৫৩। অগ্নিদগ্ধ, লুণ্ঠিত, ধর্ষিত কাশিয়াবাড়ী (৪৪৯-৪৫০)
সূত্র – দৈনিক পূর্বদেশ। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২।
অগ্নিদগ্ধ, লুণ্ঠিত, ধর্ষিত কাশিয়াবাড়ি
।। গবিন্দলাল দাস ।।
অজপাড়া গাঁ হলেও কাশিয়াবাড়ি একেবারে ছোট্ট গাঁ নয়। গাইবান্ধা মহকুমার পলাশবাড়ী থানার এই গাঁ-টাতে ছিলো ৭০০ গৃহস্থবাড়ী। হিন্দু মুসলমানের বাসস্থান। মিলেমিশে ছিলো তারা এই গাঁয়ের মাটিতে। এক সম্প্রদায়ের সাথে ছিলো আরেক সম্প্রদায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। পার্শ্ববর্তী গাঁয়ের আবাঙ্গালিরা কত সময় কতবার চেষ্টা করেছে এখানে দাঙ্গা বাঁধাবার কিন্তু কোনবারই তাদের সে চেষ্টা সফল হতে পারেনি। এ গাঁয়ের সাতশো হিন্দু মুসলিম গৃহস্থ এক পরিবারের ছেলে মেয়ে মা, বাবা।
স্বাধীনতা আন্দোলনের এক পর্যায়ে বর্বর পাকবাহিনী অত্যাচার তাণ্ডব লীলা চালিয়ে পার্শ্ববর্তী থানা ঘোড়াঘাটে এসে আস্তানা গেড়ে বসে। এখান থেকে মাইল চারেকের পথ ঘোড়াঘাট। একদিন এ গাঁয়ের লোক জানতে পারলো শীঘ্রই ওই পশুগুলো আশ- পাশের গাঁগুলোতে অত্যাচার বিভীষিকার রাজত্ব সৃষ্টি করবে। কথাটা ঠিকই ফললো। ক’দিনের মধ্যেই ঘোড়াঘাট সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে অত্যাচারের তাণ্ডবলীলা শুরু হলো।
ঘর বাড়ী পুড়িয়ে ছাই করতে লাগলো। মা, বোনদের ইজ্জত নষ্ট করতে লাগলো। মানুষ ধরে ধরে গুলি করে পাখি শিকারের মতো মারতে লাগলো। ঘরের জিনিসপত্র লুটতরাজ করে নিয়ে যেতে লাগলো। লোকগুলো দিশেহারা হয়ে পড়লো। অত্যাচারের বীভৎস হাওয়া কাশিয়াবাড়ীতেও একদিন এসে ধাক্কা দিলো । ঘোড়াঘাটে ছিলো আবাঙ্গালির এক কলোনী। ওই আবাঙ্গালি কলোনির দুষ্কৃতকারী পাক বাহিনীর সাহায্য সমর্থন পেয়ে রাইফেল এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হানা দিতে লাগলো কাশিয়াবাড়ীর শ্যামল মাটির বুকে।
কিন্তু হারেস মিয়া বাড়ী থেকে পালায়নি। তাঁর বিশ্বাস ছিলো পাক বাহিনী কাউকে মারবে না শান্তি কমিটির সেদিনের সভাতে সে আশ্বাসই তো বক্তারা দিয়েছিলো। কিন্তু হারেস মিয়া জানতো না ওদের কথার উপর বিশ্বাস করে বাঁচাবার কারো উপায় নেই। তাই হারেস মিয়া বাঁচেনি। কাশিয়াবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সেক্রেটারি হারেস মিয়াকে ছোরা দিয়ে জবেহ করেছে।
জবেহ করেছে স্কুলের শিক্ষক গোলজার মিয়াকে এবং আরো অনেককে। ধর্ষণ করেছে ফুলবানু গিরিবালাকে। সাত মাসের গর্ভবতী ফুলবানুর উপর এক এক করে ওই পশুগুলো ধর্ষণ চালালে ফুলবানু অতিরিক্ত স্রাবে সেদিন মারা যায়। পেট থেকে গড়িয়ে পড়ে একটি ছোট মৃত শিশু। আর গিরিবালাকে ধর্ষণ করার পর হাত উঁচু করে খুঁটির সাথে বেঁধে বেয়োনেট দিয়ে বুক চিরে মেরে ফেলে। গ্রামটা আগুন লাগিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে নরপুশুরা।
তখনো যারা পালাতে পারেনি তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরে ফেলে। প্রায় ৭শত লোককে স্কুলের মাঠে নিয়ে এসে বেদম প্রহর শুরু করে।
পাকিরা বলে, তোমহারা গাঁওমে মুক্তি ফৌজ হ্যাঁয়।
-নেই স্যার।
ঝুট বোলতো। তোমহারে গাঁওছে গোলিকা আওয়াজ শোনাথা। আওর হামারা পাছ ইনফরমেশন হ্যাঁয়।
এর কদিন বাদেই এ গাঁয়ে তথাকথিত শান্তি কমিটির তরফ থেকে মিটিং করতে এলো জামাতে ইসলাম আর মুসলিম লীগের লোকেরা। তারা আশ্বাস দিয়ে গেলো এ গাঁয়ের লোকদের। আপনারা পালাবেন না, কোথাও। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আপনাদের ধ্বংস করতে আসেনি। আপনাদের খুশি করাই তাদের কাম্য। গাঁয়ের সরল নিরীহ লোকগুলো ভাবলো কথাটা হয়তো ঠিকই বলেছে।
এবার থেকে হয়তো অত্যাচারের পালা শেষ হবে। দেশে শান্তি আসবে। কিন্তু কি যে শান্তির দিন তাদের সামনে অপেক্ষা করছিল- একদিন আগেও তারা তা বুঝতে পারেনি। কিন্তু যেদিন তারা বুঝলো সেদিন আর আত্মরক্ষা কোন পথই তাদের সামনে থাকলো না। ১১ই জুন ক্যাশিয়াবাড়ীর সরল লোকগুলো দেখলো পিল পিল করে পায়ে হেঁটে কয়েকশ পাক সৈন্য দ্রুত তাদের গাঁয়ের দিকে ছুটে আসছে।
পালাও পালাও, যে যেখানে পারো পালাও। ওই যে দূরে দস্যু পাক বাহিনী ছুটে আসছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামটায়। মেয়ে পুরুষ বুড়ো জোয়ান যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। তাড়া খাওয়া হরিণের মতো, অন্য কোন দিকে না তাকিয়ে সবাই গাঁয়ের পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র নদীর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতারে ওপারে পালাতে থাকে। আবার অনেকে ধান আর পাটের ক্ষেতে শুয়ে লুকিয়ে পড়ে। শিশুরা কান্না থামাতে মাকে পাগল হতে হয়। সবাই আত্মগোপনে ব্যস্ত।
বাড়ী বাড়ী ঢুকে গরু ছাগল চাল ডাল থেকে শুরু করে সামনে যা পেত তাই ছিনিয়ে নিয়ে চলে যেতো। প্রতিরোধের সর্বপ্রকার উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও এই হিংস্র পশুগুলোকে কোন বাধা দেয়ার সাহস পায়নি কাশিয়াবাড়ীর অসহায় লোকগুলো। আবাঙ্গালিদের এই ধরণের অত্যাচারে ভীত হয়ে পড়লো গাঁয়ের হিন্দুরা। তারা গাঁ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পরিকল্পনা করতে লাগলো। কারন তাদের উপরেই ওই দস্যুদের অত্যাচারের মাত্রাটা ছিলো বেশী। ঠিক এমনি সময় সামনে এসে দাঁড়ালেন দারাজ কবিরাজ এবং গাঁয়ের অন্যান্য মাতবর। তোমরা যাবে না এখান থেকে। আমাদের ত্যাগ করে চলে যেয়ো না তোমরা। আমাদের জান দিয়ে হলেও তোমাদের আমরা রক্ষা করবো।
থমকে দাঁড়িয়েছিল হিন্দুরা। তাই তো, এদের ছেড়ে আমরা কেমনে করে যাই। এরা কোন দিন তো তাদের ত্যাগ করেনি। কোন দিন তো বেঈমানি করেনি। তবে কেনো এই দুর্দিনে তাদের ছেড়ে তারা পালাবে। যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো হিন্দুরা। গাঁয়ের মাতব্বরদের সিদ্ধান্ত মতে হিন্দুদের মূল্যবান জিনিসপত্র মুসলমানদের ঘরে ঘরে এনে জমা রাখা হলো যাতে আবাঙ্গালিদের কোপদৃষ্টি থেকে জিনিস পত্রগুলোকে বাঁচানো যায়। সবাই মিলে আবাঙ্গালি কলোনির সেই দুষ্কৃতকারীদের হামলাকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুললো।
অতঃপর আরেকদিন সেই দুষ্কৃতকারীর এ-গাঁয়ে হামলা চালাতে আসতেই চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেললো গাঁয়ের লোকরা। তোমরা আর এভাবে আমাদের জান-মাল লুটতরাজ করতে পারবে না। আমরা তোমাদের ক্ষতি করিনি। আমাদের তোমরা বাঁচতে দাও। ফুঁসে উঠেছিলো সেই আবাঙ্গালি দুষ্কৃতকারীরা। কিন্তু সেদিন কিছু একটা করবার সাহস তারা পায়নি। কারন সেদিন যার যা ছিলো তা-ই নিয়েই তৈরি হয়েছিলো গাঁয়ের লোকগুলো। কিন্তু সেদিন এ-গাঁয়ের লোকরা ভাবতেও পারেনি যে, ওই দুষ্কৃতকারীরা তাদের জীবনের সর্বনাশ ঘটবার জন্য কি জঘন্য ষড়যন্ত্র করে বসেছে…(অসমাপ্ত)