<৪,১১৫,২০০-২০৪>
অনুবাদকঃ দিব্য কান্তি দও
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১১৫। ‘জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ’ বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞের উপর একটি প্রচার পুস্তিকা | ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হুসাইন | ১৯৭১ |
বাংলাদেশে গণহত্যা
সাখাওয়াত হোসেইন
ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল
দ্বিতীয় মুদ্রণ
নতুন মূল্য ৫ পেন্স
১৯৪৪ সালে ডাক্তার রাফায়েল লেমকিন প্রবর্তিত শব্দ ‘গণহত্যা’ বলতে বোঝায়, অন্যান্য জিনিসের মধ্যে (ক) মেরে ফেলা; (খ) গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা; (গ) স্বেচ্ছায় বিবাদে জড়িয়ে পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবে জাতীয় একটি নৈতিক গোষ্ঠী কিংবা একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করা (অনুচ্ছেদ ২, গণহত্যা নীতি)। ৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৯ এ সাধারণ সমাবেশে গণহত্যা নীতি পাস করা হয়। উক্ত নীতিটি নৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান থেকে একটি সর্বসম্মত ঘোষণা যে, “গণহত্যা আন্তর্জাতিক আইনে একটি গুরুতর অপরাধ, জাতিসংঘের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যের বিপরীত এবং সভ্য বিশ্বে নিষিদ্ধ (জাতিসংঘ প্রস্তাবনা (১) ১৯৪৬ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রস্তাবিত নীতিমালা)। এটি ১৯৫৭ সালের ১২ জানুয়ারী কার্যকর হয়। পাকিস্তানসহ ৬৮ টি সরকার এই নীতিমালায় স্বাক্ষর করে।
জার্মানির নাৎসি সরকার কৌশলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাদের ধর্মীয় অথবা জাতিগত উৎপত্তির কারণে ধ্বংস করে। এইধরণের অপরাধ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনা ছিল- পুরো হতবিহ্ববল বিশ্ব তখন এই তর্ককে বাতিল করেছিল, যা তাদের নাড়া দেয়। ‘আন্তর্জাতিক সামরিক বিচারসভা’র হুকুমনামা নুরেমবার্গে পুরো বিশ্বের মতামতকে একত্রিত করে এবং ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ ধারণাটিকে স্বীকৃতি দেয়, তা সংঘটিত দেশের জাতীয় আইন ভঙ্গ করুক বা না করুক।
নীতিমালার চতুর্থ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সংঘটিত সরকারের দায়িত্বরত শাসক, সরকারী চাকুরীজীবি কিংবা সাধারণ ব্যক্তিসহ যে ব্যক্তি গণহত্যা অথবা অনুচ্ছেদ-৩ এ উল্লেখিত যেকোন অপরাধ সংঘটনে জড়িত থাকবেন তাকে শাস্তি দেয়া হবে। মুক্তির হাহাকারের প্রতি এই নিষেধাজ্ঞাই সেইসব মারাত্মক এবং কঠোর দিকগুলোকে নির্দেশ করে যার প্রতি নীতিমালার বিধানগুলো প্রয়োগ করা হবে।
১৯৪১ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রায় ১২০০ মাইল দূরত্বে বাংলাদেশ। পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠান, পাঞ্জাবি এবং সিন্ধুদের ভাষাগত এবং সংস্কৃতিগত দিক থেকে চিহ্নিত করা যায়। সংস্কৃতিগত দিকসহ পুরোপুরিভাবেই বাঙালিদের থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আলাদা। বাংলাদেশের সব মানুষ বাংলার মত একটি সুগঠিত ভাষায় কথা বলে। সংস্কৃত এর মূল। একজন বাঙালি কবি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ এ ভাষায় কথা বলেনা। বাঙালিরা জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, আবহাওয়া এবং রাজনৈতিক আচরণগত দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে আলদা। রাজনৈতিক প্রথাগত দিকের পার্থক্যে কিছুটা বিস্তার পাকিস্তানের সৃষ্টি করা
সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগ ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের ওপর থেকে এর নিয়ন্ত্রণ হারায়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে প্রথম সুযোগেই তারা নাস্তানাবুদ হয়। এই নির্বাচন একনায়ক আইয়ুব খানের মিলিটারি শাসনামলে (১৯৫৮-১৯৬৯) পুনরায় অনুষ্ঠান করা ছিল মেকি এবং জোর করে আরোপিত। বাংলাদেশে ২৩.৬ ভাগ মানুষ হিন্দু (১৯৬১ আদমশুমারী)। বাংলাদেশ ১৯৫৬ সালে যৌথ নির্বাচনের পক্ষে ইচ্ছা প্রকাশের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পক্ষে মতামত দেয়। অন্যদিকে পাকিস্তানের অভিজাতরা ইকবাল এবং তার প্যান-ইসলামিক মতবাদের পক্ষ নিয়ে গড়িমসি করতে লাগল। ১৯৫৩ সালে আহমাদী-ক্বাদিনী (দুই বিদ্রোহী মুসলিম গোষ্ঠী) দাঙ্গায় পাঞ্জাবে ৫০,০০০ লোক মারা যায় এবং লাহোরে শিয়া-সুন্নী (দুই বিদ্রোহী মুসলিম গোষ্ঠী) ধর্ম নিয়ে অসাধুতা এবং পাকিস্তান যে একটা নড়বড়ে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এর পক্ষে ইতিবাচক সাক্ষ্য দেয়।
উপরোন্তু, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির মুসলিম নিয়ে একটি নতুন বিভেদপূর্ণ মতবাদের প্রবর্তনা করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের চোখে বাঙালিরা হিন্দু থেকে মুসলিমে রুপান্তরিত হয়েছে। এর প্রধান কারণ অবশ্যই বিগত পঁচিশ বছরে বাঙালি যে অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়েছিল সেটি। বাঙালীর প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণির ইচ্ছাকৃত শোষণের দ্বারা বাঙালির কায়িক জীবন নিঃশেষের জন্য করা কাজে তাদের মৌন সম্মতি ছিল, যা বোঝার জন্য বিভেদের মতবাদ গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ব পাকিস্তানে সর্বশেষ বন্যায় (১৯৭০) আনুমানিক পাঁচ লাখ লোক মারা গেছে। পাকিস্তান প্রশাসনের গা ছাড়া ভাব খুব ভালভাবেই সকলের অবগত।
অর্থনৈতিক শোষণের মাত্রা প্রদর্শনের জন্য আমাদের ‘প্রধান স্বদেশী উৎপাদন’র পণ্যের উৎপাদনে অবদানের শুধুমাত্র কিছু চিত্র উল্লেখ করতে হবে। বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তান একই জায়গা থেকে শুরু করেছিল (পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৯৬৩)। ১৯৫৯-১৯৬৯ সালের ভিতর পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ৩২ শতাংশ বেশি ছিল। ১৯৬৯-১৯৭০ সালের ভিতর তা বেড়ে ৬১ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায় (চতুর্থ পাঁচ বছরের পরিকল্পনা ১৯৭০-৭৫ এর উপদেষ্টার প্রতিবেদন। খন্ড-১; পরিকল্পনা কমিশন, পাকিস্তান সরকার। প্রতিবেদনের অনুমানগুলো ন্যূনতম, সরকারি মৌলিক তথ্যের সমন্বয়ের অভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে দাম অনেক বেড়ে যায়)।
বিগত পঁচিশ বছরে পাকিস্তানের মোট রপ্তানির ৫০-৭০ শতাংশেই বাংলাদেশের অবদান ছিল, সে তুলনায় বাংলাদেশে আমদানির ভাগ ছিল মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ (পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অফিস কর্তৃক ইস্যুকৃত সরকারী পরিসংখ্যান)। জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশের আমদানি করার কথা ছিল ৬৭.৫ শতাংশ। ১৯৪৮-১৯৪৯ থেকে ১৯৬৮-১৯৬৯ সালের ভিতর বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে কমপক্ষে ২৬০ কোটি ডলার স্থানান্তর করা হয়েছে (পূর্ব পাকিস্তানে দ্বন্দ্ব, পটভূমি এবং বিস্তৃত দৃশ্য, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন অধ্যাপক)। এই সম্পূর্ণ শোষণ (গ), অনুচ্ছেদ ২ মোতাবেক বাঙালী নামক একটি স্বতন্ত্র জাতির ওপর গণহত্যা সংঘটিত করেছে।
অনুচ্ছেদ ৩ এ উল্লিখিত নীতিমালা অনুযায়ী বিভিন্ন কর্মকান্ড শাস্তিযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে, যথা (ক) গণহত্যা; (খ) গণহত্যা সংঘটনের জন্য ষড়যন্ত্র; (গ) গণহত্যা সংঘটনের জন্য সরাসরি অথবা জনগণের ভিতর উত্তেজনা সৃষ্টি করা; (ঘ) গণহত্যা সংঘটনের চেষ্টা এবং (ঙ) গণহত্যায় সহযোগিতা।
পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা যেসব নীতিমালা অনুযায়ী অপরাধ সংঘটিত করেছে তা হল- (ক)। রাত ১০.৩০ টায় আক্রমণ শুরু হয়েছিল। কোন কারফিউ জারি করা হয়নি এবং কোন পূর্বনির্দেশনা ছিলনা। আক্রমণ পূর্বনির্ধারিত ছিল। তারা নির্বিচারে পুরুষ, মহিলা এবং শিশু হত্যা এতিমরা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা নিয়ে বেড়ে উঠবে- শিশুদের মারার পিছনে তারা এই যুক্তি প্রদর্শন করে। উপ-অনুচ্ছেদ (ঙ)। অনুচ্ছেদ ২ অনুযায়ী, “এক গোত্রের শিশুকে অন্য গোত্রে স্থানান্তর” একটি গুরুতর অপরাধ। তারা আবাসিক এলাকায় নিজের বিছানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে এবং বস্তিতে নিরস্ত্র বাঙালীকে নির্বিচারে হত্যা করে। জার্মানীর নাৎসি বাহিনী প্রথমে মানুষকে শিবিরে একত্র করেছিল এবং এরপর জবাই করে হত্যা করেছিল। এর সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশে পাশবিকতার পরিমাণ এরচেয়েও বেশি ছিল।
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া এবং জনাব ভূট্টো আলাদাভাবে নীতিমালা (খ) এবং (ঙ) এর আওতায় দোষী। রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অতর্কিত আক্রমণের এগারো দিন পূর্ব থেকে তিন ঘন্টা পূর্ব পর্যন্ত আলোচনায় নিয়োজিত ছিলেন। জনাব ভূট্টো সেই আলোচনার একটি অংশ ছিলেন। অতর্কিত হামলা সম্পন্ন হওয়ার পর সকাল আটটায় রাষ্ট্রপতি তার হিংস্র স্বরে (ডেইলি টেলিগ্রাফ) দেশের প্রতি বক্তব্য রাখেন। একই সকালে জনাব ভূট্টো সাংবাদিকদের বলেন, “সৃষ্টিকর্তা পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন”। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, তারা আলোচনার দ্বারা সমাধানের পরিবর্তে সৈন্য প্রস্তুত করার জন্য সময়ের সদ্ব্যবহার করছিলেন।পশ্চিম পাকিস্তানের বিশটি পরিবার যারা সাবেক পাকিস্তানের ৮৫ শতাংশ সম্পদের মালিক ছিল তারা (ঙ) নং নীতিমালা অনুযায়ী গণহত্যায় সহায়তার দায়ে শাস্তির আওতাধীন। বৈদেশিক রপ্তানি এবং বাজারের জন্য বাংলাদেশ তাদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিম পাকিস্তানের অবকাঠামো সুগঠিত। বর্তমান বাজাতে পশ্চিম পাকিস্তানের রপ্তানির ৪০ শতাংশ দ্রব্যই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে বিধায় বাংলাদেশ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিম পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদীরা বিকল্প বাজারের জন্য হন্যে হয়ে খোঁজ করছিলেন যা ব্যর্থ হয়। আরসিডি এই চেষ্টার একটি উদাহরণ। ১৯৬৮ সালের উত্থানের পর থেকে পাঞ্জাবি (স্থানান্তরিত অধিবাসীসহ), শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আমলারা বুঝতে পারলেন যে, বাংলাদেশকে বেশিদিন দাবিয়ে রাখা যাবেনা। এজন্য তারা বাংলাদেশে তাদের শিল্পকারখানা, ব্যবসা এবং আর্থিক লেনদেন বন্ধ করে দিতে লাগলেন। কিন্তু, বিকল্প বাজার না থাকা সত্ত্বেও তারা ১০-১২ বছর এই বাজার ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং মূমূর্ষু সময়েও তারা মত পরিবর্তন করলেন না। এই গণহত্যা তাদের এই জেদেরও ফল।
সেনাবাহিনীর সকল উচ্চপদস্থ সদস্য পশ্চিম পাকিস্তানি, এমনকি সরকারী চাকরিতেও অধিকাংশ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাদের। ১৯৬০ সালে এই পরিমাণ ছিল ৮৭ শতাংশ যা এখনও পর্যন্ত খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং সরকারী উভয় ক্ষেত্রেই একটি শীর্ষক এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসন চালায়। উপরোন্তু, তিন লক্ষ পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের সম্পদের অন্যায় অধিগ্রহণ ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবেনা। পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী, সরকারী চাকুরে এবং শোষকেরা তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব সুবিধার্থে চক্রান্ত করে এই গণহত্যা সংঘটিত করেছে। তাদের প্রত্যেকে অনুচ্ছেদ ৩ এর (খ) এবং (গ) নং নীতিমালার আওতাধীন।
সংবাদপত্র এবং বিশ্বস্ত সূত্রের খবর অনুযায়ী, সেনাবাহিনী “ইয়া আলী, ইয়া হায়দার” স্লোগান নিয়া গণহত্যা সংঘটিত করেছে। এটি ‘জিহাদ’- ‘নাস্তিকদের বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধ’র প্রচলিত স্লোগান। মতদীক্ষাদান এবং ষড়যন্ত্রের দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য এবং জনগণকে বিশ্বাস করানো হয়েছে যে, ‘কাফির (অবিশ্বাসী-হিন্দু)’ এবং ‘অর্ধ-কাফির (রূপান্তরিত মুসলিম)’দের মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে। সৈন্যরা পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার পর মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। তারা জনগণের ইসলামে বিশ্বাস প্রমাণ করার জন্য তাদের চর্মচ্ছেদকৃত লিঙ্গ প্রদর্শনের জন্য জোর করছে। সাবেক পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী মৃত ফিরোজ খান নুন একদা বলেছিলেন, অধিকাংশ বাঙালির খৎনা হয়না।
সৈন্যদল নারীদের ধর্ষনের হাত থেকে বাঁচার জন্য কোরআন থেকে আয়াত পাঠ করতে বাধ্যকরছে। এই দিকগুলো ইয়াহিয়ার সৈন্যদের ধর্মান্ধতা প্রমাণ করে। তারা বাঙালিদের বিরুদ্ধে একটি ধর্মযুদ্ধ চালাচ্ছে।
হিন্দু এলাকাগুলো বিশেষ লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনেকেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং তাদের প্রত্যেকে মারা পড়েছে। বিশিষ্ট হিন্দুদের তাদের ধর্মের কারণে কায়দা করে হত্যা করা হয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধ্বংস করার জন্য সৈন্যদের উদ্দেশ্য একদম সুস্পষ্ট।
বুদ্ধিজীবীরা আরেকটি বিশিষ্ট লক্ষ্য। অনেকে ইতোমধ্যে মৃত এবং অধিকাংশকেই দেশ থেকে পলায়নে বাধ্য করা হয়েছে। বুদ্ধিজীবিদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং বাংলাদেশকে ধ্বংস করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের একটি পরিকল্পিত অংশ। যদিও পশ্চিম পাকিস্তানের (১৩.৬) চেয়ে বাংলাদেশে (১৭.৬) শিক্ষিত মানুষ বেশি ছিল তথাপি ১৯৫১ সালে ৪১,৪৮৪ স্নাতকের বাংলাদেশ ১৯৬১ তে ২৮,০৬৯ জন স্নাতকের বাংলাদেশে পরিণত হয়, যেখানে এ সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে এ সংখ্যা ২১.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পায় (আদমশুমারী পাকিস্তান- ১৯৬১)।
জাতীয় বিচারালয়ে উপযুক্ত বিচারের জন্য অনুচ্ছেদ ৫ ও ৬ প্রণয়ন করা হয়েছে। এইধরনের জাতীয় অপরাধ সংঘটনের পর পার পেয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এই নীতিমালায় আন্তর্জাতিক প্যানেল ট্রাইব্যুনালের বিবেচনার দ্বারা বিচার প্রত্যাশাও অন্তর্ভূক্ত। অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী, গণহত্যা এবং অন্যান্য উল্লিখিত কর্মকান্ড রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবেনা। তথাপি, স্বাক্ষর অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়াসহ সকল ব্যক্তি গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক প্যানেল ট্রাইব্যুনালের বিচারের আওতায় আন্তর্জাতিক প্যানেল বিচারের ধারণা উপযুক্ত এবং তা অনুচ্ছেদ ৬ এ প্রণীত। পরবর্তীতে সাধারণ সভার আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিচারিক অঙ্গসংগঠন প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখা হয়েছে যাতে করে “গণহত্যা এবং অন্যান্য অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের দায়ভার আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী এই সংগঠনের ওপর অর্পণ করা যায়”। কমিশনটি একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধী বিচারালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরামর্শ প্রদান করে। এটি এখনও জাতিসংঘের বিবেচনায় রয়েছে। জাতিসংঘকে এর কার্যকারিতা প্রদর্শনের দ্বারা অতিসত্ত্বর বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়টি সমাধানের জন্য একটি বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।অনুচ্ছেদ ৮ অনুযায়ী, যেকোন সংযুক্ত দল জাতিসংঘের উপযুক্ত সংস্থাকে এর দলিলের আওতায় গণহত্যা এবং এর সম্পর্কিত অন্যান্য কর্মকান্ড বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানাতে পারবে। দলিলটি নিরাপত্তা সংস্থার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে যার মধ্যে “অর্থনৈতিক সম্পর্কের সাময়িক কিংবা পুরো ব্যাঘাত এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের গুরুত্ব (অনুচ্ছেদ ৪১)”, উপপাদন, আকাশ, জল অথবা সড়কপথে যেকোন আক্রমণ ব্যাহত করার জন্য জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর শক্তি ব্যবহার করা (অনুচ্ছেদ৪২) অন্তর্ভূক্ত (অধ্যায় ৭, জাতিসংঘের দলিল)।
পরিশেষে, গণহত্যা নীতিমালার অনুচ্ছেদ ৯ অনুসারে, স্পষ্টত স্বাক্ষরিত রাষ্ট্রের যে কেউ আন্তর্জাতিক আদালতের সামনে বর্তমান নীতিমালার ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগ সহ জড়িত দলের মধ্যকার বিতর্ক সহ ইস্যুটি তুলে ধরবে এবং সেইসাথে অনুচ্ছেদ ৩ এ বর্ণিত গণহত্যার জন্য জড়িত রাষ্ট্রের দায়ও তুলে নিশ্চুপ পৃথিবীকে এখনই জেগে উঠতে হবে, এখনই।
এই পুস্তিকার প্রথম প্রকাশনা এক সপ্তাহের ভিতর শেষ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় প্রকাশনা একরকমের দায়ভারই ছিল। কিন্তু এসময়েই অপ্রত্যাশিত বাঁধাটা এল। প্রথম প্রকাশনায় একমাত্র অর্থসহায়তাকারী ছিলেন জনাব আব্দুল হামিদ যা বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকাশনার জন্য অর্থসহায়তা কোথা থেকে আসবে? প্রকাশকেরা যখন মাথার চুল ছিঁড়ছিলেন তখন আবার বিশাল হৃদয়ধারী প্রস্তুত অর্থসাহায্যের সাথে জনাব আব্দুল হামিদ এবং জনাব শফিকুর রহমান এগিয়ে এলেন। এই দুই ভদ্রলোকের কাছে আমরা চিরঋণী যা কখনো শোধ করা যাবেনা।
একজন উদার মানুষের কাছে বারবার সাহায্য চাওয়া সম্ভবপর নয়। তাই আমরা এবার এই পুস্তিকার জন্য একটি মূল্য নির্ধারণ করেছি যা ৫ নতুন পেন্স। এই চিন্তা অপরাধবোধ থেকেই উদ্ভূত যা বস্তুগত সমর্থনের জন্য প্রয়োজন। এটা আমাদের আশা যে, আমাদের অপরাধবোধের প্রতি সুবিচার করা হয়েছে।
আমির আলি
শামসুল মোর্শেদ
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
আব্দুল হামিদ
ও
শফিকুর রহমান
আমির আলি এবং শামসুল মোর্শেদ কর্তৃক ২৯ রুপার্ট স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত।
লন্ডন ডব্লিউ১