সহুল আহমেদ মুন্না
<৬,১৫৪,২৫৩-২৫৪>
শিরোনামঃ সর্বশেষ জল্লাদী ষড়যন্ত্র
সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী, মুজিবনগরঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা
তারিখঃ ৫ অক্টোবর, ১৯৭১
.
সর্বশেষ জল্লাদী ষড়যন্ত্র
সম্পাদকীয়
ইতিহাসের কি বিচিত্র পুনরাবৃত্তি!
দুই শত বছর আগে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য ‘ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি’ উদ্ভাবন করিয়াছিল। এই পলিসি অনুসারেই তারা সুচতুর কৌশলে হিন্দু – মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করিয়া, ‘বঙ্গভঙ্গ’ করিয়া নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করিতে বহুলাংশে সক্ষমও হইয়াছিল। তারপর দীর্ঘদিন কাটিয়াছে। ভারতবর্ষ হইতে বৃটিশরা বিদায় নিয়াছে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের সেদিনের ঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষার তাগিদে অনুসৃত বিভেদ নীতির বিষাক্ত ছোবলের ক্ষতচিহ্ন এই উপমহাদেশের বুক হইতে আজিও নিঃশেষে মুছিয়া যায় নাই। সেই যে বৃটিশ আমলে বাংলা বিভক্ত হইয়াছে, ঘুরিয়া ফিরিয়া উহা দ্বিখন্ডিতই রহিয়া গিয়াছে – জোড়া লাগে নাই, লাগিবেও না।
.
আর আশ্চর্য! দুই শত বৎসর পরে বাংলাদেশে পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদী শাসন অব্যাহত রাখার জন্য জঙ্গীশাহী আজ সেই একই সনাতন বৃটিশ বিভেদ নীতিকেই তুরুপের তাস হিসাবে ব্যবহার করিতে উদ্যত হইয়াছে।
.
পররাজ্যলোভী পশ্চিম পাকিস্তানী শাসককুলের এই জঘন্য দুরভিসন্ধিটির প্রতিফলন ঘটিয়াছে জল্লাদ ইয়াহিয়ার প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের খসড়ায়। এই খসড়ায় বৃটিশ বিভেদ নীতিরই অনুসরণে বাঙ্গালী জাতির মধ্যে বিভেদ, বিদ্বেষ এবং শত্রুতার মনোভাব সৃষ্টির জন্য একদিকে হিন্দুদের ভোটাধিকার হরণ এবং অপরদিকে বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলকে তিনটি প্রদেশে ভাগ করার দূরভিসন্ধিমূলক সুপারিশ সন্নিবেশিত হইয়াছে।
.
পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গী সরকারের বেসরকারী মুখপাত্র পাকিস্তান টাইমসে ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রের একটি খসড়া প্রকাশিত হইয়াছে। জঙ্গী শাসনের অধীনস্থ জনগণের উপর চাপাইয়া দিবার উদ্দেশ্যে একটি শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ইয়াহিয়া খান কিছুদিন আগে যে কমিটি নিয়োগ করিয়াছিল সেই কমিটি খসড়া শাসনতন্ত্র রচনার অপকর্মটি সম্পন্ন করিয়াছে। পাকিস্তান টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, খসড়াটিতে হিন্দুদের ভোটাধিকার হরন করা হইয়াছে। কারণ স্বরূপ বলা হইয়াছ যে, হিন্দুদের ভোটের জোরেই আওয়ামীলীগ নির্বাচনে জিতিয়া পাকিস্তানকে ধ্বংস করিবার চেষ্টা করিয়াছে। সুতরাং হিন্দুদের ভোটাধিকার থাকা উচিত নয়। খসড়া শাসনতন্ত্রে বলা হইয়াছে, আওয়ামী লীগের কোন লোক দলের নামে বা বেনামে কোনদিন পাকিস্তানের কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিতে পারিবে না। সব চাইতে উল্লেখযোগ্য বিষয়, জল্লাদী শাসনতন্ত্রে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকাকে তিনটি পৃথক প্রদেশে বিভক্ত করার পরিকল্পনা সংযোজিত হইয়াছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী প্রদেশে গঠিত হইবে এবং প্রত্যেক প্রদেশের পৃথক আইন পরিষদ থাকিবে।
.
প্রত্যেক প্রদেশে গভর্নর থাকিবে এবং গভর্নরই মন্ত্রীদের নিয়োগ করিবেন।
.
জঙ্গীশাহীর রাজত্বে এখন কড়া প্রেস সেন্সরশীপ। তাছাড়া পাকিস্তান টাইমস সরকার সমর্থক পত্রিকা। আর ইয়াহিয়ার নিজের নিয়োগ করা কমিটি তার হুকুম মতই শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরী করিয়াছে ইহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই। সুতরাং ধরিয়া নেওয়া যায়, পাকিস্তান টাইমসে সে খসড়া শাসনতন্ত্রের বিবরণী ছাপা হইয়াছে, উহাই প্রকৃত জল্লাদী শাসনতন্ত্র। বাংলাদেশ এখন ইয়াহিয়া খানদের খাস তালুক নয়। বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাই বাংলাদেশের ব্যাপারে জঙ্গীশাহী কোন কথা বলিলে তা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপেরই সামিল হইবে। সে কারণেই ইয়াহিয়ার শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা নিয়া আমাদের কোন মাথাব্যাথা নাই। কিন্তু তবু, এ ব্যাপারে মন্তব্য করিতেছি আমরা শুধু এই কারণে যে, জল্লাদের এই সর্বশেষ তৎপরতার অন্তরালে রহিয়াছে এক সুগভীর চক্রান্ত। এ চক্রান্ত ভয়াবহ মারাত্নক, জঘন্য ইহার লক্ষ্য।
.
আমরা আগেই বলিয়াছি, উপনেশবাদী পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক – শোষকদের উদ্দেশ্য হইতেছে যে কোন প্রকারে হোক বিভেদ বিদ্বেষ তিক্ততা সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করিয়া তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখিয়া বাংলাদেশকে পন্য সামগ্রী বিক্রয়ের খোলা বাজার হিসাবে ব্যবহার করা এবং বাংলার মাটির সোনার সম্পদ ও বাঙ্গালীর হাড় – মাংস –কলিজা হরিলুটের বাতাসার মত কামড়াইয়া ছিড়িয়া খাওয়া। আর এই বদমতলব হাছিলের জন্য গণবিরোধী পশ্চিমা শাসককুল ছল বল কন কৌশল কম প্রয়োগ করে নাই। ন্যায্য দাবী – দাওয়া প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশে যখনই কোন গণ আন্দোলন দানা বাধিয়া উঠিয়াছে, নির্যাতন, নিপীড়নের স্টীম রোলার চালাইবার পাশাপাশি তখনই পশ্চিমা শাসকরা হিন্দু – মুসলমান, বাঙ্গালী – অবাঙ্গালী, স্থানীয় –অস্থানীয় প্রশ্ন উস্কাইয়া দিয়া বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণের মধ্যে বিভেদ – বিদ্বেষ, সংঘাত সৃষ্টির মাধ্যমে উহা বানচাল করিয়া দেওয়ার চেষ্টা করিয়াছে। সাম্প্রতিক অতীতকালেও দেখা গিয়াছে, ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন বানচালের জন্য ভাড়াটিয়া দুষ্কৃতিকারীদের উস্কাইয়া দিয়া প্রথমে তোলা হয় মোহাজিরস্তান প্রদেশ গঠনের দাবী। তারপর ওঠে পৃথক উত্তরবঙ্গ প্রদেশ গঠনের দাবী। কিন্তু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মুখে স্বার্থবাদীদের এই অপপ্রয়াস ব্যার্থ হইয়া যায়। তারপর আসে বিগত নির্বাচন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙ্গালী জাতি অতুলনীয় ঐক্যবদ্ধনে আবদ্ধ হয়। পাকিস্তানে বাঙ্গালীরা শতকরা ৫৬ ভাগ। এক লোক এক ভোটের ভিত্তিতে অনুষ্টিত নির্বাচনে জনগণ আওয়ামীলীগের হাতে সমগ্র পাকিস্তানের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের বৈধ অধিকার তুলিয়া দেয়ায় বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত হন সমগ্র পাকিস্তানের ভাগ্য বিধাতা হিসাবে। কিন্তু পাশ্চিম পাকিস্তানী শাসক ও শোসককুল জনগণের এই রায়কে সহজভাবে গ্রহণ করিতে পারে নাই। আর তার ফলে পরবর্তীকালে কি ঘটিয়াছে, কিভাবে জঙ্গীশাহী হিংস্র বর্বরতায় বাংলার মানুষের উপর পশুর মত ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে, কিভেব শ্যমল বাংলার বুকে দশ লক্ষ মানুষকে ঘরছাড়া নিঃস্ব কাঙ্গালে পরিণত করিয়াছে এবং সর্বোপরি ইয়াহিয়ার নিজের ভাষায় ‘পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’ শেখ মুজিবুর রহমান কে কারারুদ্ধ করিয়া তাহার জীবননাশের উদ্দেশ্যে বিচার প্রহসনের ষড়যন্ত্রে মাতিয়া উঠিয়াছে, সে কাহিনী সকলেরই জানা। আর ইহাও সকলেরই জানা যে, বর্বরতার দ্বারা বাঙ্গালী স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করিয়া দেওয়া সম্ভব হই নাই – সম্ভব হবেও না।
.
নির্মম বাস্তবের এই প্রতিকূল সূর্যরশ্মির সামনে দাড়াইয়া জল্লাদশাহী তাই নতুন কৌশলের আশ্রয় লইয়াছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারাই শাসনতন্ত্র রচনার পূর্বপ্রতিশ্রুতি বিস্মৃত হইয়া ইয়াহিয়া খান এখন মাতিয়া উঠিয়াছে স্বকপোল কল্পিত এক শাহী ফরমানের উপর শাসনতন্ত্রের লেবেল লাগাইয়া উহাই জনগণের উপর চাপাইয়া দেওয়ার তোঘলকি খেয়ালে।
.
জঙ্গীশাহী জানে, স্বাধীনতার যুদ্ধ বাঙ্গালী জাতির ঐক্যকে যেভাবে সুদৃঢ় ও সুসংহত করিয়াছে উহার কোন দ্বিতীয় নজির নাই। তারা জানে যে, এই ঐক্য ফাটল ধরাইতে না পারিলে নিজেদের দূরভিসন্ধি হাসিলের কোন আশা নাই। তাই এই ঐক্য ফাটল ধরাইবার সুচতুর কৌশল সংযোজিত হইয়াছে জল্লাদী শাসনতন্ত্রের খসড়ায়।
.
ইয়াহিয়া চক্রের ধারনা, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় তিনটি প্রদেশ গঠিত হইলে বাঙ্গালীরা আর এক কন্ঠে এক জাতি হিসাবে কথা বলিবার সুযোগ পাইবে না। বরং উল্টো, ক্ষমতা, দাবী – দাওয়া এবং স্বার্থের প্রশ্নে বিভিন্ন প্রদেশের জনগনের মধ্যে বিভেদ – বিদ্বেষ ও শত্রুতার মনোভাব সৃষ্টি হইবে। সেই অবস্থায় সহজেই বাংলাদেশেরই এক অঞ্চলের জনগণকে অরেক অঞ্চলের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাইবে। ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘসূত্রতার চোরাবালিতে আটকাইয়া যাইবে এবং অনৈক্যের ফাটল উহাকে দুর্বল করিয়া দিবে। ইহা ছাড়া হিন্দুদের ভোটাধিকার হরণ করা হইলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি এবং ঐক্যের ক্ষেত্রেই ফাটল ধরিবে। জঙ্গীশাহীর ধারণা, তারা যখন বাংলাদেশ ছাড়িয়া চাইতে বাধ্য হইবে, তারপরেও এই বিভেদনীতির বিষময় প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের এক অঞ্চলের জনগনকে আরেক অঞ্চলের জনগনের বিরুদ্ধে শত্রুমনোভাবাপন্ন করিয়া রাখিবে। একইরকম অসদ্ভাব বিরাজ করিবে হিন্দু – মুসলিম সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
.
কিন্তু এখানেও ভুল করিয়াছে ইয়াহিয়া খান। তার এই দূরভিসন্ধি বাস্তবায়িত হইবার নয়। শেখ মুজিবের মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালী জাতি এই সর্বশেষ জল্লাদী ষড়যন্ত্রও চূড়ান্তভাবে ব্যার্থ করিয়া দিবে।