙ্গালীদের এই অবস্থা। বিদেশেও তাদের সঙ্গে একই আচরণ করা হচ্ছে। ইয়াহিয়া চক্র বুঝতে পেরেছে, তাদের বিদেশী দূতাবাসে যেসব বাঙ্গালী কর্মচারী রয়েছে, তাদের কেউ আর পিণ্ডির খুনীচক্রের প্রতি অনুগত নয়। তারা স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেন এবং সুযোগ পেলেই তা ঘোষণা করবেন। গত পাঁচ মাসে বহু বাঙ্গালী কূটনীতিবিদ ও দূতাবাস কর্মচারী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করে বহির্বিশ্বে ইয়াহিয়া চক্রের মিথ্যা প্রচারণার বেলুন ফুটো করে দিয়েছেন। শঙ্কিত ইয়াহিয়া চক্র তাই অবশিষ্ট বাঙ্গালী কর্মচারীদের আটকানোর জন্য তাদের পাসপোর্ট আটকের আদেশ দিয়েছেন। যদিও নির্দেশে বলা হয়েছে, এই আদেশ সকল দূতাবাস কর্মচারীদের বেলাতেই প্রযোজ্য, কিন্তু কাজের বেলায় বেছে বেছে যে কেবল বাঙ্গালী কর্মচারীদের পাসপোর্টই আটক করা হচ্ছে, বিশ্ববাসীর সে খবর জানতেও আর দেরী হয়নি।
*
দেশ-বিদেশে এই বাঙ্গালী নিধন ও বাঙ্গালী-বিতাড়ন নীতি অব্যাহত রেখেও ইয়াহিয়া চক্র ঢাকায় কেন এক বিশ্বাসঘাতক বাঙ্গালীকে তাঁবেদার হিসাবে লাটের গদিতে বসিয়ে এই অসামরিক শাসনের ভড়ং দেখাচ্ছে? এই প্রশ্নটির জবাব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ গত ৫ই সেপ্টেম্বর রাত্রে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তার ভাষণে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আসন্ন হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশে অসামরিক শাসন পুনঃপ্রবর্তনের ভাব সৃষ্টির একটা কৌশল অবলম্বন করেছে। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, ইয়াহিয়া ঘৃণ্য টিক্কা খার স্থলে একজন অসামরিক সাক্ষী গোপালকে বসিয়েছেন এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন মুষ্টিমেয় হতাশ বাঙ্গালীকে পাকিস্তানের প্রতিনিধি করে জাতিসংঘে পাঠাবার চেষ্টা করছেন এ সবই ওই একই কৌশলের অঙ্গ। অর্থাৎ বাংলাদেশে যে সামরিক আইন, গণহত্যা ও দমননীতি অব্যাহত রয়েছে, এই নগ্নসত্য গোপন করার চেষ্টা।
*
কিন্তু পিণ্ডির খুনি চক্রের এই সত্য গোপন করার চেষ্টা সফল হয়নি। তাই বাংলাদেশে একজন তাঁবেদার গভর্নর নিয়োগ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউইয়র্ক পোষ্ট’ পত্রিকা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশে গভর্নর হওয়ার কোন যোগ্যতা এই লোকটির নেই। বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের একমাত্র অধিকার রয়েছে জনগণের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের।‘ নেদারল্যান্ডের একজন প্রভাবশালী পার্লামেন্ট সদস্য ডাঃ মালিককে বাংলার দখলীকৃত এলাকার গভর্নর নিয়োগ করা সম্পর্কে বলেছে ‘এটা ঔপনিবেশিক ধরনের নিয়োগ।‘ বস্তুত ইয়াহিয়া চক্র যতই চেষ্টা করুন, বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করা তাদের চোখে ধুলা নিক্ষেপের কোন চেষ্টাই সফল হবে না। বাংলাদেশের মানুষ আর ইয়াহিয়া চক্রের দাসত্ব স্বীকার করবে না। বরং মুক্তিবাহিনী অস্ত্রের মুখেই ইয়াহিয়ার এই নব-নাট্যাভিনয়ে সকল ভাঁড়ামির অবসান ঘটাবে।