৩৮। অরা ছবাইকে গুলি করে মেরেছে (৪২২-৪২৩)
সূত্র – দৈনিক বাংলা, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
অরা ছবাইকে গুলি করে মেরেছে
।। মোঃ কামরুজ্জামান প্রদত্ত ।।
ঢাকা ঘোড়দৌড় ময়দানের দক্ষিন প্রান্তে কালী বাড়ীর ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে সেদিন আমাকে শুনতে হয়েছিল তাদের কথা। লালমোহন মালী “হামি তখন পালাইয়া গেছি। অরা ছবাইকে গুলি করে মেরেছে। নন্দনের গায়ে পাঁচটি গুলি লেগেছে।“
রাম প্রসাদ- হামার পোলাভি মারা গেছে। এখন শুধু তিনটি মাইয়া আচে, সাদিবি হয়নি।
সোভা রানী মজুমদার- ছার- হামারভি ছেলে মারা গেছে।
লক্ষ্মী রাণী ঘোষ- আমার- স্বামী, আর দুটি মেয়ে মারা গেছে।
সোনিয়া- হামার ছামি, এক পোলা, দুই মাইয়া মারা গেছে। এক পোলা কোলে আছে।
পুরান দাস- হামার ছেলে মারা গেছে।
লিলিয়া হামার ছামিভি মারা গেছে দুইটা মাইয়াভি মারা গেছে।
বেচন- হামার ভগনা সুরুজ ভল্লি মারা গেছে। ও যেদিন মারা গেছে ছেদিন তার মাইয়া পার্বতীর জনম হইছে।
বৃদ্ধা- নন্দুর পোলা মারা গেছে।
সকলের কণ্ঠে- ছামীভি মারা গেছে ছাব।
আরো অনেক, অনেকের কণ্ঠে শুনছিলাম আমি সেদিন কালীবাড়ীর ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে লিলিয়া, সোনিয়া, লক্ষ্মী রাণী, পুরান দাস আর শোভা রাণীর মত আপন জনদের হারিয়ে যাওয়ার বেদনামিশ্রিত কথা।
কিন্তু আমি অপারগ। তাদের সকলের নাম আর কথা সেদিন লিখে রাখতে পারিনি। সবার তো একই কথা- কারো ছেলে, কারো স্বামী, কারো বা মেয়ে, আবার অনেকেই স্বামী, পুত্র, সবাইকে হারিয়েছে। তারা তাদের আপন জনকে হারিয়েছে নরপিশাচ পাক জল্লাদের হাতে। ২৪শে মার্চের কাল রাতে হানাদার বাহিনী ধ্বংস অভিযান ঢাকা শহরের সর্বত্র শুরু করে। তাদের তাণ্ডবলীলা থেকে প্রাচীন মন্দিরও রেহাই পায়নি। রমনায় কালীবাড়ীর মন্দিরটি হানাদাররা ২৭শে মার্চের রাতে ট্যাঙ্কের সাহায্যে ধ্বংস করে দেয়।
মন্দিরসহ পুরা কালীবাড়ী আজ রমনার মাঠ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এর সাথে কালীবাড়ীতে আশ্রিত মোট ৫০ জনের প্রাণনাশ করেছে জল্লাদ সেনারা। আমি সেদিন রমনার কোরবানির হাটে ছবি আনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু হাটের ছবি আর আনতে পারিনি, এনেছি তাদের ছবি যারা হারিয়েছে তাদের আপনজনকে। তারা আজ সবাই মুক্ত আকাশের নীচে আশ্রয় নিয়েছে- তাই সেদিন আমার সাতে তাদেরই একজন লালমোহন মালীকে কথা বলতে দেখে মনে করেছিলাম- আমি হয়তো রিফিল সম্পর্কে তাদের নাম ঠিকানা লিখছি। তাই অনেক নারী পুরুষ আমাকে ঘিরে বলেছিল সাব হামার নাম লিখেন হামার স্বামী, হামার ছেলে- ইত্যাদি ইত্যাদি। রমনা কালীবাড়ীতে মোট ৭০০ নারী পুরুষের বাসস্থান ছিল। তাদের মধ্যে স্বামীজি- প্রেমানন্দগিরিসহ মোট ৫০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। স্বামীজীর বয়স প্রায় ৭০ বছর হয়েছিল। তাকে রমনার মাঠে অন্যান্যদের সাথে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছে ২৮ শে মার্চে। তার স্ত্রী এবং তিন বছরের শিশু সন্তান ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।
পিতার মৃত্যুর দিন- পার্বতীর জন্মদিন। কালীবাড়িতে আশ্রিত ছিল সুরুজভল্লি। সুরুজভল্লি সেদিন ২৭শে মার্চের রাতে অনেকের সাথে সারিতে দাঁড়িয়েও মনে করেছিল তার স্ত্রীর প্রসব বেদনার কথা। নবজাত পার্বতীর পিতা আর নেই আছে রমনার কালীবাড়ীতে পিতার জমাট বাঁধা রক্ত।
-ঝরছে অশ্রু অবিরল-
কালীবাড়ীর এক বৃদ্ধা নাম প্রিয়বালা ঘোষ। বয়স ৬০ বছরের মত। দুই গণ্ড বেয়ে ঝরছিল শুধু অশ্রুর ফোঁটা। আমার কাছে আসতে পারেনি ভিড় ঠেলে। তাই অনেক পরে সবার শেষে আমি তার নিকট গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আপনি এমন করে কাঁদছেন কেন? উত্তরে হতবাক। কিছুই প্রথমে বলতে পারেনি।
তখন চোখের পানি যেন বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত বইছিল। বৃদ্ধার পাশেই দাঁড়িয়েছিল একটি ফুটফুটে রক্ত গোলাপের মত শিশুকে কোলে নিয়ে তার পুত্রবধু লক্ষ্মীরাণী ঘোষ।
কেউ কিছু বলছে না। আমার দ্বিতীয় প্রশ্নে ৫ বছরের শিশু মন্টুচন্দ্র ঘোষ আমাকে উত্তর দিল- আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে সে জন্য ঠাকুর মা কানছে। আঁচলে চোখ মুছে বৃদ্ধা প্রিয়বালা তখন ছেলে বৌ আর পাঁচটি শিশু সন্তানকে দেখিয়ে আমাকে বলল, সবাইকে ভাসিয়ে আমার মানিক (ছেলে সন্তোষ ঘোষ) গুলি খেয়ে মারা গেছে। দুটি নাতনী মঞ্জু, সঞ্জুও মারা গেছে। বৃদ্ধ এর বেশী আমাকে আর কিছুই বলতে পারেনি। শিশুর মত কেঁদে উঠছিল সেদিন রমনার মাঠে দাঁড়িয়ে। পুত্রহারা জননীর কান্নায় আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারিনি।