অনুবাদঃ সৈকত জয়ধর
<৬, ৩০৫, ৫২৬-৫২৭>
শিরোনামঃ স্পষ্ট ভাষণ
সংবাদপত্রঃ দি নেশন
তারিখঃ ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
.
সোজাসুজি কথা
বাংলাদেশ আজ রক্তাক্ত। দেশের মানুষ আজ নির্যাতন ও মর্মবেদনায় উচ্চস্বরে ক্রন্দনরত। যে রক্তগঙ্গা বিশ্ব দেখেছে বাংলার মাটিতে, তা বর্বরতা ও পাশবিকতার বিচারে নজিরবিহীন। ক্ষমাহীন ভাবে যে মুনূষ্যরক্ত ঝরিয়েছে পাকবাহিনী, সেই রক্তে আজ এই হতভাগ্য অঞ্চলের শহর ওও নগরের মাটি সিক্ত। তাদের কাছে এই যুদ্ধ ক্ষয়ের। বাঙালীদের কাছে এ হল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এটা এমন এক যুদ্ধ, যা আমরা কখনও চাই নি। এটা এমন এক যুদ্ধ, যা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ক্ষমতালোভী সামরিক জান্তার দ্বারা। তারা চায় আমাদের কন্ঠ চেপে ধরতে, চায় পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আধিপত্য থেকে আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে মেরে ফেলতে। স্বাধীনতা আমাদের জন্মগত অধিকার, স্বাধীনতা আমাদের জীবনরেখা, যে স্বাধীনতা ছাড়া আমরা বয়ে বেড়াই আমাদের অসুস্থ অস্তিত্ব। স্বাধীনতাহীন অস্বিত্ব আত্মাহীন দেহের মত, প্রাণহীন হাত-পায়ের মত। যা কার্যত মৃত্যুর সমান।
পৃথিবীতে বসবাসরত অষ্টম বৃহত্তম জাতি হিসেবে বাঙ্গালীরা কখনই স্বকীয়তা হারাতে চাইবে না। কোন দেশই আত্মহননের পথে রাজী হবে না। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক ও পূর্ব পাকিস্তানী শাসিতের মধ্যে একটি স্বার্থের সংঘাত আছে। পাশবিক শক্তির দ্বারা স্ফীত সেনাবাহিনীর মারমুখী মনোভাব বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণকে বাধ্য করেছে অহিংসার শক্তিতে জেগে উঠতে। বাঙালীদের সদিচ্ছার প্রাচুর্যের প্রতিদান কখনোই তারা পায় নি। আমাদের বিনয়কে সবসময় ধরা হয়েছে আমাদের দুর্বলতা হিসেবে। শান্তির শক্তি ক্ষতবিক্ষত হয়েছে নৃশংসতার নির্মম প্রদর্শনীর দ্বারা। নৃশংসতার ভয়াবহতা দখল করে নিয়েছে শান্তিপ্রিয় বাংলার মাটি। সামরিক জান্তার অসহনীয় ও আক্রমণাত্মক মনোভাব শান্তিপ্রিয় বাংলাকে পরিণত করেছে এক যুদ্ধক্ষেত্রে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত আধুনিক সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে নিরস্ত্র জনগণের উপর। লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। মানুষের বসতবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। অগণিত মানুষ প্রাণের ভয়ে বাড়িছাড়া হয়ে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে। মানবহত্যার পাশবিকতা হিটলারের “গেস্তাপো-প্রক্রিয়া” এবং “স্কেয়ার-ক্রো” পদ্ধতিকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। বাংলার জল, স্থল ও আকাশ অমানবিক নৃশংসতার এবং অমানুষিক যন্ত্রণার নিপীড়নের আর্তনাদে প্রকম্পিত হচ্ছে। রক্তপিপাসু জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষায় পাশবিকতাই মানুষের একমাত্র সম্পদ। যৌক্তিকতা পাশবিকতার কাছে পরাজিত হয়েছে। তা না হলে কিভাবে নারী, পুরুষ ও শিশুকে এমন নির্দয়ভাবে হত্যা করা সম্ভব এমন জমির উপরে দাঁড়িয়ে, যাকে কিনা তারা আজ পর্যন্ত দাবী করে তাদের দেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে।
শত্রুপক্ষ ভুল করেছিল এই ভেবে যেয়াধুনিক সেনাবাহিণির দ্বারা তারা নিমিষেই “বাঁশের লাঠি-সজ্জিত বাহিনী”কে ধ্বংস করে দেবে। আমরা বাঙালীরা কখনোই যুদ্ধ চাই নি। আমরা কখনও প্রস্তুতও ছিলাম না যুদ্ধের জন্য। কিন্তু যখন সেই যুদ্ধই আরোপিত হল আমাদের উপর, তখন তা হয়ে দাড়ালো আমাদের সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্ন। স্বাধীন জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে আমাদের অস্তিত্ব, অথবা অমর্যাদাকর পরাধীনতার দাসত্ব মেনে নেয়া- এই দু’য়ের মধ্যে প্রশ্ন হয়ে দাড়ালো এ যুদ্ধ। বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জাতি কি মেনে নেবে ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও বশ্যতা? না, কখনোই না। প্রথমটিকেই তাই বেছে নিতে হল আমাদের। আজ আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার অগ্নিশিখায় আজ আমাদের হৃদয় জ্বলছে। বর্বরতার বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে গত দুই মাসে আমাদের সীমাহীন আত্মত্যাগ স্বীকার করে নিতে হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমরা যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছি। ২৬ মার্চ বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। স্বাধীনতার পতাকাকে আমাদের সমুন্নত রাখতে হবে। স্বাধীনতার চেতনা আমাদের মধ্যে সদাজাগ্রত থাকবে। শহীদের রক্তে সিক্ত স্বাধীন এ সমতল কখনও হারিয়ে যাবে না।
আমরা সাহসিকতা, সংকল্প ও সংযমের সাথে আমাদের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের সম্মুখশক্তি মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যেই তাদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যে শত্রুপক্ষের কাল্পনিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের পর্যাপ্ত জনশক্তি আছে। আমাদের এখন যা দরকার, তা হল সমরাস্ত্র। আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত নারকীয় শত্রুবাহিনীকে দমন করা আজ অবশ্য করণীয়। শুধুমাত্র তখনই পাকিস্তানি লুটেরারা বুঝতে পারবে তারা কাদের সাথে যুদ্ধে নেমেছে। শুধুমাত্র তখনই শত্রুপক্ষ বাধ্য হবে যুদ্ধে অব্যাহতি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পাহাড়ি ভুমি ও সীমাহীন মরুভূমিতে পালিয়ে যেতে। নদীবিধৌত বাংলাদেশই হবে ইয়াহিয়া খানের জন্য ওয়াটারলু।
বাংলাদেশের লাখ লাখ ক্ষুধার্তের জন্য আমরা খাদ্য চাই। শস্যভাণ্ডার আর গুদামঘরগুলো ইতিমধ্যেই ইয়াহিয়া বাহিনী পুড়িয়ে ফেলেছে অথবা লুট করে নিয়ে গেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর অধীনস্থ অঞ্চলগুলোতে ইতিমধ্যেই দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে। উপরন্তু আশি লক্ষ বাঙালী ভারতের পাঁচটি প্রদেশ জুড়ে সীমাহীন অভাবের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। তাদের এখন জরুরি ভিত্তিতে খাদ্য ও অষুধ দরকার। এই মানুষগুলোর জীবন বাঁচাতে হবে। যুদ্ধাক্রান্ত এই হতভাগ্যদের প্রতি পুরো দুনিয়ার দায়িত্ব রয়েছে। বিশ্বমানবতার কাছে আমরা এসকল আর্তমানবতার ত্রানের জন্য আকুল আবেদন জানাই।
এছাড়াও আমরা বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি চাই, যে সরকার দেশ শাসনের অধিকার বহন করে। ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত কার্যত শেখ মুজিবই সরকারকে নিয়ন্ত্রন করেছেন। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হল। পশ্চিম পাকিস্তান তাদের দখলদার বাহিনীর দ্বারা কিছু বিচ্ছিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রন করলেও বাংলাদেশের কোন শহর বা নগরের উপর তাদের কোন নিয়ন্ত্রন নেই। এমনকি প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর দ্বারা।
যদি অঞ্চলের উপর কার্যকরী নিয়ন্ত্রনের দ্বারা স্বীকৃতি নির্ধারিত হয়, তবে পশ্চিম পাকিস্তান অনেক আগেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার হারিয়েছে। একথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় যে শেখ মুজিব সরকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। তাঁর জনগণ শুধুমাত্র তাঁর প্রতিই
.
আনুগত্য স্বীকার করে। এ ধ্রুবসত্যকে হানাদার বাহিনীর মেনে নেয়া উচিত। এটা এখন দিনের আলোর মত পরিষ্কার। গত নির্বাচন এই উজ্জ্বল সত্যকেই আরো শক্ত ভিত্তি প্রদান করে। স্বাধীনতাপ্রিয় বিশ্বজনতা এতদিনে বাংলাদেশে বিরাজমান বাস্তবতাকে বুঝতে পেরেছে। বহমান বায়ুর গতিপথ সবাই বুঝতে পারছে। হানাদার বাহিনীর নির্মমতাকে উপেক্ষা করে টিকে থাকা নতুন এ জাতিটি তাদের যোগ্যতার বলেই স্বীকৃত হবার দাবি রাখে। এটি একটি ন্যায়সঙ্গত দাবি। এর শিকড় বাংলার মাটির গভীরে বিরাজমান। তাই বাংলাদেশের স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ অনিবার্যকেই মেনে নেয়া।