কম্পাইলারঃ হিমু নিয়েল
<৬,৬৪,১১১-১১২>
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১২শ সংখ্যা
তারিখঃ ২৩ আগস্ট, ১৯৭১
.
সম্পাদকিয়ঃ ৬ দফা না মুজিববাদ?
.
বাংলাদেশে বহু বিচিত্র দেয়ালের লিখন দেখেছি । কোথাও দেখেছি পাঞ্জাবী কুকুর বাংলা ছাড়; আবার কোথাও দেখেছি পশ্চিম পাকিস্তানী পশুরা মানুষ হত্যা করেছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি । স্থানে স্থানে প্রত্যক্ষ করেছি, বঙ্গবন্ধু দীর্ঘজীবি হউক । এক জায়গায় দেখেছি লেখা রয়েছে মুজিববাদ দীর্ঘজীবি হউক । এই পোষ্টারটি আমার চিন্তাস্রোতকে বিঘ্নিত করেছে, তাড়িত করেছে নতুন ভাবনার পথে । সত্যি কি মুজিববাদ বলে বিশ্বে কিছু প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ?
.
আজকে শেখ মুজিব কোন ব্যক্তির নাম বা কোন দলীয় প্রধান নয়, শেখ মুজিব এক কালজয়ী আদর্শ, এক জলন্ত শিখা । এই অগ্নিশিখার আলোকে অনাগত ভবিষ্যতের অগনিত নিপীড়িত জনতা পথ দেখে নেবে । বিশ্বের যেখানে অত্যাচার, অনাচার, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-শাসন, ফ্যাসিবাদী নির্যাতন, নির্মম আঞ্চলিক বৈষম্য বিরাজমান, সে সব এলাকার মানুষের জন্য মুজিব এক বলিষ্ট সোচ্চার প্রতিবাদ, স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অনড় চ্যালেঞ্জ; বাস্তব, প্রাণবন্ত ও নির্ভেজাল গণতন্ত্রের প্রতীক এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বিমূর্ত প্রকাশ । অন্যান্য বহু প্রসঙ্গকে না টেনেও শুধু মাত্র নেতা প্রণীত ৬ দফা কর্মসুচির আলোকেই উপরিউক্ত সত্যকে নির্দ্ধিধায় প্রতিষ্ঠিত করা যায় । বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা যদিও পাকিস্তানের দুটি বিচ্ছিন্ন অংশের আঞ্চলিক বৈষম্য দুরীকরনের একটা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক কর্মসূচী ছিল, আজকের দিনে সেটা বাংলাদেশের জন্য এক দফায় রূপান্তরিত হলেও অদুরভবিষ্যতে এর আবেদন চিরন্তন বলেই আমাদের বিশ্বাস । ৬ দফা কালজয়ী, ৬ দফা এখন মুজিববাদ এ রূপান্তরিত । তদানীন্তন পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট এলাকা বাংলাদেশ এখন স্বাধীন সত্তা নিয়ে বিরাজমান । পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা ভঙ্গপ্রায়, টলটলায়মান । বিলুচিস্তানের মানুষের বিক্ষোভ ধুমায়িত । ৮ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর কাছে লিখিত একটি পত্রে সেখানকার ছাত্র-শ্রমিক, রাজনীতিবিদ তথা সাধারণ মানুষের পাঞ্জাব বিদ্বেষী মনোভাব স্ফোটিকের ন্যায় স্বচ্ছ । পাকিস্তানে যে জাতিগত বৈশিষ্ট চূড়ান্তভাবে লাঞ্ছিত, আঞ্চলিক শোষণের শিকার হিসাবে অবহেলিত এলাকার চেতনা মুমূর্ষ প্রায়, পাঞ্জাবী শোষক ও শাসকের জগদ্দল পাষাণ বেদী হাতে মুক্তির চিরন্তর আকাঙ্কা আকাশ প্রমাণ, তারই মুর্ত প্রকাশ উক্ত পত্র । অপর দিকে সীমান্তের মানুষেরা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবীতে সোচ্চার সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফ্ফার খানের অতীতের বক্তব্য ও সাম্প্রতিক কার্যকলাপ, তদীয় সন্তান ওয়ালী খানের সাম্প্রতিক বিবৃতি একটি সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে জাতিগত সত্তার বিলুপ্তি বা অবলুপ্তি অসম্ভব, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ অকল্পণীয় । এই চেতনাবোধের গভীরতা আর ব্যাপ্তির পেছনে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ কর্মপ্রচেষ্টা এবং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম । বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে । সারা পশ্চিম পাকিস্তান ভগ্নোন্মুখ । বিদ্রোহ ও বিক্ষোভ ঘনায়িত । এমনি পরিস্থিতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অস্তিত্ব প্রায় বিলীয়মান । এমতাবস্থায় কোন যাদুমন্ত্র, রক্তচক্ষু, সামরিক জান্তার নির্বিচার গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ বা নারী ধর্ষণ পশ্চিম পাকিস্তানকে একত্রিত রাখতে অক্ষম । এই মুহুর্তে ভগ্নোম্মুখ পশ্চিম পাকিস্তানের আশু বিচ্ছিন্নতা রোধের জন্য প্রয়োজন বঙ্গবন্ধু প্রণীত ৬ দফা কর্মসূচির অনুরূপ কোন বাস্তব ও বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ । এ কথা সত্য যে ৬দফার আক্ষরিক প্রয়োগ হয়ত সেখানে সম্ভব নয় কিন্তু তার গভীরতম প্রদেশে নিহিত চুড়ান্ত বক্তব্যটিকে গ্রহণ করতেই হবে । মার্কসবাদ লেনিনবাদও প্রনেতাদের ধ্যান ধারনাকে অতিক্রম করে অবস্থা ও অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে রূপান্তরিত হয়েছে । বাস্তব প্রয়োগ ক্ষেত্রে লক্ষিত হয়েছে বিভিন্নতা । এটা নিতান্ত স্বাভাবিক এবং স্বাভাবিক বলেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্রে কতকগুলো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে । এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ৬ দফা বা মুজিববাদও পরিবেশের প্রভাবহেতু রূপান্তরিত হবে সত্য কিন্তু তার অন্তর্নিহিত মৌলিক সত্যটি কোনক্রমে ম্লান হবে না । বিশ্বের দেশে দেশে আঞ্চলিক বৈষম্য রয়েছে, রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণ; অত্যাচার, অনাচার নিপীড়নের অবসান আজও ঘটেনি, আজও স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরেছে । অন্যগত বিশ্বে এই জাতীয় বৈষম্য, শোষণ-শাসন বা নিপীড়নের রূপান্তর ঘটবে বটে, তবে একেবারে তিরোহিত হবে না । এই জাতীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যধি নিরসনের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা প্রয়োজন এর নাম ৬ দফা না হলেও কিছু একটা হবে কিন্তু এর প্রতিষ্ঠাতার আবেদন চির ভাস্বর । মুজিববাদ তাই স্থান-কাল-জয়ী ।