সৌ রভ
<৬,১৯০,৩৩০-৩৩১>
শিরোনামঃ স্বাধীনতাঃ ভিক্ষায়াং নৈব নৈবচ
সংবাদপত্রঃ সাপ্তাহিক বাংলা ( ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা )
তারিখঃ ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
স্বাধীনতাঃ ভিক্ষায়াং নৈব নৈবচ
এটা আজ অস্বীকার করে লাভ নেই, বৃহৎ শক্তিবর্গ ‘বাংলাদেশ’ সমস্যার ব্যাপারে পাকিস্তানের উপর বিশেষ কোন চাপ সৃষ্টি করতে পারেননি, বা ইচ্ছে করেই করেননি। কোন দেশই আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। খুব কম রাষ্ট্রই বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন বলে খোলাখুলি মত প্রকাশ করেছে। সরকারীভাবে অনেকেই ভারতে চলে যাওয়া শরণার্থীদের সম্পর্কে গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন, অনেক রাষ্ট্র সাহায্যও করেছে, কিন্ত প্রত্যেক ক্ষেত্রেই শরণার্থী সমস্যা ও বাংলাদেশ সমস্যা সম্বন্ধে বক্তব্যের ব্যাপারে বিরাট ব্যবধান লক্ষ করা গেছে।
রাষ্ট্রসংঘের বর্তমান অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এক শক্তিশালী দল পাঠান হয়েছে। তারা সেখানে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য তুলে ধরবার চেষ্টা করবেন। কিন্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রসংঘের সদস্য নয়। উপরন্তু পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। অধিকন্তু পাকিস্তান এখনও দাবী করে বাংলাদেশ পাকিস্তানেরই অঙ্গ এবং পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্র আজও পর্যন্ত তাই সরকারীভাবে বিশ্বাস করে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদলকে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে কিনা এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তদুপরি রাষ্ট্রসংঘের বর্তমান অধিবেশনের সভাপতি ইন্দোনেশিয়ার ডঃ আদম মালিক সরাসরি বলেছেন যে, বাংলাদেশ সমস্যা রাষ্ট্রসংঘে আলোচিত হোক তিনি তা চান না।
সরকারীভাবে বক্তব্য বলার সুযোগ না পেলেও বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল বেসরকারীভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সাথে আলাপ-আলোচনা চালাতে পারেন। কিন্ত তাতেও বিশেষ ফল হবে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রসংঘের অধিবেশন শুরুর প্রাক্কালে গোষ্ঠী নিরপেক্ষ দেশগুলির মন্ত্রিপর্যায়ের সম্মেলনে ভারতে বাংলাদেশ সমস্যা তুলেছিল। কিন্ত আলোচনা ফলপ্রসূ কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। পাকিস্তান বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হলে সারা বিশ্বে ইসলাম বিপন্ন হয়ে পরবে। তারা এখন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনে নিজেদের মত পালটাবেন বলে মনে হয় না।
বৃহৎ শক্তিগুলোর ভূমিকায় বাংলাদেশ সরকারের আনন্দিত হওয়ার কিছুই নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে পাকিস্তান দু’ভাগ হয়ে গেলে যে টাকা সে পাকিস্তানকে ধার দিয়েছে তা ফেরত পাবে না। বরং পাকিস্তান যদি টিকে থাকে তবে পাক-ভারত সমস্যাও থাকবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় রাষ্ট্রেই অস্ত্র ব্যবসায় নানাভাবে আর্থিক-দিক দিয়ে লাভবান হবে। তদুপরি তার ভয় বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিক্ষুব্ধ রাজনীতির শিকার হবে এবং ক্রমশ বামপন্থী রাস্তা ধরবে। তারচেয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হয়ে থাকলে সব সময় সেখানে একটা পশ্চিম পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব প্রবল থাকবে। যার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয়বাদীরাই সম্মুখভাগে থাকবে। চরম বামপন্থীরা কিছুতেই তাদের ঠেলে এগিয়ে আসতে পারবে না। এর ভিত্তিতে বিচার করলে বাংলাদেশ সরকারের যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায় প্রায় অসম্ভব।
চীনের ভয় আবার অন্য দিক থেকে। সে মনে করে বাংলাদেশ এখন স্বাধীন হলে জাতীয়বাদীদের ক্ষমতা চলে যাবে। বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে জাবে।তার চেয়ে যদি পাকিস্তান টিকে থাকে এবং পাকিস্তান বন্ধুত্বের সুযোগ চীনপন্থীরা বাংলাদেশ সংগঠিত হবার সুযোগ পায় মন্দ কি ? না হয় <ভাসবদিতকতাক> বাংলাদেশের ব্যাপারে দ্বিতীয় বার চিন্তা করা যাবে না। তাই বাংলাদেশের আই মুহূর্তে চৈনিক সমর্থনের আশা করা বৃথা।
রাশিয়া বাংলাদেশের ব্যাপারে সহানুভূতি দেখানো আর সক্রিয় সমর্থন করা এক কথা নয়। রাশিয়ার বর্তমান স্ট্রেটেজিই হলো কারো সাথে প্রত্যক্ষ সংঘাত এড়িয়ে চলা। মোট কথা কোন বিদেশী শক্তি যে আমাদের জন্য বড় রকমের কিছু করে বসবেন সেই সম্ভাবনা আদৌ কিছু দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন যে নিজেদের ভেতরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার চাপেই ইয়াহিয়া সরকার ভেঙ্গে পরবে। কিন্ত তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিরাট মতবিরোধের যে কথা এতদিন বলা হচ্ছিল তার অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। তবে মুক্তিবাহিনীর হাতে ব্যাপকভাবে নিজেদের লোক হতাহত হওয়ার ফলে নিম্ন পর্যায়ের সামরিক অফিসারদের মধ্যে কিছুটা মনকষাকষি দেখা দিতে পারে।
পশ্চিম পাকিস্তানের ভুট্টোই এখন ইয়াহিয়া সরকারের অন্যতম রাজনৈতিক সমস্যা। তিনি ঘন ঘন ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানাচ্ছেন। তাঁর দলই এখন জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতরাং পাকিস্তান শাসন করার অধিকার তাঁরই। ইয়াহিয়া খান কিন্ত এখন ক্ষমতা ছাড়তে রাজী নন। তিনি কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও কনভেনশন মুসলিম লীগের সংযুক্তি ঘটিয়ে তাঁর অনুগত একটি দল গঠনে সমর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশে পুনঃনির্বাচন প্রহসন চালিয়ে তিনি এই দলকে ক্ষমতায় আনতে চাইছেন। উপরন্তু ভুট্টো সাহেবের দল এখন প্রায় দ্বিধাবিভক্ত।
ওয়ালী খান পালিয়ে গেছেন। তাঁর দলের অনেকেই এখন বন্দী। বিগত নির্বাচন ও তার পরবর্তী রাজনীতির ধারা দেখে মনে হয় না, তিনি এমন কিছু করতে পারবেন যা ইয়াহিয়া খানের কাছে মারাত্মক হতে পারে।
বহু রাষ্ট্রই প্রকাশ্য ও গোপনে পাকিস্তানকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যাওয়ার আর্থিক চাপও কিছুটা লাঘব হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদন যেমন বন্ধ, উন্নয়নমূলক কাজও তেমনি বন্ধ। মোট কথা পাকিস্তান তার ভিতরকার রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আপনা থেকেই কেটে বলে যে ধারণা আমরা করেছিলাম, তা সহসা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে না।
আমরা এখন পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকারের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। এ যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের উপর নির্ভর করে বাঙ্গালী জাতির অস্তিত্ব। সুতরাং আমাদের স্ট্রেটেজি নির্ধারণের ব্যাপারে একটা ভাবাবেগ সামনে রাখলে আমরা ভুল করবো। আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি কোন বিদেশী রাষ্ট্রের চাপ নয়। নিজেদের কোন আত্মকলহ নয় বরং বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণই পশ্চিম পাকিস্তানী ইয়াহিয়া সরকারকে দিন দিন কাবু করে আনছে। আর এটা অত্যন্ত পরিষ্কার কথা, যে পথে চললে ফল পাওয়া যায় সে পথেই চলায় বুদ্ধিমানের কাজ।
দেশে ঘুরে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য হাতে পায়ে ঘরে বেড়ানোর চেয়ে অথবা নিজের দেউলেপনায় অসহায় হয়ে কবে আমাদের ডেকে নিয়ে পাকিস্তান স্বাধীনতা বুঝিয়ে দেবে তার অপেক্ষায় বসে থাকার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধ তিব্রতর করার দিকেই এখন সমস্ত যুক্তি কেন্দ্রীভূত করা উচিত। ভিক্ষুকের মনোবৃত্তি নিয়ে অপরের সাহায্যের আশায় বসে না থেকে যেদিন আমরা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠবো, একমাত্র সেদিনই দেশ থেকে শত্রুদের চিরতরে বিতাড়িত করা যাবে।
বিশ্বের ইতিহাস প্রমাণ করেছে ভিক্ষার মাধ্যমে কোন জাতির কোন ন্যায্য দাবী আদায় হয়নি। সার্বিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন সর্বাত্মক সংগ্রাম।
– সঞ্জীব চৌধুরী