৪৭। নওগাঁয় পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের আরেকটি অধ্যায় (৪৪১-৪৪২)
সূত্র-পূর্বদেশ, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
কূপে পানি নেই, আছে শুধু গলিত লাশ
।। পুর্বদেশ প্রতিনিধি ।।
যে কেউ নওগাঁ শহরে ঢুকলেই দেখতে পাবেন শহরের মধ্যবর্তী যমুনা নদীর যমুনা ওপর নির্মিত পুরানো অথচ অতি সুন্দর সেতুটির পাশেই বিধস্ত তাজ সিনেমা হলটি। এর দক্ষিনে দেখা যাবে অসংখ্য বাঙ্গালী বিকৃত মৃতদেহ স্তপাকৃত অবস্থায় পড়ে আছে। এরই আর মাত্র সামান্য দূরে একটি পুরানো পাকা কূপ।
সুস্বাদু পানীয় জলের এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য কূপটি এলাকার মানুষের প্রভূত উপকারে আসতো। আর এক্ষণে এই কূপটির তিন হাত নীচে থেকে শেষ পর্যন্ত কেবল গলিত ও বিকৃত লাশ আর লাশই দেখা যাচ্ছে। একদা সুপেয় ছিল যার পানি সেখানে পানির চিহ্ন মাত্রও আর নেই। শবদেহ রক্তের ধারার সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
আর একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে দু’টি বড় ঢেউ টিনের ঘর। ঘরের ভেতর ঝুলে আছে বহু দড়ি। নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জুতো, জামা, প্যান্ট ও অন্যান্য পোশাকে পরিচ্ছদ। এক নজরেই মনে হবে, এগুলো এক বা একাধিক লোকের নয়, শত শত মানুষের ব্যবহৃত কাপড়। আর মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত এবং সে রক্তের বিস্তৃত কূপ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়।
কূপটির ভেতরে প্রথমেই যে মৃত দেহটি চোখে পড়ে তা কোন উচ্চপদস্থ লোকের বলেই মনে হয়। এরই চারপাশে দেখা যায় বহু নিহত ব্যক্তির মাথা মাত্র। শরীরগুলো নীচের বহু লাশের ভেতরে অন্তহিত বলেই মনে হয়। সনাক্ত করার কোনই উপায় নেই। এবার তাজ সিনেমার নিকটবর্তী পুরোনো পশু হাসপাতালটি অতিক্রম করে উত্তর দিকে কিছুদূর গেলেই দেখা যাবে বাঁয়ে ছোট্ট একটি মাসজিদ। তার পাশেই রয়েছে দালান বাড়িটি। বসবাস করত তথাকথিত কামিজ বিহারী ব্যবসায়ী। নাম ইদ্রিস। প্রতি বৎসর খাজা মঈনউদ্দিন চিশতীর মৃত্যু বার্ষিকী পালনের নাম করে তিনদিন ধরে ওরস হতো এই বিহারীর বাড়ীতে। কিন্তু তার বাসার ভেতরে যেতেই যে কেউ চমকে উঠবেন। দেখতে পাবেন দুই ঘরের ভেতরে নির্মম হত্যার প্রমাণ চিহ্ন। একটি ঘরে অনেক দড়ি ঝুলে আছে। আর অপরটিতে রয়েছে অসংখ্য বাঙ্গালীর রক্তের ছাপ।
নরপশুরা বাঙ্গালীর রক্তে
দরজায় আলপনা আঁকত
জানালা, দেওয়াল সর্বত্র রক্ত ছড়িয়ে আছে, সর্বত্র ঘরের দেয়ালে এবং চতুরপার্শ্বে। জানা গেছে, উক্ত বিহারী ব্যবসায়ী খানসেনাদের সহযোগিতায় যেসব বাঙ্গালীকে ধরে এনে জবাই করতো তাদের রক্তে তার অপবিত্র হস্ত রঞ্জিত করে তার ঘরের দরজা ও জানালা রাঙ্গিয়ে নিত। যেন আলতা দিয়ে সাজানো হয়েছে। এ নারকীয় দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
আর খান সেনারা তখন উল্লাসে মেতে উঠতো। শুধু কি তা-ই। ইদ্রিসের বাড়ীর ভেতর কাঁচা কূপটি মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। এখনও সে কুপের ভেতর দড়ি দেখা যায়। কূপটিতে বহু অচেনা বাঙ্গালীর লাশ চাপা রয়েছে। আর এর পাশেই দেখা যায় প্রচুর রক্তের দাগ। স্থানীয় বিহারীদের সহযোগিতায় পশু সেনারা কত বাঙ্গালীর জীবন প্রদীপ নির্মমভাবে নির্বাপিত করেছে, এই ক্ষুদ্র নওগাঁ শহরে তারই একটি ক্ষুদ্র প্রমাণ তুলে ধরা হলো।
গত ১৯ শে ডিসেম্বর এই পশুসেনারা এখানে আত্মসমর্পণ করে।