অনুবাদঃ ইফতেখার হাসান
<৬, ২৮৮, ৪৯৪-৪৯৫>
শিরোনাম | সংবাদপত্র | তারিখ |
‘নতুন ভিয়েতনাম’ এর পূর্বাভাষ | বাংলাদেশ
ভলিউম ১, ক্রমিক ৯ |
২৫ আগস্ট, ১৯৭১ |
পাকিস্তানের জন্য মার্কিন সমরাস্ত্র
বাংলাদেশের মানুষের উপর ইয়াহিয়া সরকারের অমানবিক নিপিড়ণের বিরুদ্ধে দুনিয়াজুড়ে চলমান নিন্দা আর সমালোচনা সত্বেও, রক্তপিপাসু পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে সরমাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার নীতি পরিত্যাগ করেনি নিক্সন প্রশাসন। মূলতঃ মার্কিন সমরাস্ত্রে সজ্জিত হবার কারণেই ইয়াহিয়া এরকম একটি ন্যাক্কারজনক সামরিক অভিযান শুরু করার সাহস পেয়েছিল, তা স্বত্বেও নিক্সন তার সমর্থন অব্যাহত রেখেছেন। অথচ নিক্সনের পক্ষেই সম্ভব ছিল ইয়াহিয়াকে যৌক্তিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনা। নৃশংস সামরিক নিপিড়ণের নিন্দা জানানোর বদলে তিনি ইতোমধ্যে সুসজ্জিত ও বেপরোয়া এই সামরিক শক্তিকে আরো অস্ত্র-শস্ত্র আর রসদ জুগিয়ে যাচ্ছেন।
ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপারটমেন্টের এক মুখপাত্রের বয়ান অনুযায়ী মার্চ ১৯৭২ এর মধ্যে তারা প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের সমরাস্ত্র সরবরাহ করবে – গনতন্ত্রের ধব্জাধারীরা কেবল অস্ত্র-শস্ত্র জুগিয়েই ক্ষান্ত হয়নি! সমস্ত লক্ষণ এটাই বলে যে ইয়াহিয়া সরকারের পেছনে মার্কিন সমর্থন ক্রমশঃ বাড়বে।
মার্কিন সরকারের দাবী অনুসারে ১৭টি ১০০০-টন ধারণক্ষমতার জাহাজ প্রস্তুত করা হয়েছে দেশের অভ্যন্তরে খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করার জন্য। আদতে এগুলো সামরিক কাজে ব্যবহার করা হবে, এটি সবার জানা আছে যে ইয়াহিয়ার খুনি বাহিনীর জন্য জরুরী ভিত্তিতে নৌযান প্রয়োজন যাতে তারা নদীমাতৃক বাংলাদেশের আনাচে কানাচে প্রবেশ করতে পারে।
মার্কিন-বান্ধব যেসব পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছে ভিয়েতনামের ‘গ্রীন বেরেট’ এর আদলে তারা এ মুহূর্তে বাংলাদেশেই অবস্থান করছে। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত এই ‘অদম্য’ সৈনিকেরা বিশেষকরে গণহত্যা, স্যাবোটাজ, গুপ্তহত্যা আর নির্যাতন করায় পারদর্শী। বিশ্বস্ত সুত্রে এও জানা গেছে যে এক ডজনেরও বেশি আমেরিকান ‘বিশেষজ্ঞ’ কোয়েটা, বালুচিস্তান আর ঢাকায় পাকিস্তানিদের বিচ্ছিন্নতাবিরোধী অভিযানের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এটা লক্ষণীয় যে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও মার্কিন বিশেষজ্ঞরা একই রকম ভূমিকা পালন করেছিল। ভিয়েতনামের মত বাংলাদেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে যুক্তরাস্ট্র সরকার বেশ উন্মুখ বলেই মনে হচ্ছে।
মার্কিন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ভিয়েতনামের জন্য বরাদ্দ করা মার্কিন সমরাস্ত্র ঢাকা ও করাচিতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। দক্ষিণ ভিয়েতনামে ‘গনতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য বরাদ্দ করা এইসব অস্ত্র এখন এখানে এসে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া যে বোয়িং উড়োজাহাজটি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বহরে যুক্ত হয়েছিল সেটি এখন বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনা পাঠানোর কাজে নিয়োজিত হয়েছে।
এর বাইরে নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের জন্য আরও এক মিলিয়ন ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যা ব্যবহৃত হবে ছয় মাসের জন্য ১৮টি জলযান কিনতে যা দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায় ও লোকেদের কাছে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছান যায়।
বর্তমানে প্রায় ২০০ মার্কিন ত্রাণ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদেরকে মার্কিন সরকার নির্দেশনা দিয়েছে বেসামরিক জনসাধারণকে বিচ্ছিন্নতা বিরোধী প্রশিক্ষণ দিতে। এই বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে।
আর সর্বোপরি, ভিয়েতনামে ব্যবহৃত কিছু মার্কিন ‘কোবরা’ হেলিকপ্টার পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে যাতে তারা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আমূলে দমন করতে পারে।
এই সব বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অশুভ পরিকল্পনারই প্রমাণ দেয়। তবে ইয়াহিয়া বাহিনীর সমর্থনে মার্কিন এই নীতি বেশি দীর্ঘায়ু হবেনা। ৭৫ মিলিয়ন মুক্তিকামী মানুষ এই যুদ্ধবাজ নিপীড়কদের কাছ থেকে ঠিকই বিজয় ছিনিয়ে আনবে। কোরিয়া, ভিয়েতনাম আর লাওসে ন্যক্কারজনক পরাজয় থেকে যুক্তরাষ্ট্র কোন শিক্ষা গ্রহণ করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছেনা। ঠিক যে মুহূর্তে নিক্সন ভিয়েতনাম থেকে সেনা প্রত্যাহার করার কথা বলছেন, তিনি বাংলাদেশে নিজের হাতকে আরও বেশি রক্তাক্ত করতে ইচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে। মার্কিন সেনাদের যত বড় দলই আসুক না কেন, তারা ইয়াহিয়াকে বাঁচাতে পারবেনা। তারা কেবল ইতিহাসের পাতায় হত্যাকারী কসাই ইয়াহিয়ার সহযোগী হিসাবে নিক্সনের নামটাই প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তবে এই গনহত্যার নীতি থেকে নিক্সনের সরে আসার এখনও সময় আছে। সিনেটর কেনেডি, সিনেটর বোয়েলস গলব্রেথ বা কংগ্রেসম্যান গ্যালাহার এর মত অপেক্ষাকৃত সুবুদ্ধিসম্পন্ন নেতাদের পরামর্শ গ্রহণ করাটাই তার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।