অনুবাদঃ তাসমিয়াহ তাহসিন
<৬, ৬৫, ৬৯৯-৭০০>
শিরোনামঃ সম্পাদকীয়
সংবাদপত্রঃ বাংলাদেশ, টরেন্টো, নং ৩
তারিখঃ ২৫ আগস্ট, ১৯৭১
.
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশ সংগ্রামের সময় থেকে, দীর্ঘদিনের ফুঁসতে থাকা সুপ্তাবস্থা গত মার্চে তীব্র কর্মকান্ড রূপে বিস্ফোরিত হয়, আকস্মিক এই পরিবর্তনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে আমাদের মন দ্বন্দযুক্ত এবং আমাদের আত্মা বাঙ্গালিদের দুঃখ-কষ্ট ও প্রাণবন্ততায় ছোঁয়া।
যে গনহত্যা ৭০ লক্ষ্য বাঙ্গালিদের দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে তা পুরো বিশ্বকে স্তব্ধিত করেছে। এই অধিকারচ্যুত মানুষগুলো তাদের এক সময়ের স্বদেশীদের মরণাস্ত্রের মুখোমুখি হওয়ার চেয়ে অন্যের দেশে রোগ ও অপুষ্টির মুখোমুখি হতে রাজি। যে ভয়ানক অভিজ্ঞতার মধ্যে তারা অতিক্রম করেছে, তারা এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে। এই অবস্থায় পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া তাদের জন্য আত্মঘাতী হবে। এবং “রাজনৈতিক সমঝোতা”-র সম্ভাবনা একদম নেই। তাদের শুধু একটি আশা-যা তাদের একটি উন্নত ভবিষ্যত দিতে পারে- সে আশা জয়ের আশা। জয় মুক্তিবাহিনীর, জয় বাঙালি মানুষের।
বাংলাদেশের মধ্যে ইয়াহিয়া খানের বাহিনী তাদের ত্রাসের সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্বের ইতিহসের সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত হয়ে, কেউ কথা বলতে সাহস করে না। কিন্তু মানুষের মনে শুধু একটিই ভাবনা- যখনই সুযোগ আসে, অত্যাচারীদের হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া এবং স্বাধীনতা অর্জন করা। পাকিস্তানের সরকার সেটি জানে। সেজন্যই তারা বাঙ্গালিদের নিরুৎসাহিত করতে তীব্র প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা জনপ্রিয় বাহিনীগুলোকে পাকিস্তান বিরোধী অশুভ ভারতীয় চক্রান্তের অংশ হিসেবে অভিযুক্ত করে “দুষ্কৃতিকারী” বলে চিহ্নিত করে। হিন্দু হওয়াকে অপরাধ বানিয়ে তারা ধর্মকে বিভেদকারী শক্তি হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়াস করে। তারা সহযোগীদের নিয়ে “শান্তি কমিটি” প্রতিষ্ঠা করে। সবার একটাই লক্ষ্য- মানুষের পরাধীনতা।
কি আছে যা এই মানুষদের আশা দিতে পারে , যারা জুলুমের মধ্যে বাস করছে, যাদের জীবন ও সহায়-সম্বল কখনোই সুরক্ষিত নয় এবং যারা তাদের বর্তমান দূর্দশার সাথে সাথে আসন্ন দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ? তাদের জন্য “ইসলামিক” পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্রের “একতা ও অখন্ডতা” মানেই শোষিত উপনিবেশবাসী হিসেবে তাদের ভূমিকা পালন করা। তাদের আশাও শুধু জয়ের জন্য। মুক্তিবাহিনীর জয়ের! বাঙালি মানুষের জয়!
যারা প্রবাসে বসবাস করছেন, বাঙালি হিসেবে আপনাদের সুযোগ আছে এই অতিপ্রয়োজনীয় জয়ে অবদান রাখার। আপনারা এই অত্যাচারীদের বিরূদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারবেন, এবং বিশ্বের প্রভাবশালী মানুষদের কাছে ও সচেতন নাগরিকদের কাছে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য জানাতে পারবে্ন। আপনারা তাদের সমর্থন ও স্বীকৃতি আদায়ের জন্যে চেষ্টা করতে পারবেন। আপনাদের চুপ থাকার কোন বৈধ ছুতো নেই। আপনাদের মৌনতা দেশে আপনাদের পরিবার পরিজনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেনা। কেউ সেখানে নিরাপদ নয়। তাই গর্জে উঠো বাংলাদেশ।
বাঙ্গালিদের জয়ে অবদান রাখার আরেকটি উপায় হচ্ছে আপনাদের অর্থনৈতিক সমর্থন। হতে পারে আপনি খুব অল্পই দিতে পারবেন, কিন্তু এই ক্ষুদ্র পরিমাণও এই প্রচেষ্টায় জোরালো সমর্থন দিতে অন্যদের অবদানের সাথে যুক্ত হবে। প্রতি মাসে কিছু কিছু দান করুন। আপনাদের অর্থনৈতিক সমর্থন অব্যাহত থাকাটা প্রয়োজন। মানুষেরা যেখানে প্রাণ ত্যাগ করছে, সেখানে আপনাদের একটি ত্যাগই যথেষ্ঠ- শুধুমাত্র আর্থিক অবদান। উদার হতে দ্বিধা করবেন না।
বাংলাদেশ মানে অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি। এর মানে সত্যিকারভাবে মানুষের বিশ্ব-নীতির গনতন্ত্র। এর মানে একটি পার্থিব প্রদেশ যেখানে সকলের জন্য সমতা থাকবে। এইসবকে বাস্তবরূপ দিতে অনেক বাঁধা পেরোতে হবে । আপনার সমর্পিত সহায়তা এই স্বপ্নকে সত্যি করতে সাহায্য করতে পারে। দেশবাসীর দুঃখ-কষ্টকে বৃথা যেতে দিবেন না। নিজেকে সংগ্রামে সমর্পন করুন। বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয়কে নিজের বিজয় করে নিন।