কম্পাইলারঃ নোবেল
<৬,২৬৭,৪৫৩-৪৫৬>
সংবাদপত্রঃ অভিযান ১ম বর্ষঃ ২য় সংখ্যা
তারিখঃ ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১
.
বাংলাদেশঃ ইতিহাস থেকে ইতিহাসে
সিকান্দার আবু জাফর
বাঙলা আর বাঙালীর সাথে
অন্তরঙ্গ হবে যদি- পূর্ববঙ্গে এসো,
মনে মনে আমন্ত্রণ পৃথিবীর কাছে
কতবার কত লগ্নে ছড়িয়ে দিয়েছি।
.
গৌরবের দেহভরা প্রয়ারের ক্ষত
শৌর্যের প্রলেপে ঢেকে- আশ্রুরক্তে ধুয়ে
বাঙালীত্ব করেছি নির্মল ,
মনে মনে তাই বড় অহঙ্কার ছিলো।
.
শত শত বছরের সুপ্রস্ত রাজপথে হাঁটা
মধুসূদন বঙ্কিম থেকে
রবীন্দ্র নজরুল জীবনানন্দ- বাঙালীর যা কিছু সুন্দর,
মহতের বৃহতের বিচিত্রভঙ্গিম
যত কিছু আত্মজ প্রত্যয়
এখানেই উচ্চারিত প্রত্যেকের কলকণ্ঠস্বরে।
.
এখানেই বাঙালীর মন
ওতপ্রোত বারোমাস ছায়াছায়া রৌদ্ররেণু মাখা
যেখানে ফুলের লজ্জা লুকানো সুঘ্রাণে;
মাঠভরা সবুজের শান্তি কণাকণা
হৃদয় জড়িয়ে নিতে প্রমত্ত যেখানে
সহস্র নদীর প্রেম আঁকাবাঁকা নিরন্তর পথে,
উৎকীর্ণ ঋতুর দর্পণে
প্রসাধিত প্রকৃতির অঙ্গসজ্জা ইন্দ্রজাল দেখে
এখানেই বাঙালীর প্রাণ-
বারম্বার গেয়ে ওঠে সহজ সন্তোষে
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ ……
দুষপ্রাচ্য নীতির পথে বিকারের ধূলিকণা মেখে
এখানে বিভ্রান্ত নয় বাঙালীর মন।
.
নতুন মূল্যায়নের নামে
একদিকে চেতনার শূন্য সিংহাসন
হতমানে মানবিক সুকুমার বৃত্তির বিদায়,
নতুন আলোর পথে দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর অন্যদিকে
এখানে এখানো নয় দিনান্তের আতঙ্ক-প্রহার;
অনুভূতি মৃত টিকটিকি হয়ে আজো
ঝুলছে না কীটদষ্ট হৃদয়ের কপট দেয়ালে
এই পূর্ববঙ্গে।
.
এখানে এখনো বাঙালীর মন
চড়ুইয়ের অনর্গল দুর্বোধ্য কলহ
বাবুইয়ে ইমারতে ঝড়ের নিশ্চয় দাপাদাপি
টুনটুনি শালিকের শ্রীহীন কুটিরে মুখরিত শান্তিনিকেতন
হিমহিম শিশিরের কোলে
শেফালীর গন্ধমাখা সুখশয্যা ধুসর চাঁদের
মেঘনার কালোজলে গাঙচিল মেঘ
আকস্মাৎ ইলিশের দু চোখের বিস্ময়ে আঁকা
সুচিত্রিত পদ্মার অঞ্চল
নদীর নির্জন ঘাটে কিশোরীর কলসের নিটোল সঙ্কেত
হয়ত বা গোক্ষুরের পম্পট তর্জন
রজনীগন্ধার ঘ্রাণে উল্লসিত জোনাকী নর্তকী
ঈর্ষা ঘৃণা ভালোবাসা অনুরাগ বিরাগের কারুকার্য কত
.
মনে মনে তাই
পৃথিবীকে আমন্ত্রণ পাঠিয়ে দিয়েছি কতবারঃ
ইতিহাস ভূগোলের স্মারক মিলিয়ে
বাঙালীর আত্মার আত্মীয় হবে যদি
পূর্ববঙ্গে এসো।
.
আকস্মাৎ মাঝ রাত্রে কোনো
ঘুম ভেঙ্গে অপ্রস্তুত চোখের প্রদীপ চেয়ে দেখি
বাঙালী ও বাঙ্গালীত্ব রক্তস্রোতে ভাসমান ভেলায় নিশ্চল
নগর বন্দর গ্রাম,সহস্র যোজন
প্রান্তরের যত শব্দ পলাতক মৃত্যুর সন্ত্রাস।
.
এবং দক্ষিণে বামে পশ্চাতে সম্মুখে
আমার প্রাণের প্রাণে বঙ্গজননীর
প্রতি অঙ্গ জর্জরিত অগ্নির চাবুকে।
জননী বাঙলা যেন জ্বেলেছে নিজের দেহ
সিবিশাল ধর্ষণের চিতা।
.
আর সেই হাহাকার কোটি কোটি
মূঢ় দীর্ণ হৃদয়ের ব্যার্থ হাহাকারঃ
হে সময়, কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাও
হাজার বছরের লেখা বাঙালীর দীপ্ত ইতিহাস?
.
কেই নেই-কেউ নেই- বধির সময়
কে দেবে উত্তর!
মুছে দিতে অপারগ যারা
বাঙালীর নামের সঙ্কেত,
তাদের মিছিলে ভিড়ে বাঙলার মানচিত্র থেকে
নিষ্ক্রান্ত আমিও।
তারপর অনিশ্চিত পথে
তাদের সবার সঙ্গে আমিও পথিক
বারম্বার অচেনার দাক্ষিণ্য প্রত্যাশী।
হৃদপাত্রে নঈরাশ্যের লাঞ্ছনা জমিয়ে
মাঝে মাঝে ভাবি এই ব্যাধিজীর্ণ দেহ টেনে নিয়ে-
ফিরে যেতে পারব না পূর্ববঙ্গে
আমার বাঞ্ছিত বাঙলা দেশে,
মনে মনে পৃথিবীকে আমন্ত্রণ
বুঝি আর জানানো হবে না।
তখনি সহসা বেজে ওঠে
জীবনের সুরভগ্ন সমস্ত বাঁশীতে
যৌবনের বীর্যোদ্ধত কন্ঠের আশ্বাসঃ
তারা বলে, ভয় নাই আমার ত’ আছি,
এই ঘৃণ্য আঁধারের কণ্ঠনালী আমরা দুহাতে
ছিঁড়বোই জেনো।
.
বিনিময়ে শত শত নদী
রক্তে যদি ভরে যায় যাক,
রক্তের অভাব নেই বাঙলার কোটি কোটি তরুণের দেহে
বাঙলার মানচিত্রে তোমরাও ফিরে যাবে
আমাদের সাথে
আশক্ত দেহের ভর কাঁধে কাঁধে ভাগ করে নেবো
তবু ফিরে যাবো-
বাঙলার কোল থেকে নিরুদ্দিষ্ট তাবৎ সন্তান
সাথে নিয়ে সুনিশ্চিত তবু ফিরে যাবো
.
ফেলে আসা বাঙলার নগরে নগরে রাজপথে
গ্রামে গ্রামান্তরে
নতুন সড়কে;
যে- সড়ক সুপ্রশস্ত রাজপথ হবে
মৃত্যুঞ্জয় কালের তোরণে।
.
তাই হ’ক, তবে তাই হ’ক
বীর্যশুল্কে বাঙলার তরুণেরা- কেড়ে নাও জয়ের মুকুট।
আমি ততদিন শুধু প্রাণপণে প্রাণধারণের
ক্লান্তি বয়ে চলি।
.
সাড়ে সাত কোটি মৃত্যুঞ্জয় বঙ্গ- সন্তানের
ইতিহাস থেকে আরো দীপ্ত ইতিহাসে
যখন সগর্ব উত্তরণ,-
দু’চোখের সর্বশেষ রশ্মিরাগে যেন
আমি শুধু এঁকে যেতে পারি
সেই ক্রান্তি- লগ্নটির দীপ্ত মুখচ্ছবি।