৫০। মরণপুরী ভোলা ওয়াপদা কলোনি (৪৪৫-৪৪৬)
সূত্র – হাবিবুর রহমান, দৈনিক বাংলা, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
মরণপুরী ভোলা ওয়াপদা কলোনি
।। হাবিবুর রহমান ।।
ভোলায় বর্বর হানাদার বাহিনী নৃশংসতার দ্বিতীয় পর্যায়ের হত্যাকাণ্ডের অধিনায়ক নরপশু ক্যাম্পেন মুনির হোসেন ও সুবেদার সিদ্দিক। এদের গণহত্যা ও জঘন্য পাশবিকতা যে বিভীষিকা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল তা অবর্ণনীয়। গত জুন মাসের প্রথম দিকে এই নরপশু আর তার দোসর সুবেদার ভোলাতে আসে। সে এখানে এসে প্রথম অতি স্বাভাবিকতা দেখাতে আরম্ভ করে।
মাইক্রোফোনে শান্তি কমিটির মাধমে কেবলই ঘোষণা করতো যে, আপনাদের কোন ভয় নেই। অকুতোভয়ে প্রত্যেকে কাজ কর্ম করে যান। আর হিন্দুদের উদ্দেশে বলা হতো আপনারা গ্রাম ও চরাঞ্চল হতে শহরে প্রত্যেকে নিজ বাড়ি ঘরে ফিরে আসুন প্রেসিডেন্ট আপনাদেরকেও সাধারণ ক্ষমা করেছেন। নির্দেশিত সময়ের মধ্যে ফিরে না এলে অতঃপর বিনা বিচারে গুলি করে হত্যা করা হবে।
এ আহবান আর জল্লাদ ইয়াহিয়ার সাধারণ ক্ষমার অন্তরালে ছিল নারী ধর্ষণ, অর্থ সংগ্রহ ও লুটতরাজ এবং নরহত্যার পরিকল্পনা। এ ফাঁদের মাধ্যমেই তাদের ঘৃণা কামনা, বাসনা ও উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেছিল। প্রথমতঃ যে পরিবারে সুন্দরী মেয়ে ছিল তার অভিভাবককে শান্তি কমিটির পাণ্ডা বা রাজাকার দিয়ে সামরিক বাহিনীর দফতর ওয়াপদা কলোনীতে ডাকা হতো। ডাকার পূর্বেই তার বাড়ি ঘরের চারদিকেই পলায়ন পথে রাজাকার আর দালালরা সাধারণ ভাবে ঘোরাফেরা করত যেনো কোথাও পালিয়ে যেতে না পারে।
অতঃপর উপায়ান্তর না দেখে দালালের সহায়তায় মরণপুরী ওয়াপদা কলোনিতে যেতে হতো। সেখানে নরপ্রকৃতি পশু মুনির আর সুবেদার বুকের কাছে বন্দুক আর বেয়োনেট ধরে জিজ্ঞেস করতো- “ভারত মে তোমহাত্যারা লাড়কা গিয়া, আওর মুক্তিবাহিনীকো হামারা খবর পৌছাতা”। এমনি করে দু’এক ঘণ্টা আটকিয়ে রেখে দালালদের মাধ্যমে প্রথমতঃ টাকা, তারপর মেয়ে দাবী করত। এদুটির একটিকে পূরণ করতেই হতো। তা না হলে রাতের অন্ধকারে নরপশুদের বেয়নেটের আঘাতে মরতে হতো। এ পরিকল্পনার শিকারে যে পড়তো কেবল সেই জানতো।
এ হত্যাকাণ্ড ও পাশবিকতার নীরব প্রত্যক্ষদর্শী ওয়াপদার এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ খালেদ, টেকনিক্যাল অফিসার জনাব সিরাজুল ইসলাম, সাবডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার জনাব আবু তাহের ও মনসুর আলী এবং সহকারী ইঞ্জিনিয়ার ওয়াহিদ উদ্দিন।
সাহেদ ও আব্দুর রব খাঁন। তাঁরা গত ৪ঠা মে হতে চার দেয়ালে ঘেরা ও ওয়াপদা কলোনীর একটি দালানে বলতে গেলে অন্তরীণ অবস্থায় ছিলেন। নিতান্ত প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে অনুমতি নিতো হতো এবং তাদের গতিবিধির প্রতি প্রখর দৃষ্টি রাখা হতো। এ কলোনিতে নরপিচাশ ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর আর পদলেহী দালালের পাশবিকতা ও নরহত্যার কাহিনী এমন কোন ভাষা নেই যে পুরোপুরি ভাবে রূপ দেয়া যেতে পারে। আমরা কলোনির বাইরে বাসা নিয়ে থাকবো এবং সেখানে হতে এসে অফিস করার অনুমতি চেয়েছিলাম। কিন্তু পিশাচরা এতে আমাদের উপর বিক্ষুব্ধ ভাব পোষণ করল। তারপর প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর দিন গুনছিলাম। এ ঘটনার কয়েকদিন পর আমাদের স্প্রিডবোট ড্রাইভার আতাহারকে ধরে নিয়ে অপর দিকের দালানে ৭দিন পর্যন্ত আটকিয়ে রাখে। আতাহারের নরকিয় মৃত্যু কাহিনী বলতে গিয়ে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার জনাব খালেদ আশ্রু সজল বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন- আমি ওকে বাঁচাতে পারলাম না। আমি জানতাম হয়তো আমরা কেউ বাঁচবো না। ভাবলাম অনুরোধ করলে হয়ত সাধারণ কর্মচারী হিসেবে ছেড়ে দিতে পারে।
এ বিশ্বাস নিয়ে মেজর জেহানজেব খান কে অনুরোধ করলে এ কলোনির গোপন তথ্য ফাঁস করেছে তাদের কেউ বাদ যাবে না বলে দৃঢ়কণ্ঠে জানায় এবং সে রাতেই ওকে মেরে ফেলে। তখন আমাদের নিশ্চিন্ত মৃত্যুই ভেবেছিলাম। এমন কোন রাত ছিল না যে নরপশুরা দশ- বারোজনকে হত্যা না করেছে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতো আর উল্লাসে ফেটে পড়তো।
কলোনির রেস্ট হাউস ছিলো পাশবিকতার কেন্দ্রস্থল। রাতের পর রাত দোসর সুবেদার কত মেয়ের যে সর্বনাশ করেছে, কত নারী যে নিধন করেছে, কো হতভাগিনীকে উন্মাদে পর্যবসিত করেছে তার সীমা নেই। মনির হোসেন লুণ্ঠন চালিয়েছে নির্বিচারে। নিজে গ্রহণ করেছে স্বর্ণ, নগদ টাকা প্রভৃতি মূল্যবান জিনিস, আর তার অনুচরদের দিয়েছে বাকী মালামাল।
এ ছাড়াও শান্তি কমিটির যোগসাজশে যাকে তাকে ধরে আটক করে, শান্তি কমিটির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের নগদ অর্থের বিনিময়ে দু’একজনকে ছেড়ে দিয়েছে। অনেক টাকা গ্রহণ করেও তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। দুলারহাটের মোহাম্মদ উল্লাহ কন্ট্রাক্টর তাদের একজন। চরফেশনের শান্তি কমিটির পাণ্ডা রাজাকার ও পুলিশ দিয়ে ওকে ধরিয়ে দেয়। এমনি করে সমগ্র মহকুমায় হিংস্র নখর বিস্তার করে পাশবিকতা আর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।