রাশেদুজ্জামান রণ
<৬,১৬৮,২৮৭-২৮৮>
সংবাদপত্রঃ নতুন বাংলা ১ম বর্ষঃ ৫ম সংখ্যা
তারিখঃ ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
[* নতুন বাংলা। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাপ্তাহিক মুখপাত্র। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি(সভাপতিঃ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ) কর্তৃক বাংলাদেশ হতে মুদ্রিত ও প্রকাশিত।]
সম্পাদকীয়
এই যুক্ত কর্মদ্যোগকে
সংগ্রামের সকল স্তরে ছড়াইয়া দিন
যুদ্ধকালীন অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দানের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণকারী দলগুলির এক বৈঠকে একটি সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হইয়াছে। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, মওলানা ভাসানি পরিচালিত ন্যাপ, জাতীয় কংগ্রেসের এই যৌথ উদ্যোগকে বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ অভিনন্দন জানাইবে। সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন ব্যতীত সাফল্য অর্জন দুরূহ। বিশেষতঃ যেখানে আমাদের একটি সুশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্র-সজ্জিত নিয়মিত সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করিতে হইতেছে। যেখানে লক্ষ্য এক সেখানে পৃথক পৃথকভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই পরিচালনা সময় ও শক্তির অপচয়। শত্রুকে বিভিন্ন ফ্রন্টে পর্যুদস্ত করার জন্য সমস্ত জাতির সহযোগিতা সকল দলের ঐক্যবদ্ধ কর্মদ্যোগের মধ্যে প্রতিফলিত হইবে, স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসী ইহা আশা করিয়াছে। বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ সমন্বয়ে গঠিত ৮ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি তাহাদের সেই আশা পুরা করিতে সক্ষম হইবে বলিয়া আমরা ধরিয়া লইতে পারি।
সংগ্রামী দেশবাসী ও বিভিন্ন দলের সাধারণ কর্মীগণ এইভাবে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে শামিল হইলেও প্রায় ছয় মাস যাবৎ শত্রুর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত দলগুলি যার যার নিজস্ব পরিকল্পনা লইয়া শত্রুর বিরুদ্ধে সাধ্যমত লড়াই করিতেছিল। সুনিশ্চিতভাবে বলা চলে সাধারন শত্রুর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সংগ্রামে আপন আপন পথে চলার নজীর দেশবাসী খুব ভাল চোখে দেখিতে পারেনা। কারণ, সংগ্রামে জয়ের পথ ইহাতে অহেতুক জটিল ও দীর্ঘ হয়। পারস্পরিক সহযোগিতার স্থলে দেখা দেয় ভুল বুঝাবুঝি।
শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের কতিপয় পন্থা রহিয়াছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দেখা গিয়াছে যে, বৃটেনের রক্ষণশীল মন্ত্রীসভায় শ্রমিকদলীয় সদস্যদের গ্রহণ করা হইয়াছে। এইভাবে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে সকল মতের প্রতিনিধিস্থানীয় দলকে গ্রহণ করিয়া সাধারণভাবে নাজীবাদের বিরুদ্ধে তাহারা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম চালাইয়াছে। মন্ত্রীসভায় বিভিন্ন দলকে গ্রহণ করিয়া মুক্তফ্রন্ট গঠন করা যাইতে পারে। দ্বিতীয় পন্থা হইল ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তফ্রন্ট গঠন। ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইন প্রভৃতি কোন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনপুষ্ট ও সাহায্যপ্রাপ্ত চরম প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ সমন্বয়ে এই রকম যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। এই ধরণের যুক্তফ্রন্ট শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা হইতে মুক্ত এলাকায় শাসন ব্যবস্থা প্রভৃতি সংগ্রামের সকল স্তরে একটি সর্বোচ্চ পরিষদ হিসাবে কাজ করে। ইহার অধীনে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য থাকে সমর পরিষদ এবং মন্ত্রী পরিষদ।
ইহা ছাড়া তৃতীয় একটি পন্থা রহিয়াছে। বিভিন্ন দলের কর্ম পন্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং কিভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে অগ্রসর হইতে হইবে সে সম্পর্কে পরামর্শ দানের জন্য উপদেষ্টা কমিটি বা পরিষদ গঠন। উপদেষ্টা কমিটি গঠনের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য হইতে স্থির করা হয় যে উহা মন্ত্রীসভার অধীনে শুধুমাত্র সময়ে সময়ে পরামর্শ দিবে, না ইহা মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করিবে। কখনও কখনও এই ধরণের উপদেষ্টা কমিটি মন্ত্রীসভার অধীন হইয়া পড়ে আবার কখনও ইহা মন্ত্রীসভার সমান্তরাল ক্ষমতার অধিকারী হইয়া মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্তকে গুরত্বপূর্ণভাবে প্রভাবিত করে। উপরন্ত অনেক ক্ষেত্রে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করিয়া সরকার জনসাধারণের দাবী দাওয়া বিবেচনার নামে একটি রক্ষাবর্ম সৃষ্টি করে। অতীতে আমাদের দেশে প্রশাসনের ক্ষেত্রে এ ধরণের বহু অধ্যায় সংযোজিত হইয়াছে। কিন্তু কার্যকালে এই সব কমিটির তৎপরতা কাগজপত্রে সীমাবদ্ধ ছিল।
যুদ্ধকালীন অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দানের জন্য এই সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির গুরুত্ব অনেক। প্রথমতঃ শত্রুকে আঘাত হানার ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে সকল দলের মধ্যে সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত হইয়াছে। দ্বিতীয়তঃ বিভিন্ন দলের কর্মপ্রচেষ্টা ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ যাই হউক না কেন- ভিন্ন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হইয়াছে। লক্ষ্য এক হওয়া সত্ত্বেও এই প্রবাহগুলিকে তুলনা করা চলে নদীর সাথে। ছোট বড় সকল নদীই সমুদ্রে মিলায়। কিন্তু প্রবাহগুলিকে একটি প্রকাণ্ড খাতে পরিচালিত করিলে উহাতে সর্বপেক্ষা বেশী বেগের সঞ্চার হয়। বিভিন্ন দলের আওতায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সংগ্রামকে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিক ঐক্যবদ্ধ পথে পরিচালনা করিলে উহা হইতে সর্বাধিক ফল পাওয়া যায়। তৃতীয়তঃ এই উপদেষ্টা কমিটিতে যে নেতৃবৃন্দ রহিয়াছেন তাহাদের পশ্চাতে রহিয়াছে দীর্ঘদিনের সংগ্রামী ঐতিহ্য। পরাধীন আমলে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীবিরোধী সংগ্রামে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর স্বৈরাচারী সরকারের বিরোধী সংগ্রামের অগ্নিপরীক্ষায় ইহারা সকলেই উত্তীর্ণ সৈনিক। সুতরাং অতীতের প্রথম সারির সৈনিকগণ আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধকে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালনা করিলে জনগণের মনে অভূতপূর্ব উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার হইবে ইহা বলাই বাহুল্য।
এই উপদেষ্টা কমিটির নিকট হইতে আমরা এমন কর্মপন্থা আশা করিব যে, যুদ্ধ প্রচেষ্টার সমস্ত ক্ষেত্র হইতে রণক্ষেত্র পর্যন্ত এই ঐক্যের বিশাল বলিষ্ঠ কার্যক্রম সক্রিয় থাকে।
রণক্ষেত্রে ও প্রচারণা যুদ্ধে শত্রুর মোকাবেলার জন্য এই শক্তি পদক্ষেপের ফল ইতিমধ্যেই ফলিতেছে। অধিকৃত বাংলাদেশের পুতুল গভর্ণর ডাঃ মালিক কর্তার ইচ্ছায় প্রতিধ্বনি করিয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের সহিত আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছেন। শত্রু এই ঐক্যবদ্ধ শক্তির ভয়ে এমনই বেসামাল হইয়া পড়িয়াছে তাহারা এখন প্রলাপ বকিতেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদানের জন্য বিশ্বব্যাপী দাবী সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকিয়া আওয়ামী লীগের সহিত আলোচনার ইচ্ছা প্রকাশের মত নির্বোধ পুনরুক্তি করিতেছে।
শত্রুর বিরুদ্ধে আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী এক সার্বিক যুদ্ধে রত। এই সার্বিক যুদ্ধে সর্বক্ষেত্রে সমন্বয় সাধনের জন্য সংগ্রামী সকল দল মতকে আরো ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার পথে অগ্রসর হইতে হইবে। এই উপদেষ্টা কমিটি আমাদের সংগ্রামী ঐক্যের প্রতীক। ইহাকে সংগ্রামের সকল স্তরে যুক্ত কর্মদ্যোগের মধ্যে ছড়াইয়া দিতে হইবে। সংগ্রাম পরিচালনার সকল স্তরে কীভাবে সুষ্টু সমন্বয় সাধন করা যায় তাহা ছাড়াও ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের অধীনে সকল সংগ্রামী এই শরিক দলগুলিকে আরও তৎপর করিতে হইবে, ইহাদের মধ্যেকার সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ করিতে হইবে।