২৩। আর এক বধ্যভুমি চট্টগ্রামের দামপাড়া (৩৯৬)
সূত্র – দৈনিক বাংলা, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
আর এক বধ্যভুমি চট্টগ্রামের দামপাড়া
ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীরা এখানে কয়েক হাজার লোক হত্যা করেছে
নিজস্ব প্রতিনিধি
চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়াস্থ গরীবুল্লাশাহর মাজারের পাশে একটি লোমহর্ষক বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে। গত ৩০শে মার্চ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই বদ্ধভূমিতে বর্বর পাক বাহিনী প্রায় কয়েক হাজার লোককে হত্যা করেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। বধ্যভূমির স্থানটি আমাকে দেখিয়েছেন গরীবুল্লাশা মাজারের সংলগ্ন দোকানদার নাসির আহমেদ।
গত ২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত এই হত্যাযজ্ঞের ষোল আনাই তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি তার দোকানেই ছিলেন। নাসির আহমেদ আমাকে বলেছেন, গত ৩০শে মার্চ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অতিরিক্ত বৃষ্টির দিন ছাড়া প্রত্যহ সন্ধ্যায় কড়া মিলিটারি পাহারায় পাঁচ থেকে ছয় ট্রাক লোক নিয়ে আসা হত।
এই হতভাগ্যদের চোখে কাপড় বাঁধা থাকতো। তাদের বধ্যভূমিতে নামিয়ে দিয়ে ট্রাকগুলি চলে যেতো। এই হতভাগ্যদের বধ্যভূমিতে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলী করে হত্যা করা হত। তারপর অন্য একদল মিলিটারি ট্রাক নিয়ে বধ্যভূমিতে এসে লাশগুলি ট্রাক বোঝাই করে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেত। নাসির আহমেদ আমাকে আরও বলেছেন যে, নিয়মিত এই হত্যা যজ্ঞের শুরুতে লাশ পুঁতার জন্য বধ্যভূমির পাশে একটি গভীর গর্ত খনন করা হয়।
মাত্র কয়েক দিনে লাশে এই গভীর গর্ত ভর্তি হয়ে গেলে সদ্য মরা লাশগুলিকে ট্রাকে চড়িয়ে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। আমার অনুরোধে নাসির আহমেদ এই গর্তের মুখ থেকে সামান্য মাটি সরিয়ে পাঁচটি নরকঙ্কাল উঠান। তাঁর মতে সেই গর্তে কমপক্ষে পাঁচ হাজার নরকঙ্কাল রয়েছে। এই লোমহর্ষক বধ্যভূমি চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। বধ্যভূমির চারিদিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে হতভাগ্যদের জামা- কাপড় জুতা প্রভৃতি। মাটিতে রয়েছে চাপচাপ বিস্তর রক্তের দাগ যা প্রমাণ করেছে যে গত ডিসেম্বরের প্রথম দিকে এখানে কয়েক’শ লোককে হত্যা করা হয়েছে।
বদ্ধভূমির পাশে হাটার সময়ে মাটিতে আমি গোটা-দশ স্যুটও দেখতে পেয়েছি। এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে, রেলওয়ে পোর্ট ট্রাস্ট এবং অন্যান্য অফিসের যে সব হতভাগ্য অফিসার নিখোঁজ রয়েছেন, তাঁদের অনেককেই এই বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়েছে। নাসির আহমেদের মতে অত্যাচারের কালো দিনগুলোতে বর্বর পাক বাহিনী এই বদ্ধভুমিতে কয়েক হাজার লোককে হত্যা করেছে। তিনি বলেছেন যে, নিয়মিত এই হত্যাযজ্ঞের শুরুতে চোখ বাঁধা অবস্থায় বধ্যভূমিতে আনা একদল লোককে গুলী করে হত্যা করলে গুলির আওয়াজে হতভাগ্যদের লাইন করে দাঁড়ানো অন্যদল মৃত্যু ভয়ে চিৎকার করতো বলে পরে রাইফেলে সাইলেন্সর লাগিয়ে গুলি করে মারার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়।
নিয়মিত এই লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের আরও দুইজন সাক্ষী পাওয়া গেছে। এরা হচ্ছেন গরীবুল্লাহ শাহর মাজারের দারোয়ান আব্দুল, জব্বার।