<৪,১৯৪,৩৮৯-৪০৩>
অনুবাদকঃ সুদীপ্ত কুমার সাহা, নুরুন নাহার জুঁই, শিরোনামহীন-১, মাহীন বারী, মুশাররাত আলম মৌ
শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৯৪। ‘আমরা’ গোষ্ঠী কর্তৃক প্রেরিত বিভিন্ন ইন্দোনেশিয় প্রচার মাধ্যমে প্রচারের জন্য লিখিত বাঙ্গলাদেশ সম্পর্কিত একটি দলিল | ‘আমরা’ | ১৬ অক্টোবর,১৯৭১ |
মহামান্য,
ভিতরে আটকানো পাবেন একটি বিস্তারিত রচনার প্রতিলিপি যেটি তৈরী করেছিল “কামাল” ১৯৭১ সালের এপ্রিলে স্থানীয় প্রচার,তথ্য এবং মন্তব্যের(যদি থাকে) জন্য।
দয়া করে এটিও মনে রাখবেন যে “মৃতঃ এমএস ইসলাম” অভিহিত প্রবন্ধটি যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৫ই এপ্রিল,১৯৭১ এর “জাকার্তা টাইমস” এ সেটিও “কামাল” এর লেখা ছিল ও সেটিতে “কামাল” এর অবদান ছিল।
গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে প্রত্যুত্তর/পরামর্শ নিম্নোক্ত ঠিকানায় পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হচ্ছেঃ
জনাব কামাল গুপ্ত
C/O গ্রুপ অধিনায়ক এন সিনহা রায়
ভারতীয় দূতাবাস,জাকার্তা,ইন্দোনেশিয়া।
পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে
ভারত সরকার,নয়া দিল্লী
বিনম্র শ্রদ্ধার সহিত
জয় বাংলা
আপনার আন্তরিক
“আমরা”এর জন্য কামাল
এইচ.ই.জনাব হোসাইন আলী
হাই কমিশনার বাংলাদেশ,ভারতে,কলকাতা।
পাকিস্তান-এর জন্ম এবং মৃত্যু
ভূমিকা
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান ব্রিটিশ ভারত থেকে উৎপত্তি হয়েছিল।পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল দুইটি অংশ নিয়ে-পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান।এই দুইটি অংশ ১৬০০ কিলোমিটার ভারতীয় অঞ্চল দ্বারা বিভাজিত ।দুইটি অংশের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল আকাশপথ যেটাতে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘন্টা এবং সমুদ্রপথ যেটাতে সময় লাগে প্রায় এক সপ্তাহ।পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি।দুটি অংশই ভূগোল,জাতি,ভাষা,সংস্কৃতি,রীতি-নীতি এবং অভ্যাসের দিক দিয়ে একে অপরের থেকে ভিন্ন ছিল।পূর্ব পাকিস্তান অবস্থিত দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় যেখানে পশ্চিম পাকিস্তান অবস্থিত মধ্য এশিয়ায়।দুইটি অঞ্চলের জনগনের মধ্যে একমাত্র সাধারণ বিষয় ছিল ধর্ম,যা ছিল ইসলাম।পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণ মুসলিম ধর্মাবলম্বী-প্রায় সবাই সুন্নী।বাকিরা ছিল হিন্দু,বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান।
পশ্চিম পাকিস্তানিরা মূলত মুসলিম,কিন্তু তারা শিয়া,সুন্নী,আহমাদিয়া(কাদিয়ানি) ইত্যাদি বিভাগে বিভক্ত।প্রসঙ্গক্রমে বর্তমান পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান একজন শিয়া।
II.পাকিস্তান আন্দোলন
ব্রিটিশ ভারতে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু করে মুসলিম লীগ যেটি প্রতিষ্ঠা করেছিল বাঙালি নেতারা ১৯০৬ সালে ঢাকায়(পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী)।পাকিস্তান গঠনের পরিকল্পনা ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিমের লীগের সম্মেলনে উত্থাপন করেন বিখ্যাত বাঙালি নেতা এ কে ফজলুল হক।লাহোর পরিকল্পনা বিবেচনা করে যে পাকিস্তান গঠিত হবে এমন কয়েকটি সার্বভৌম রাজ্য নিয়ে যেসব অঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যা বেশি।পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা যারা মুসলিম স্বাধীনতা আন্দোলনের পথপ্রদর্শক ছিল তারা কিন্তু স্বাধীনতা লাভের সময় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবি করেনি।তারা এই আত্মত্যাগটি করে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি তাদের ভ্রাতৃত্ববোধের কারনে।যাই হোক পরের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, পাকিস্তান সৃষ্টির আগে ও পরে তাদের করা সকল অবদান ও আত্বত্যাগ ছিল অস্বীকৃত।
III.পাকিস্তানে পূর্ব বাঙালিদের অবস্থা
সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও শুরু থেকেই পূর্ব বাঙালিরা প্রশাসন,পরিষেবা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিজেদের প্রাপ্য ভাগ পাচ্ছিলো না।পাঞ্জাবীরা যারা প্রতিরক্ষা ও বেসামরিক বিভাগে আধিপত্য বিস্তার করেছিল আত্মপ্রকাশ করে দেশের নতুন শাসক ও বাঙালিদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে।তারা শুধু বাঙালিদের উপেক্ষাই করেনি,তারা বাঙালিদের চিহ্নিত করে দেশপ্রেমহীন,রাষ্ট্রের শত্রু,ভারতীয় দালাল ইত্যাদি হিসেবে।এ কে ফজলুল হক,যিনি অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং পাকিস্তান গঠনের পরিকল্পনা লাহোরে এনেছিলেন,মুসলিম লীগ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বারা। তিনি অনেক হয়রানির শিকার হয়েছিলেন এবং তার দেশপ্রেম নিয়ে পাকিস্তানের পাঞ্জাবী শাসকরা সন্দেহ প্রকাশ করতো। ঢাকার খাজা নাজিমউদ্দীন,যিনি জনাব জিন্নাহর মৃত্যুর পর গভর্নর জেনারেল হন এবং পরে জনাব লিয়াকত আলী খানের গুপ্তহত্যার পর প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহন করেন, পাঞ্জাবী গভর্নর জেনারেল গুলাম মুহাম্মদের দ্বারা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হন।বগুড়ার(পূর্ব পাকিস্তান) মোহাম্মদ আলী, যিনি ঐতিহাসিক ব্যান্ডাং সম্মেলনে অংশগ্রহন করেছিলেন, তিনিও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হয়েছিলেন।
আরেক বিখ্যাত বাঙালি নেতা হোসাইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যিনি পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনিও পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন।মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী, যিনি শুধু একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না ছিলেন একজন সুপরিচিত ধর্মীয় নেতা যার পূর্ব পাকিস্তানে ছিল বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী তিনিও নির্বিচারে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের দ্বারা সাম্যবাদী ও রাষ্ট্রের শত্রু বলে চিহ্নিত হয়েছিলেন।মওলানা ভাষানী ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বর্তমান আওয়ামী লীগের দুইজন প্রতিষ্ঠাতা।শেখ মুজিবর রহমান,আওয়ামী লীগের বর্তমান প্রধান,তার রাজনৈতিক প্রশিক্ষন পান সোহরাওয়ার্দী ও ভাষানী দুইজনের কাছ থেকে।শক্তিশালী ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় উল্লেখেযোগ্য অবদান রাখেন।তার জন্ম পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যবিত্ত পরিবারে এবং তিনি ইসলামি ন্যায়বিচার ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী।তাকে মনে করা হয় মধ্যমপন্থী।পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি সর্বদাই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিয়ে লড়াই করেছেন।পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা ও শিল্পপতিদের উপনিবেশ স্থাপন ও শোষণের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদের কারণে তার কুখ্যাতি হয় রাষ্ট্রের শত্রু এবং ভারতীয় দালাল হিসেবে এবং এ কারণে অনেক বছর কারাদন্ড ভোগ করেছিলেন।
এ কে ফজলুল হক,মওলানা ভাষাণী ও সোহরাওয়ার্দী এর গঠিত যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচন জেতে এবং পূর্ব পাকিস্তানে সরকার গঠন করে।যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করে।এই কারনে যুক্তফ্রন্ট সরকার নির্বিচারভাবে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা অপসারিত হয়।যখন ১৯৪৮ সালে বাঙালি ছাত্ররা দাবি করলো যে,বাংলা বাংলাদেশের ৫৬ শতাংশ জনগণের ভাষা,উর্দুর সাথে বাংলারও দেশের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত তখন জনাব জিন্নাহ তাদের চিহ্নিত করেন সাম্যবাদী,পঞ্চম বাহিনী,রাষ্ট্রের শত্রু এবং ঘোষনা করেন উর্দুই হবে রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।পাঞ্জাবী সেনা দ্বারা অনেক ছাত্রনেতা ও ভাষা আন্দোলন সমর্থকের হত্যার পর ১৯৫৬ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহন করা হয়।
- পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক ভেদাভেদঃ
পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে গড় আয়ের ব্যবধান বাড়ছিলো। ১৯৫৯-৬০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৩২ শতাংশ বেশি ছিল।পরের ১০ বছরে বার্ষিক আয় বৃদ্ধির হার পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৬.২ শতাংশ যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ৪.২ শতাংশ।এই কারণে ১৯৬৯-৭০ সাল নাগাদ পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৬১ শতাংশ বেশি হয়।এইভাবে দশ বছরে আয়ের ব্যবধান দ্বিগুন হয়ে যায়। সঠিক হিসাবে এটি আরো বেশি বৃদ্ধি পায়।এই ভেদাভেদের কারন হলঃ(i)পাকিস্তানের সম্পদ এবং বিদেশী সাহায্য,যা অন্যায়ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যবহার করা হয় যেখানে পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্নরূপে অবহেলা করা হয়।পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্যিক উপার্জন পশ্চিম পাকিস্তানমুখী হয় মূলধন যোগানো আমদানী হিসেবে।অর্থনৈতিক শাসন-প্রণালী পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের অনুকূলে ছিল।বিশেষভাবে শুল্ক,আমদানী নিয়ন্ত্রন এবং দ্রব্য বিক্রয়ের অনুমতি পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিশ্ব বাজার মূল্য থেকে অনেক বেশি দামে পণ্য ক্রয় করতে বাধ্য করে।
৫৬ শতাংশ জনগণ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মোট উন্নয়ন খরচ ১৯৫০/৫১-১৯৫৪/৫৫ সময়কাল পর্যন্ত সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত(শুধু কাগজে-কলমে) তৃতীয় পাঁচ বছর পরিকল্পনা ১৯৬৫/৬৬-১৯৬৯/৭০ সময়কাল পর্যন্ত।পুরো সময় ধরে সাধারণ বিনিয়োগে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ ছিল অত্যন্ত কম এবং সাম্প্রতিক বছরে পরিমাণ ছিল ২৫ শতাংশের একটু বেশি।
গত দুই দশক ধরে পূর্ব পাকিস্তানের মোট রপ্তানী উপার্জন ছিল প্রায় ৭০ শতাংশের মত এবং সাম্প্রতিক বছরে তা কমে ৫০-৫৫ শতাংশে চলে আসে, যেখানে এর আমদানী খরচ সাধারনত ৩০ শতাংশের আশেপাশে।বিদেশী বিনিময় হিসাবে উল্লেখযোগ্য উদ্বৃত্ত দেখানোর বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিদেশী বাণিজ্য শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতি দেখায়,যা সকল বিদেশী বিনিময় বস্তুত শোষণ করে, যা প্রাপ্ত হয় বিদেশী সাহায্যের মাধ্যমে।পশ্চিম পাকিস্তানের তাদের মালপত্র ও পণ্যের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে সংরক্ষিত বাজার ছিল।সাম্প্রতিক বছরে,পশ্চিম পাকিস্তানের রপ্তানির প্রায় ৫০ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করা হয়।
বিদেশী বাণিজ্যের একটি বিশ্লেষণ যুক্তিসংগত অনুমানের সাথে মিলিত হয় যে পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশী সাহায্যের নায্য অংশ হবে একটি অনুপাত,যা পাকিস্তানে এরজনসংখ্যার অনুপাতের সমান,নির্দেশ করে যে একটি বড় নিট সাহায্যের হস্তান্তর হয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে।সরকারী তথ্য ও প্রদত্ত ভাতার ওপর ভিত্তি করে
বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের হিসাবে ১৯৪৮/৪৮-১৯৬৯/৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচারকৃত মুদ্রার পরিমাণ ৩১ বিলিয়ন(৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নীতি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ক্ষতিকর ছিল । কেন্দ্রীয় সরকারের পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক শোষণ আরো প্রকট আকার ধারণ করছিল । ১৯৫৮ সাল থেকে পাকিস্তানে সামরিক শাসন চলে এসেছে এবং সীদ্ধান্ত গ্রহণের সকল বিষয় ছিল সুরক্ষিত বেসামরিক কর্মকর্তা ও তাদের সামরিক ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের উপর । প্রশাসনের বেশীরভাগ উর্ধতন কর্মকর্তায় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী ; এছাড়াও ১৯৬০ সালে কেন্দ্রীয় বেসামরিক প্রশাসনের শতকরা প্রায় ৮৭ ভাগ উর্ধতন কর্মকর্তায় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী এবং এই সংখ্যার খুব বেশী পরিবর্তন দেখা যায়নি । পরিকল্পনা বিভাগের ডেপুটি চেয়্যারম্যান , কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক মন্ত্রী ও সচিব , সম্পদ বণ্টনকারী রুই-কাতলা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ সবসময় পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই ছিলেন । পাকিস্তান থেকে দেশের বাইরে প্রায় ৫০ কূটনীতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় যার মাত্র ৫টি বাঙ্গালী নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় । কেন্দ্রীয় সরকারের উপবাসনও ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে । এসব কারণে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প প্রতিষ্ঠান আর উদ্যোক্তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছিল ।
কৃষি, শিল্প, যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুত সরবরাহ, শিক্ষাব্যবস্থা, চিকিৎসা, সামাজিক কল্যাণ ,চাকরি, প্রশিক্ষন, বীমা প্রতিক্ষেত্রেই দুই প্রদেশের ভিতর বৈষম্য জ্বাজল্যমান ছিল । পশ্চিম পাকিস্তানে বড় অঙ্কের প্রকল্পগুলোর পরিকল্পনা,অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন অতি দ্রুত করা হত । কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে অনেক ছোট অঙ্কের উন্নয়ন পরকল্পনাও অনুমোদিত হতে অনেক সময় লাগত আর তা বাস্তবায়িত হতে কয়েক বছর লেগে যেত । পূর্ব পাকিস্তানে প্রতি বছরই বন্যা, সাইক্লোন হত যা প্রচুর জীবননাশসহ ফসল ও সম্পদের ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করত । কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তখনো পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরকল্পনা হাতে নেয়নি । জাতীয় রাজস্বখাতের প্রায় ৬০% ই বরাদ্দ ছিল প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য যার প্রায় সিংহভাগই ব্যয় হত পশ্চিম পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য ।
V.পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের দাবীঃ
পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক অধীনতা ক্রমেই শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামিলীগের নেতৃত্বে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী আরো জোরদার করছিল । আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবী অনুযায়ী বৈদাশিক সাহায্য, অর্থ ও করারোপণের ক্ষমতা প্রতি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণে থাকবে যেন সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের অসামঞ্জস্যতায় কোনো প্রদেশ বঞ্চিত না হয় । আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবীগুলো ছিল নিম্নরুপঃ
(i) লাহোর চুক্তি অনুযায়ী ফেডারেশন সরকার গঠন যার সংসদ ও সরকারের কাঠামো গঠিত হবে আইনসভার অধীনে প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রার্থী নিয়ে।
(ii) ফেডারেশন সরকারের অধীনে শুধু প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক সম্পর্ক থাকবে এবং বাকী সকল সংশ্লিষ্ট বিষয় ফেডারেশন রাষ্ট্রের অধীনে থাকবে।
(iii) দুই প্রদেশের জন্য হয় দুইটি স্বাধীনভাবে বিনিমেয় মূদ্রাব্যবস্থা চালু থাকবে অথবা একটিমাত্র মূদ্রাব্যবস্থা চালু থাকবে যদি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধনের অবাধ গমন রোধে সংবিধানে কার্যকর নিয়ম থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংক এবং পৃথক রাজস্ব ও অর্থনৈতিক নিয়ম থাকতে হবে।
(৪)কেন্দ্রীয় সরকারকে কর দিতে অস্বীকার করা; প্রাদেশিক সরকারের হাতে কর আরোপের ক্ষমতা ন্যাস্ত করা এবং সেইখান থেকে একটা নির্দিষ্ট অংশ পাবে কেন্দ্রীয় সরকার।
(৫) বৈদেশিক বানিজ্যঃ পাঁচ ধাপ গ্রহণ করা হবে-
– বৈদেশিক মুদ্রার দুটি আলাদা হিসাব থাকবে দুই প্রদেশের জন্য।
-পূর্ব পাকিস্তানের উপার্জন পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে, আর পশ্চিম পাকিস্তানের উপার্জন পশ্চিম পাকিস্তানের।
-কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা হয় দুই প্রদেশ সমানভাবে পুরন করবে, অথবা একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ করে দিতে হবে।
-দুই প্রদেশের মধ্যে দেশীয় পণ্যের শুল্ক মুক্ত আদান প্রদান থাকবে।
-সংবিধান একক সরকারকে ব্যবসা ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন, ব্যাবসায়িক মিশন স্থাপন এবং বিদেশী রাষ্ট্রের সংগে চুক্তি স্থাপনের ক্ষমতা প্রদান করবে।
(৬)পূর্ব পাকিস্থানের দ্বারা একটি মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারি ফোরস গঠন করা।
ছয় দফায় পরিস্কার ভাবে এক প্রদেশের উপর অন্য প্রদেশের অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধের কথা বলা হয়েছিল এবং পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থ দ্বারা যেমন ইচ্ছা পূর্বক অপব্যাক্ষা প্রচারিত হয়েছে, এটা তেমন কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী পদক্ষেপ ছিল না। আওয়ামী লীগ কোনও বামপন্থী, ইসলাম বিরোধী বা প্রাদেশিক সংগঠন ছিল না। তারা চেয়েছিল সব প্রদেশে জনগনের শাসন ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে , কোরআন ও সুন্নাহ-র পরিপন্থী কোনও আইন প্রণয়ন করা হবে না। পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিল, বিশেষত সিন্ধু এবং বেলুচিস্তানে, যেখানে সাধারন মানুষ ছিল অর্থনৈতিক শোষণের স্বীকার ও মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। উল্লেখ্য যে, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক বামপন্থী দল।
ছয় দফা কর্মসূচী ঘোষণার মাত্র দুই মাস পরেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আনার জন্য অনেক সিভিল এবং মিলিটারি অফিসার ষড়যন্ত্র করছে দেখিয়ে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তীতে শেখ মুজিব, যিনি জেলেই ছিলেন তখন, তাকেও বিচারের আওতায় আনা হয়।
১৯৬৮ সালের শেষ দিকে আইয়ুব বিরোধী গণ আন্দোলন হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে এর নেতৃত্ব দিয়েছিল সকল ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বকারী ছাত্র মৈত্রী কমিটি। ছাত্রদের এগারো দফা দাবীর মধ্যে ছয় দফার লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য গুলিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন সরকারকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিতে বাধ্য করে এবং ১৯৬৯ সালের শুরুতেই মুজিব জেল থেকে ছাড়া পান।
অবশেষে তাঁকে রাওয়ালপিন্ডিতে যৌথ গোলটেবিল বৈঠকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্মেলনে মুজিব উল্লেখ করেছিলেন যে, জাতীয় প্রশ্নই হচ্ছে পাকিস্তানের মূল প্রশ্ন কিন্তু এটা নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই ক্ষমতায় যারা ছিল তাদের দ্বারা বাইপাস করার চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ভূগোল, অর্থনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির অপরিবর্তনীয় তথ্য দেওয়া একটি পৃথক সত্তা ছিল। এসব তথ্য থেকে রাষ্ট্র ও সরকার প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃত করা ছিল। তিনি ছয় দফা স্বীকৃতির জন্য চাপ দিয়েছিল।
আইয়ুব খানের সরকার কয়েকদিনের মধ্যেই ধসে পড়ে। এটি দ্বিতীয় সামরিক কর্তৃত্ব গ্রহণ ছিল।
আইয়ুব খান ২৫ মার্চ, ১৯৬৯ ইয়াহিয়া খান দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। নতুন শাসকদের লক্ষ্য অনুযায়ী ইয়াহিয়া খানের মাধ্যমে তিনটি ঘোষণা জারি করা হয় ১৯৬৯ এবং ১৯৭০ সালে যে টালিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক কতৃক অনুমোদন হয় মার্চ ৩০,১৯৭০ । ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের অঙ্গীকার প্রসঙ্গ সরাসরি এড়িয়ে যান। তিনি বলতেন তিনি প্রদেশে সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন, প্রসঙ্গত কেন্দ্রীয় সরকারের একটি দক্ষ পরিশ্রমী চাহিদা দান করতে চেয়েছিলেন।
V i. জনসাধারণের রায় এবং আওয়ামীলীগের অবস্থানঃ
লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার অনুযায়ী, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রথম সভার তারিখ থেকে 120 দিনের মধ্যে একটি সংবিধান পর্যন্ত প্রণয়ন করতে হবে। জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক আইনসভা নির্বাচন সামরিক শাসনের কঠোর তত্ত্বাবধানে ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামীলীগের শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৬৯ আসনের জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে এবং ৩১৩ আসনের মধ্যে একটি নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। প্রাদেশিক আইনসভা এছাড়া ও নির্বাচনে আওয়ামীলীগ অস্বাভাবিক রকম জয়লাভ করে।
জানুয়ারী ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খান ,মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামীলীগ নেতাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। তার সফর শেষে ১৪ জানুয়ারি, ইয়াহিয়া মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন যে , ক্ষমতা তাড়াতাড়ি তাঁকে হস্থান্তর করা হবে। কিন্তু তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন জন্য একটি তারিখ নির্ধারন প্রত্যাখ্যান করেন। ভেবে দেখার মত বিলম্বের পরে,জাতীয় পরিষদ ৩ ই মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় দেখা করার জন্য আহবান করেছিল। জুলফিকার আলী ভুট্টু, যার পিপলস পার্টি, জাতীয় পরিষদে ৮৩ টি আসন লাভ করেছিল সে অধিবেশন বয়কট করার হুমকি দেয় যদিনা আওয়ামীলীগ তাঁদের ছয় দফা কর্মসূচি পরিবর্তন করে । ভুট্টো বিশেষত করারোপণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষমতা দিয়ে একটি শক্তিশালী কেন্দ্র চেয়েছিলেন। মুজিব ঘোষণা করেন যে,” পূর্ব বাংলার জনগণ পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ভিত্তিক ছয় দফা কর্মসূচির পক্ষে একটি স্পষ্ট রায় দিয়েছিল এবং এই রায় সম্মান করতে হবে। দেশের সংবিধান ছয় দফা উপর ভিত্তি করে করতে হবে।“
পরিষদের অধিবেশনের জন্য ভুট্টোর হুমকি সত্ত্বেও , আওয়ামীলীগের সংবিধান কমিটির খসড়া সংবিধানের ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে দল দ্বারা প্রস্তুত পর্যালোচনা করতে বসল। ভুট্টো অধিবেশন স্থগিত করার জন্য ক্রমাগত চাপ দিয়ে গেল এবং হুমকি দেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র আন্দোলন হবে যদি অধিবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং পশ্চিম শাখার কোন সদস্য অধিবেশন যোগদান করলে তাঁকে গুরুতরভাবে মোকাবিলা করা হবে। হঠাৎ, ১ই মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিত করলেন । তিনি বলেন, দুইপক্ষের নেতাদের মনোভাব পরিতাপের বিষয় ছিল এবং সে জন্য পাকিস্তানকে মূল্য দিতে হবে।
রাষ্ট্রপতির মন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর গভর্নরদেরকে নিজ নিজ এলাকায় সামরিক শাসন পরিচালনার ভার দেয়া হল। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বদলে নতুন আরেকজন সামরিক শাসন পরিচালককে নিয়োগ দেয়া হল।
একটি সংবাদ সম্মেলনে মুজিব স্থগিতকরণের এই ষড়যন্ত্রের নিন্দা জানালেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সাথে কোনরকম পরামর্শের তোয়াক্কা না করেই রাষ্ট্রপতির অধিবেশন মূলতবি করা নিয়ে তিনি দুঃখপ্রকাশ করলেন। তিনি দেশ জুড়ে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করলেন। ঢাকায় স্বতঃস্ফুর্ত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হল। যেহেতু বিক্ষোভকারীরা প্রতিশোধ নেয়ার দাবি জানাচ্ছিল, মুজিব তাদেরকে ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দিয়ে বললেন, “আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সাংবিধানিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করব”। কিন্তু পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ করায় ঢাকায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ল। ঢাকা এবং অন্যানয় এলাকায় কার্ফিউ জারি করা হল এবং সামরিক আইন প্রশাসন পূর্ব পাকিস্তানে প্রেস সেন্সরশিপের আদেশ জারি করে। ৩ মার্চে মুজিব অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দেন, যা “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত” হবার আগ পর্যন্ত চলার কথা ছিল। একই দিনে, ইয়াহিয়া খান দু’টি অংশের নেতাদেরকে ১০ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে একটি সমাবেশে তাদের সংবিধান প্রণয়নে পার্থক্যসমূহ নিয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেনাবাহিনী কর্তৃক শত শত বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারী ও নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা ও আহত করার কারণে মুজিব সমাবেশে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, “আমরা কোন গণহত্যার মূল হোতাদের সাথে আলোচনায় বসব না”। তিনি সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত পাঠাবার অনুরোধ করেন। তার এই অনুরোধকে পাত্তা না দিয়ে বরং পরের কয়েকদিন আরও কিছু বিক্ষোভকারীদেরকে মেরে ফেলা হয়। সামরিক সরকার পূর্ব পাকিস্তানে প্লেন ও জাহাজে আরও বেশি সৈন্য ও সরঞ্জামাদি পাঠিয়ে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলার পর ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চে জাতীয় সমাবেশ অধিবেশনের ডাক দিলেন। তিনি অবশ্য সতর্ক করে দেন এই বলে যে, সশস্ত্র বাহিনীর হাতেই পাকিস্তানের অখণ্ডতার ‘পূর্ণ ও একমাত্র’ ক্ষমতা বজায় থাকবে।
শেখ মুজিব ঘোষণা দেন যে, তাঁর দল অধিবেশনে অংশগ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে যদি ইয়াহিয়া খান তাৎক্ষণিকভাবে ১) সামরিক আইন তুলে নেন, ২) সেনাবাহিনীকে ফিরিয়ে নেন, ৩) বেসামরিক শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন, এবং ৪) পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে জবাবদিহিতার আদেশ দেন। মুজিবের এই চার দফায় সকল পূর্ব পাকিস্তানিরাই জোরালো সমর্থন জানায়। এমনকি ভুট্টো এবং আব্দুল কাইয়ুম খান বাদে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারাও এই চারটি শর্তকে যুক্তিযুক্ত হিসেবে বিবেচনা করেন এবং রাষ্ট্রপতিকে তা গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। মুজিবের চার দফায় সমর্থনকারী পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন মুসলিম লীগের পরিষদ প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলতানা, জামিআতুল-উলেমায়-ইসলামের নেতা মাওলানা মুফতি মাহমুদ, জাতীয় আওয়ামি পার্টির প্রধান খান আব্দুল ওয়ালি খান, মুসলিম লীগ পরিষদের সর্দার শওকত হায়াত খান, জামিআতুল-উলেমা-ই-পাকিস্তানের মাওলানা শাহ আহমেদ নূরানী, জামাত-ই-ইসলামির প্রফেসর আব্দুর গফুর, মুসলিম লীগ সভার জনাব জামাল মোহাম্মদ কোরেজা, জাতীয় সমাবেশের স্বতন্ত্র সদস্য মাওলানা জাফর আহমেদ আনসারি, জাতীয় সমাবেশের স্বতন্ত্র সদস্য সর্দার মাওলা বখশ সুমরু, তেহরিক-ই-ইসতিকলালের প্রধান এয়ার মার্শাল (অবঃ) আসগর খান, বেলুচিস্তানের রাজনৈতিক নেতা নওয়াব আকবর খান বুগাতি, ভাওয়ালপুর যুক্তফ্রন্টের বেগম তাহিরা মাসুদ, রাওয়ালপিন্ডি মুসলিম লীগ পরিষদের সভাপতি জনাব মাহমুদ আহমেদ মিন্টু, জাতীয় আওয়ামি পার্টি (ওয়ালি গ্রুপ)- এর সাধারণ সম্পাদক জনাব হোক ওসমানি ও প্রমুখ। ভুট্টোর পিপল’স পার্টি এবং আব্দুল কাইয়ুম খানের সমগ্র পাকিস্তান মুসলিম লীগ বাদে পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত রাজনৈতিক দলই ভুট্টোকে এই রাজনৈতিক সংকট তৈরির জন্য দায়ী করে। উপরিউল্লেখিত পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ এবং করাচি বার অ্যাসোসিয়েশন ও করাচির অধিবাসীরা বিভিন্ন বিবৃতি এবং বৈঠকে ভুট্টোকে সতর্ক করে বলে যে, তার দেশভঙ্গ করা উচিত না এবং দেশ ও পরিস্থিতি রক্ষায় তাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল, অর্থাৎ শেখ মুজিবের আওয়ামি লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ জানায়।
সমগ্র পূর্ব বাংলা এক হয়ে শেখ মুজিব ওর তাঁর আওয়ামি লীগের পাশে এসে দাঁড়াল। অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহের বাঙালি নেতৃবৃন্দ যেমন পাকিস্তান গণতান্ত্রিক দলের প্রধান জনাব নূরুল আমিন, পূর্ব পাকিস্তান জামাত-ই-ইসলামি প্রধান প্রফেসর গোলাম আযম, ন্যাপ (ভাসানি গ্রুপ) এর প্রধান মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি, পাকিস্তা জাতীয় লীগ প্রধান জনাব আতাউর রহমান খান, কৃষক শ্রমিক দলের প্রধান জনাব এ এস এম সোলায়মান, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ পরিষদের সভাপতি জনাব শামসুল হুদা, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জনাব এ এন এম ইউসুফ ও প্রমুখের কাছ থেকেও স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল।
শেখ মুজিবের অসহযোগ ডাকে সাড়া দিয়েছিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান। এমনকি এই ডাকে প্রধান বিচারপতি ও ঢাকা হাইকোর্টের সকল বিচারপতিরাও সাড়া দিয়েছিল। ১৫ মার্চ প্রদেশের স্বচ্ছন্দ পরিচালনা ও নিখুঁত আইন-শৃংখলা রক্ষ্ণাবেক্ষণের জন্য শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানিদের কাছে ৩৫টি নির্দেশনার একটি সেট প্রেরণ করেন। এই ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ইয়াহিয়া খান ঢাকায় পৌঁছান এবং ১৬ মার্চে তাদের দু’জনের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। পরবর্তীতে ভুট্টো ও অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারাও আলোচনায় যোগ দেন।
৭. ক্ষমতাসীন শাসকদের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা
১০ দিন ধরে ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিব এবং অন্যান্য উপদেষ্টাদের মধ্যে আলোচনা চলে। কোন পর্যায়েই আলোচনা থামার কোন আভাস পাওয়া যায়নি। অপরদিকে, চার দফার উপর একটি চুক্তি হওয়ার আভাস পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলো ছিল: সেনাশাসন তুলে নেয়া এবং রাষ্ট্রীয় ঘোষণার মাধ্যমে একটি বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়া, প্রাদেশিক ক্ষমতা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর হাতে তুলে দেয়া; ইয়াহিয়া খানকে রাষ্ট্রপতি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় রাখা এবং সংবিধান চূড়ান্ত করার জন্য সংসদের প্রস্তুতিমূলক যৌথ সমাবেশ হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় সমাবেশের সদস্যদের পৃথক অধিবেশন করা। একবার এই চুক্তি মুজিব আর ইয়াহিয়ার মাঝে উত্থাপিত হলেই অন্তর্বর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তান ও কেন্দ্রীয় ক্ষমতার বিষয়ে প্রশ্ন উঠবে।
কিন্তু মার্চের ২৫ ও ২৬ তারিখ রাতের অন্ধকারে ইয়াহিয়া আচমকা ঢাকা ছেড়ে গেল। একই সময়ে পাকিস্তানি সেনারা পূর্বাংশে তাদের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে লেগে গেল। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামি লীগকে বয়কট ও মুজিবকে রাষ্ট্রদোহিতায় অভিযুক্ত করে ইয়াহিয়া খান একটি বার্তা প্রচার করল। এবং ২৬ মার্চ তারিখে, শেখ মুজিব সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। দু’দিন পর একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়া হল এবং ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হল।
সন্দেহাতীতভাবেই এতে প্রমাণিত হয় যে, ইয়াহিয়া ও তার দলের কোনকালেই শান্তিপূর্ণভাবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের ইচ্ছা ছিল না। তারা কেবল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সেনাবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধিতেই আগ্রহী ছিল। বেসামরিক অসহযোগ আন্দোলনের অভূতপূর্ব সাফল্যে পাকিস্তান সরকার নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, পূর্বাংশে তাদের ঔপনিবেশীক শোষণের দিন চিরদিনের মত শেষ হতে চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও ধনতান্ত্রিকগণ কেবল পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের প্রতিই আগ্রহী ছিল। সে কারণেই তারা শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দিকে নজর দেয়নি। বরঞ্চ তারা স্বায়ত্বশাসনের নিমিত্তে নিষ্ঠুরভাবে আন্দোলনের সাথে জড়িত প্রত্যেক বাঙালি – আওয়ামি লীগ নেতা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং সকল বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যার মাধ্যমে আন্দোলন ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পাঞ্জাবি সৈন্য অধ্যুষিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই বর্বরোচিত ও নির্বোধ কর্মকান্ডই পাকিস্তানের মৃত্যুধ্বনি হিসেবে কাজ করে এবং পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় ও আনুষ্ঠানিকভাবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে বাধ্য করে, যার নাম “বাংলাদেশ”।
৮. বাংলাদেশে গণহত্যা
সবচাইতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সমৃদ্ধ এবং বিমান ও নৌবাহিনী কর্তৃক সমর্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের সুপ্রশিক্ষিত পেশাদার সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে সারা বাংলাদেশের মানুষদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর এই কর্মকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ শহরে তা একযোগে শুরু হয়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতা কিংবা বুদ্ধিজীবীদেরকেই নয়, নারী ও শিশুসহ নিরাপরাধ নিরস্ত্র মানুষদেরকেও নির্মম ও ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। মৃত্যু ও ধ্বংসের সঠিক পরিসংখ্যান, যা এখনও চলছে, তা কোনদিনই জানা হবে না। গণযোগাযোগের উপর ইয়াহিয়া খানের সরকার পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং ২৬ মার্চ ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিককে ঢাকা থেকে অপসারণ করেছে। ইয়াহিয়া-টিক্কা খান সরকারের ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল বহির্বিশ্বকে পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটেছে তা জানতে না দিয়ে ৭২ ঘন্টার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু গণহত্যার মাধ্যমে বাঙালিকে বশে নিয়ে আসা।
বহির্বিশ্বের কাছে নিজেদের জঘন্য অপরাধ গোপণ করতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরিতে তারা খানিকটা সফল হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাশবিকতা ও নৃশংসতার কথা প্রত্যক্ষদর্শী বিদেশি সাংবাদিকদের মাধ্যমে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, মে মাসে সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ পরিচালিত একটি সফরে নির্বাসিত সাংবাদিকদেরকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর সময় তারা বিপুল ধংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ডের নমুনা দেখতে পায়। তাদের হিসেব অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা ৫ থেকে ১০ লক্ষের মত। তারা দেখে জনশূন্য ও অর্ধমৃত শহর, ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনৈতিক কার্যক্রম এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাঘাত। তারা স্তম্ভিত ও ভীত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ফাঁস হওয়া খবরে আভাস পাওয়া যায় যে, এই ত্রাস ও নিপীড়ন এখনও চলছে। চলছে নৈরাজ্য। যে কাউকে গুলি করার, তাদের সম্পত্তি লুট করার, যেকোন নারীকে ধর্ষণ করার এবং যেকোন বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার লাইসেন্স আছে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সমর্থক অবাঙালি জনগোষ্ঠীর। প্রায় ৬০ লাখ পূর্ব বাঙালির নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া এবং শরণার্থী হিসেবে এখনও প্রতিদিন প্রায় ৫০,০০০ থেকে ১ লাখ হারে মানুষের পালিয়ের যাবার বিষয়টি থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে কোন আইন নেই, নেই নিরাপত্তা, নেই কোন স্বাভাবিক অবস্থা এবং সেই বিধ্বস্ত এলাকায় রয়েছে খাদ্য, ওষুধপত্র আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ভয়ানক ঘাটতি।
৯. সেনা বর্বরতার প্রত্যক্ষদর্শী
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় অবস্থিত ৩৫ জন বিদেশি সাংবাদিক সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডের কিছুটা দেখতে পায়। তাদের মধ্যেই কেউ কেউ ঢাকা থেকে তাদেরকে অপসারণের পর সেনাবাহিনী কীভাবে ঘুমন্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাই নিয়ে রিপোর্ট করে। সেনাবাহিনী মানুষকে হত্যা করতে এবং তাদের ঘড়বাড়ি ও সম্পত্তি ধ্বংস করতে ট্যাংক, মর্টার, বাজুকা এবং অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে। কিছু কিছু বিদেসি সংবাদদাতা ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে নিজ চোখে সেনাবাহিনীর নির্মমতা এবিং পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে নিজেদের মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় সংকল্প প্রত্যক্ষ করেছিল। বিদেশি সংবাদদাতা, যাদের সাক্ষ্য বিভিন্ন পত্রিকা এবং সাময়িকীতে প্রকাশ পেয়েছিল, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আর্নলদ যেইলটিন (এপি), মিশেল লরেন্ট (এপি), ডেনিস নিল্ড (এপি), মরট রোজেনব্লাম (এপি), সিডনি শ্যামবার্গ (নিউ ইয়র্ক টাইমস), টি জে এস জর্জ (ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ), নয়ন চন্দ্র (ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ), ড্যান কগিংস (টাইম), টনি ক্লিফটন (নিউজউইক), লরেন জেনকিনস (নিউজউইক), মিলান জে কিউবিক (নিউজউইক), সাইমন ড্রিক (ডেইলি টেলিগ্রাফ)।
জন রোড, একজন মার্কিন সাহায্যকর্মী, যিনি নৈরাজ্যের সময় ঢাকায় ছিলেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম নিজ চোখে দেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ফরেইন রিলেশানস কমিটির প্রকাশিত এক চিঠিতে রোড বর্ণনা করেন কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোকে ট্যাংক দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় আর এর বাসিন্দাদেরকে জবাই করে ফেলা হয়। “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ অধ্যাপকসহ বুদ্ধিজীবী সমাজকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা” সম্পর্কে তিনি বলেন। তার মতে, “পূর্ব পাকিস্তানে নৈরাজ্য বিরাজ করছে, যেখানে নিরস্ত্র নাগরিকদের গণহত্যা, পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে সরিয়ে দেয়া”-র পায়তারা চলছিল। ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক, সায়মন ড্রিক ছিলেন ঢাকা হত্যাকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন যে, ২৬ মার্চ সকালে সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে প্রায় ১১ ঘন্টা ধরে সমগ্র পুরনো ঢাকাশহরকে ধ্বংস করে। মানুষকে নিজ গৃহে পুড়িয়ে দেয়া হয়। মানুষ শহর থেকে পালিয়ে যাবার সময় সেনারা তাদের ধাওয়া করে। কীভাবে বাজারে ঘুমন্ত মানুষদেরকে গুলি করে মারা হয় এবং সকালেও কীভাবে তারা বস্তা গায়ে জড়িয়ে তারা পড়েছিল, যেন তারা তখনও ঘুমিয়ে, সেকথা বর্ণনা করেন ড্রিক। “গণহত্যা শব্দটি যে এই পরিস্থিতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই”, বলেন ঢাকার একজন বিদেশি কুটনীতিক। আরেকজন পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, “এ যেন একেবারে রক্তগঙ্গা! সেনারা খুবই নির্দয় ছিল”। ঢাকা থেকে অপসারিত একজন ব্রিটিশ নারী ২ এপ্রিল সিঙ্গাপুরে বলেন, “আমার বাড়ি থেকে বিমান বন্দরের যাবার রাস্তাটা ছিল একটা গণকবর। রাস্তার ধারগুলো ভর্তি ছিল বেশিরভাগ নারী আর শিশুদের মরদেহ দিয়ে”। তিন লাখ লাশের খবর নিয়ে করা রিপোর্টগুলো অতিরঞ্জন ছিল না বলে তিনি দাবি করলেন। নিল ও’টুল, চট্টগ্রামে থাকা একজন মার্কিনী বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বন্দর নগরী যুদ্ধের কারণে পরিণত ভৌতিক এক নগরীতে। ৪ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামে থাকা এক ড্যানিস শিক্ষার্থী নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর সেনাবাহিনীর নৃশংসতা এবং তাদের বাজার, বাড়িঘর ও কারখানা ধ্বংস ও পুড়িয়ে ফেলার লোমহর্ষক গল্প শোনায়। চট্টগ্রামের এক জুট কারখানার ম্যানেজার জানান যে তার সব কর্মীদেরকেই হত্যা করা হয়েছে। পিটারবোরোর একজন ইঞ্জিনিয়ার, যিনি চট্টগ্রামে ছিলেন, তিনি জানান যে মানুষকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তাদেরকে গুলি করছিল সেনাসদস্যরা। অন্যান্য শহ৯র যেমন যশোর, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহতেও একইরকম ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছিল। বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং বুদ্ধিজীবীদেরকে জবাই, নিরস্ত্র নাগরিকদেরকে গুলি, নারীদেরকে ধর্ষণ, বাড়িঘর পোড়ানো, ব্যাংক লুট এবং কারখান ধ্বংস করেছিল।
দু’জন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য, জাতিসঙ্ঘের দু’জন প্রতিনিধি, একজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান এবং অন্যান্য স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকগণ পূর্ব বাংলার সীমান্ত এলাকাসমূহ ও শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত বর্বরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করেন। ভারতে বাঙালি শরণার্থী, যাদের সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে, তারা সেনাবাহিনীর বর্বরতার প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন। অনেক শরণার্থীর শরীরেই রয়ে গেছে গুলির দাগ।
১০. মানবাধিকার লঙ্ঘন
পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানের সরকার আন্তর্জাতিক আইনের সবচেয়ে মূল্যবান নীতিগুলোকে নির্লজ্জের মত লঙ্ঘন করেছে। তারা জাতিসংঘ সনদের প্রস্তাবনা ও ১, ৫৫ ও ৫৬ নিবন্ধ, মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার ১৯৫৬ এর আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারসমূহের আন্তর্জাতিক চুক্তি্, ১৯৬৬, হেগ আইন ১৯০৭ এর নিবন্ধ ২৩, জেনেভা চুক্তির নিবন্ধ ৩, ১৯৪৯, বিবদমান আক্রমণ ও গণহত্যা চুক্তি ১৯৪৮ থেকে বেসামরিকদের মুক্তির মতবাদ লঙ্ঘন করেছে।
১১. সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিশ্বজুড়ে নিন্দা
পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাশবিকতা ও নৃশংসতার বিশ্বজুড়ে নিন্দা হয়েছে। বিশ্ব সংবাদমাধ্যম জোরালোভাবে ইয়াহিয়া খান সরকারের কর্মকান্ডের সমালোচনা করেছে এবং অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও পাঞ্জাবি-পাঠান সৈন্যদের অপ্রত্যাশিত পাশবিকতার নির্ভরযোগ্য গল্প প্রকাশ করেছে। বেশিরভাগ দেশেরই বিশেষ করে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও সাময়িকীতে হত্যাকান্ড বন্ধ করার এবং শান্তিপূর্ণভাবে পূর্ব বাঙালিদের কাছে গ্রহণযোগ্য উপায়ে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। নানা দেশের রাজনৈতিক চিন্তাবিদ, আলেম, শিক্ষার্থী ও আলোকিত মানুষেরা বাঙালিদের দুর্দশায় সমবেদনা জানিয়ে সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডের নিন্দা জানিয়েছে এবং বহির্বিশ্ব ও বিশ্বশক্তিকে অনুরোধ জানিয়েছে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ তৈরি করে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর থেকে ক্ষমতা সরিয়ে নিয়ে এই রক্তের খেলা বন্ধ করতে। বিশ্বের সামাজিক ও দাতব্য সংস্থাগুলো তাদের সমবেদনা জানিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ পাঠানোর ইচ্ছা পোষণ করেছে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি নিকোলাই পোজোর্নি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানকে এক বার্তায় পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ এবং শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক আপোষে আসতে বলেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের এই বাছাইকৃত গণহত্যা ও বাঙালিদেরকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায় নিন্দা জানিয়েছেন এবং পূর্ব বাংলার নিপীরিত জনগণের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। তিনি বিশ্বশক্তিকে এযাবতকালের সবচাইতে বড় দুঃখজনক ঘটনাটিতে হস্তক্ষেপ এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান প্রদানের আহ্বানও জানান। জাতিসঙ্ঘের মহাব্যবস্থাপক উ থান্ট বলেন, মার্চের শেষের দিকে এবং এপ্রিলে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে, তা “মানব ইতিহাসে অত্যন্ত ভয়ংকর একটি ঘটনা”, যেখানে অনেক দেশই পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, সেখানে বেশিরভাগ সরকারই এই বিষয়ে উদাসীন আচরণ করছে ইয়াহিয়া সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের অজুহাতে। দুর্ভাগ্যবশত বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর প্রতি এই অবহেলা ও উদাসীনতা পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য আশ্চর্যের এবং তা সামরিক সরকারকে অত্যাচার ও নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়ার সাহস যুগিয়েছে। তা সত্ত্বেও, বেশিরভাগ সরকারই এই ভয়াবহ ঘটনার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল এবং সাহায্যকারী দেশগুলোর সরকারও ইয়াহিয়া খানের সরকারকে সমস্যার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান প্রণয়নে পরোক্ষভাবে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা স্থানীয় জনসাধারণের কাছ থেকে জোরপুর্বক সহায়তা আদায় করতে চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন মিথ্যা ও বিপরীতমুখী সংবাদ যা সামরিক কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করছে এটি প্রমাণ করার জন্য যে, পুর্ব পাকিস্তানে কোন আইন, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, শান্তি এবং স্বাভাবিক কোন অবস্থা বিরাজ করছে না। সামরিক নিয়ম জারির কয়েক দিনের মধ্যে সামরিক কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে, পুর্ব পাকিস্তানে সব কিছু স্বাভাবিক ছিল। এক দিকে তারা এখনও স্বাভাবিকতার দাবি করে, অন্যদিকে তারা ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা বৃহৎ মাত্রায় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা বলে। যখন বাইরের বিশ্ব এই নজিরবিহীন হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কথা জানতে পারল, তারা বাঙালিদের, অজ্ঞাত পরিচয় দুষ্কৃতিকারীদের এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের এই দুঃখজনক ঘটনার জন্য দোষারোপ করা শুরু করল। ইয়াহিয়া খান প্রথমে বললেন যে, ভারতে কোন বাঙালি শরনার্থী নেই, এখন তিনি শরনার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য অভ্যর্থনা কেন্দ্র খুলেছেন। ইয়াহিয়া খান শুরুতে পুর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রত্যাখান করেছিলেন, কিন্তু তিনি এখন জাতিসংঘের কাছ থেকে ব্যাপক মাত্রায় সাহায্য পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। তিনি যাই হোক জোর করেছেন যে, সকল সাহায্য তার সরকারের দ্বারা পরিচালনা করা উচিত। তার পরিকল্পনা হতে পারে সৈন্যদের জন্য সাহায্যকে সর্বোত্তম ভাবে কাজে লাগানো এবং বাঙালিদের অনাহারে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া।
রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের পরে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে শেখ মুজিবুর রহমান একজন মহান শ্রদ্ধেয় নেতা এবং দেশের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু ২৬ মার্চ তিনি তাকে দেশদ্রোহী উপাধি দিলেন এবং তাকে গ্রেপ্তার করলেন এবং তাকে পশ্চিম পাকিস্তানি কারাগারে প্রেরণ করলেন। ইয়াহিয়ার শাসনকাল কূটনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে এবং ইন্ডিয়ার সাথে সীমান্ত সমস্যা তৈরি করে । এই বিষয়কে অন্য গতিপথে নেয়ার চেষ্টা করছিল। পাকিস্তান ইন্ডিয়ার উপর সকল দোষারোপ করে। ইন্ডিয়ান বিমানের ছিনতাইকারীদের ভুট্টো, পশ্চিম পাকিস্তানী জনগন এবং সরকার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বাগত জানান। তারপর একটি প্রহসনের বিচার অনুষ্ঠিত হয় এবং এই ছিনতাইকে একটি ভারতীয় ষড়যন্ত্র হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়। সামরিক শাসন পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণদের পুর্ব পাকিস্তানের আসল অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞ রেখেছিল। তারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যে আরও চেষ্টা করছিল প্রাদেশিক বোধ ও ঘৃণা জাগিয়ে তোলার। তারা মিথ্যা প্রতিবেদন প্রচার করছিল যে, বেশ কিছু সংখ্যক অবাঙালি বাঙালি বিদ্রোহীদের দ্বারা নিহত হয়েছে। এই সরকারে কার্যকলাপ সভ্যতাবর্জিত এবং এর আচরন সহানুভুতিহীন।এই সরকার, যাই হোক, জনগণকে উপস্থাপন করে না। এই সরকার পুর্ব বাঙালিদের কাছে একটি বিদেশী, প্রতিপক্ষ সরকার। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানেও অসন্তোষ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। ভুট্টো এই অবস্থার প্রেক্ষিতে ক্ষমতা তার দলের কাছে বদলি করার জন্য অনুনয় করেছেন যে, আমলাতন্ত্র জাতীয় সমস্যা সমাধান করতে পারে না। সে এবং তার দল আপাতদৃষ্টিতে এই শাসন কালের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। কায়ুম খানের মুসলিম লীগ ব্যতীত অন্যান্য সকল পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক দল পুর্বে সমর্থঙ্করেছিল যে, ক্ষমতা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর করা উচিত। এটি প্রমাণ করে যে, সামরিক জান্তা জনসমর্থন বা আস্থার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটি কোন আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে, এমন একটি অভিজাত শাসনব্যবস্থা যেটি শুধুমাত্র অস্ত্রের সাহায্যে শাসন করে, তারা এমন বর্বর ও বেআইনি উপায়ে শাসন করবে। এই শাসনকাল শুধুমাত্র জনমতকেই নয়, বহির্বিশ্বকেউ উপেক্ষা করেছে।চিনের সাথে পাকিস্তানের বিশেষ সম্পর্ক এবং চিনের কাছ থেকে এটি যে বিশাল অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য পাচ্ছে, সেটি অন্যান্য ক্ষমতাশালী দেশকে উপেক্ষা করার জন্য উৎসাহিত করছে। চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সকল সুসম্পর্কের সুচনা দুই দেশের মধ্যে পরবর্তী সম্পর্ককে পোক্ত করেছে। চীন এখন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি তাদের স্বার্থ অর্পন করেছে এবং সকল পরিস্থিতে সামরিক শাসনকালকে সমর্থনের ওয়াদা করেছে।
১৫। দৃষ্টিভঙ্গি
রাজনৈতিক চিন্তাবিদ এবং নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকেরা বিশ্বাস করেন যে, পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে যাকে কখনো পুনর্জীবিত বা একত্রিত করা যাবে না। এই মুল বিষয়টি পাকিস্তানকে অটুট রাখার বিষয়ে নয় বরং এই মানব ইতিহাসের বিয়োগান্ত ঘটনার অবসান ঘটানো এবং পুর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তাদের মাতৃভুমিতে শান্তিতে ও নিরাপত্তায় বসবাসে সমর্থ করার জন্য এবং বর্বরতা এবং বাইরের সৈন্যবাহিনীর পাশবিকতার বিপদ থেকে মুক্ত রাখার জন্য। জাতিসংঘের অবিলম্বে চেষ্টা গ্রহণ করা উচিত, সকল ক্ষমতাধর দেশ এবং মুসলিম দেশগুলোকে ইয়াহিয়া খানের সরকারকে এই অত্যাচারের অবসান ঘটানো এবং পুর্ব পাকিস্তানের জনগনের কাছে গ্রহণযোগ্য শান্তিপুর্ন রাজনৈতিক সমাধানে আসার জন্য বাধ্য করা উচিত। এই চেষ্টাকে সফল করার জন্য, নিম্নোক্ত শর্তগুলোকে সামনে রাখা উচিতঃ
১। শেখ মুজিবুর রহমানকে অতিসত্বর কোন শর্ত ব্যতীত মুক্তি দিতে হবে।
২। পুর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার আওয়ামী লীগ দ্বারা গঠিত প্রাদেশিক সরকারে সাথে মধ্যস্থতা করতে হবে।
৩। সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং সকল সৈন্যদলকে পুর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেরণ করতে হবে।
৪। আওয়ামী লীগ সরকারকে পুর্ব পাকিস্তানের বিধিসম্মত ভাবে গঠিত সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে ।
৫। সকল শরনার্থীদের দেশে ফেরত আসার জন্য সমর্থ করতে সকল সুযোগ সরবরাহ করতে হবে। শরনার্থীরা পাকিস্তানী সরকারের মাধ্যমে তাদের যে সকল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তার জন্য পুর্ন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৬। যদি বাংলাদেশের প্রাদেশিক সরকার ছয়দফা দাবিতে সন্তুষ্ট না থাকে, তাদের শর্তানুযায়ী মধ্যস্থতা করতে হবে।
৭। যদি ইয়াহিয়া খানের সরকার এই শর্তগুলো না মেনে নয়, তবে এই সমস্যা নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে হবে। এর পুর্বে ত্রাণ সরবরাহকারী দেশগুলো এবং বন্ধু দেশগুলোকে সামরিক শাসনের উপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে যাতে ইয়াহিয়া খান অবিলম্বে বোঝাপড়ায় আসেন।