২২৩. ১৬ ডিসেম্বর জনমত

আব্দুল্লাহ আল নোমান

<৬,২২৩,৩৭৬>

শিরোনামঃ জনমত

সংবাদপত্রঃ জাগ্রত বাংলা (১ম বর্ষঃ ৯ম সংখ্যা)

তারিখঃ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

জনমত

সেদিন আমাদের মুক্তিবাহীনির জনৈক উচ্চপদস্থ মুক্তিযোদ্ধা অন্য একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রুঢ়ভাবে ধমাকাচ্ছিলেন। যাঁকে ধমকনো হচ্ছিল তিনি নাকি সেন্ট্রির দায়িত্ব ঠিকমত পালন করতে পারেননি।

ঘটনা সামান্য। কিন্তু সামান্য ঘটনার সম্বন্ধেই জন্ম নেয় বৃহৎ ঘটনা। আজকের স্বাধীনতা সংগ্রাম এমনি সব সমন্বয় ঘটনার প্রতিবাদে বিদ্রোহ সংগ্রাম ব্যাপারটাও সামান্য কিছু ঘটনারই সমাবেশ-পোষ্টার বক্তৃতা একটা বুলেট, ছোট এ কথা না বোজার পিছনে ‘পজিশন’ ট্রিগার সামান্য চাপ-এ করেই সম্ভব। চলছে এক বিরাট পরিবর্তন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের চূড়ান্ত মুক্তি। কাজেই সামান্য এবং সাধারণ ঘটনাগুলোকে উড়িয়ে দেয়াটা নির্বুদ্ধিতার পরিমাণ-পতন।

 

মুক্তিবাহিনীতে যে কোন সেনাবাহিনীর মতি যোগ্যতা অনুযায়ী পদ কিংবা পদবী থাকবে এইটেই স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ সেনাবাহিনীর চেয়ে মুক্তিবাহিনীর গঠন আলাদা। তরুণরা এখানে নেহায়েত চাকুরির জন্য আসেননি। তবু ইয়াহিয়ার সৈন্যর মত ভাড়ার সৈন্য নয়; তাদের অনুপ্রেরণার মূলে রয়েছে দেশাত্নবোধ।সুতরাং এখানে উচ্চপদস্থকে কর্কশ স্বরে ধমকাচ্ছে- এই যে একটা অগণতান্ত্রিক দৃশ্য, এটা একবারেই খাপ খায় না। বাংলাদেশের অর্থ পাকিস্তান থেকে আলাদা একখন্ড জমি নয়, পাকিস্তান আমলের কলুষিত ভাবধারা থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত হবার জন্যই বাংলাদেশের অগণতান্ত্রিক আমলাসুলভ। আপনি হয়ত কারো সাথে প্র্যোজনীয় কাজে দেখা করতে চাইলেন-তিনি আপনাকে সহজেই দেখা দিতে পারেন, কিন্তু আপনাকে ‘প্রপার চ্যানেল’ নামের একটা বূহ্য পেরিয়ে আসতে হবে। মানুষে মানুষে এই যে কৃত্রিম দূরত্ব, একটা কনমতেই স্বাধীন দেশী রীতি হতে পারে না; সমাজতান্ত্রিক দেশের তো নয়ই।

 

ধরা যাক সেই সেন্ট্রিটা কর্তব্য পালনে ভুল করেছিল। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে এতো স্বল্প সময়ের ফৌজে জীবনে ভুল না হওয়াই বরং অস্বাভাবিক। সেইজন্য একজন বুদ্ধিমান যোদ্ধা তার সহযোদ্ধাকে ধমক দিয়ে অপ্রস্তুত করে দিবে না, কিংবা তাকে খুব চড়া গলায় শাসিয়ে দিয়ে মজা পেতে চাইবে না, বরং তার ত্রুটিগুলো ঠান্ডা মাথায় শুধরে দিতে প্র্যাস পাবে। যেমন, এদিকে এসো, তোমাকে দেখিয়ে দিই কী ক’রে সেন্ট্রি দিতে হয়। এই যে আমি রাইফেল নিয়ে সোজ়া হয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুমি ওদিক থেকে আসতে থাকা-হল্ট। ঠিক আছে? লোকটা একটু দূরে থাকতেই হল্ট বলবে। বেশী কাছে এসে গেচলে যদি ওর সাথে মারাত্নক অসুখ থাকে তবে কী দশাটা হবে নিশ্চয় বুঝতে পারছো। এইটেই সবচেয়ে সুন্দর ও কার্যকরী পন্থা; কারণ এরপর তার আর ভুল হতে পারে না। এবং যা ইছু সুন্দর তাই গণতান্ত্রিক।

 

মানুষের পারস্পারিক আচার-ব্যবহারের মধ্যে সামরিক অসামরিক ব’লে কিছু নেই। সেনা বিভাগ গোটা সমাজের একটা বিরাট অংশ। কৃষি, শিল্প, পরিবহন ইত্যাদি বিভাগ যেমন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সমাজের প্র্য়োজনীয়তা পূরণ করে সেনাবিভাগের বেলায়ও তাই। কিন্তু এটা অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ এজন্যেই যে, যখন কোন পশুশক্তির অবির্ভাব ঘটে, তখন তা বল প্রয়োগে বিচ্ছেদ করার জন্যে সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া পথ থাকে না। এবং হিক এজন্যই সৈনিককে হতে হয় সব রকম অসুন্দর ও অন্যায়বিরোধী মানুষ। সবচেয়ে গণতান্ত্রিক মানুষ।

Scroll to Top