৮৪। বেগম মুজিব কিভাবে কাটিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো (৫১৩-৫১৬)
বেগম মুজিব কিভাবে কাটিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো
বেগম মুজিবের বিষাদঘন দিনগুলোর কয়েকটি কথা
সুত্র – দৈনিক বাংলা, ৪ জানুয়ারী, ১৯৭২
নববর্ষের দিন সূর্যের আলোয় পথ চিনে এগিয়ে গেলাম, আঠার নং রোডের দুর্গসদৃশ সেই বাড়ীটার দিকে। বাইরের ঘরেই বসেছিলেন বেগম মুজিব। হাসিমুখেই আহবান জানালেন আমাকে। বাড়ীটার উল্লেখ করতেই হেসে বললেন- এটাতো তবুও একটা মাথা গুজবার ঠাঁই, কিন্তু ২৫ শে মার্চের পর পুরো দেড় মাস তো কোথাও পাইনি। আজ এখানে কাল সেখানে, এমনি করে সেই মাসে কম করে হলেও চৌদ্দ পনেরটা বাসা বদল করেছি।
হাসছিলেন বেগম মুজিব, কিন্তু দেখলাম হাসি মাজে কেমন জানি অস্পষ্ট এক বিষণ্নতার ছোঁয়ায় করুণ হয়ে উঠেছে তাঁর চোখের দৃষ্টি।
২৫ শে মার্চের সেই ভয়াবহ রাত। অন্ধকার শোবার ঘরটাতে শুয়ে শেখ সাহেব শুনছিলেন বাইরে বোমায় বিধ্বস্ত ঢাকার আর্তনাদ। এক এক সময় উঠে বসছিলেন তিনি।
ঠিক এমনি এক মুহূর্তে গুলির একটি টুকরো জানালা ভেদ করে ছোট ছেলে রাসেলের পায়ে আস্তে করে লাগে। অন্ধকারে হাতড়ে গুলিটা কুড়িয়ে নিয়েছিলেন শেখ সাহেব। আর সেই দুঃসহ রাতেই নরপিশাচরা তাকে বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিল। বাড়ীতে তখন ছিলেন বেগম মুজিব, আর তার দু’ছেলে।
২৬ শে মার্চ-সমস্ত দিন ছিল কারফিউ। গোলাগুলির শব্দ তখনও থামেনি। নিস্তব্ধ বাড়ীটা জুড়ে যেনো এক ভৌতিক বিভীষিকা মাথা খাড়া করে উঠেছে। সামনে ধানমন্ডি বালিকা বিদ্যালয়ে তাক করে রাখা বড় বড় কামানের মুখগুলো আমার বাসার দিকে। ভয়ে জানালাগুলো পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে পারিনি। দুপুরে কারফিউর মধ্যেই এ বাসা ও বাসা করে বড় ছেলে কামাল এসে পৌঁছালো।
রাত এলো। সেই আধাঁর কাল রাত। ইয়াহিয়া খানের হিংস্রভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে বলা বিবৃতি শুনেই নিজেদের অবস্থা বুঝতে পারলেন বেগম মুজিব। তাই কালবিলম্ব না করে ছোট ছেলে আর মেঝ ছেলেকে নিয়ে পাঁচিল টপকে প্রতিবেশী ডাক্তার সাহেবের বাড়ীতে আশ্রয় নিলেন। অন্যদিকে বড় ছেলে কামাল এবং মহিউদ্দীন সাহেব পালালেন অন্যদিকের পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে। রাত ১১টা থেকেই তোপদাগার শব্দে কানে তালা লাগার জোগার। কতকটা চেতন কতকটা অচেতন অবস্থায় বেগম মুজিব ২৬শে মার্চের সেই ভয়াবহ রাতে শুনলেন তাঁর আদরের বাড়ীতে গোলাগুলির শব্দ। রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত। সে রাতে এভাবে না পালালে তাঁর এবং তাঁর সন্তানদের ভাগ্যে কি যে ঘটতো আজো তিনি তা ভাবতে পারেন না।
২৭শে তারিখ সকালে বাচ্চা দু’টো সাথে নিয়ে তিনি আবার পালালেন। পুরো দেড় মাস এ বাসা ও বাসা করেন। শেষে মগবাজারের এক বাসা থেকে পাক বাহিনী তাঁকে আঠারো নং রোডের এই বাসায় নিয়ে আসে।
১৮নং রোডে আসবার পূর্বকার মুহূর্তটি স্মরণ করে গম্ভীর হয়ে গেলেন বেগম মুজিব। বললেন- ‘আমি তখন মগবাজারে একটা বাসায় থাকি। আমার বড় মেয়ে হাসিনা তখন অন্তঃসত্ত্বা। সে, জামাই, আমার দেওর, জা, মেয়ে রেহানা, পুত্র রাসেলসহ বেশ কয়েকজন একসাথে ছিলাম মগবাজারের বাসাটাতে। হঠাৎ একদিন পাকবাহিনী ঘেরাও করে ফেললো বাসাটা। একজন অফিসার আমাকে জানালো যে আমাকে তাদের তত্ত্বাবধানে অন্যত্র যেতে হবে। জানি না কি হবে। ঠিক সেই মুহূর্তটাতে ভীষণ সাহসী হয়েছিলাম আমি। কড়াভাবেই সেই অফিসারকে বললাম, লিখিত কোন আদেশপত্র না দেখালে আমি এক পা-ও বাড়াব না। উত্তরে সে উদ্ধতভাবে জানালো যে ভালোভাবে তাদের সাথে না গেলে তারা অন্য পন্থা গ্রহণ করবে। তখন বাধ্য হয়ে আমি বললাম যে, আমার মগবাজার বাসায় যারা আছেন তাদের প্রত্যককে আমার সাথে থাকতে দিতে হবে। আমার কথায় তারা নিজেরা কি যেনো আলোচনা করলো, পরে তারা রাজী হয়ে নিয়ে এলো আমাদেরকে ১৮ নং রোডের এই বাসাটাতে।
১৮ নং রোডে আসার প্রথম দিনের কথা বলতে গিয়ে আবার হেসে ফেললেন বেগম মুজিব। ময়লা আর্বজনা পূর্ণ এই বাড়ীটাতে তখন বসবার মতো কোন আসবাবপত্র দূরে থাক, একটা মাদুর পর্যন্ত ছিল না। জানালার পাশ ঘেষা ৩/৪ ইঞ্চি প্রশস্ত একফালি জায়গায় ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিলেন তিনি এবং পরিবারের সমস্ত সদস্যরা।
অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে এইভাবে কষ্ট করে বসে থাকতে দেখে সেদিন বুক ফেটে যাচ্ছিল তাঁর। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেননি, শুধু অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলেন চারিদিক। হয়ত অসহায়ের করুণ ডাক আল্লাহতায়ালা সেদিন শুনেছিলেন। প্রহরী পাক-বাহিনীর এক পাঠান অফিসার অনুভব করেছিল তাঁর অসহায় অবস্থাকে। সেই অফিসার একজন ঝাড়ুদার সংগ্রহ করে পরিষ্কার করে দেয় ঘর দয়ার-সংগ্রহ করে দিয়েছিল কয়েকটি চেয়ার এবং একটি কম্বল।
বন্দী জীবনের নৃশংস পাক-পাহারাদার বাহিনীর মধ্যে এই অফিসারটিই ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম।
ধানমন্ডির এই বাড়ীটার মাঝে অনেক দুঃখ দৈন্যের স্মৃতি চিরদিনের মতো বেগম মুজিবের বুকে আঁকা হয়ে গেছে তবুও এই বাসাতেই তিনি তার প্রথম আদরের নাতীকে বুকে নিতে পেরছিলেন-এ স্মৃতি তাঁর কাছে কম উজ্জল নয়।
বেগম মুজিবের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাতকার
ডিসেম্বরের দুপুর। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং রোডের বাড়ীর ভিতরের বসবার ঘরে বসে কথা বলছিলান বেগম মুজিবের সাথে। গত বছরের বন্দী জীবনে দুর্বিষহ ও ভয়ঙ্কর মুহূর্তগুলোর কথা। বর্ণনা করছিলেন তিনি…
“২৬শে মার্চের পরপরই বড় ছেলে কামাল চলে গেছে ওপারে। হাসিনার শরীর খারাপ। তবুও অসুস্থ শরীরে সেই ছিল আমার সবচেয়ে ভরসা।
মে মাসের ১২ তারিখ। ১৮ নং রোডের সেই একতলা করা গৃহে আমাদের নেয়া হয়। হানাদারদের পাহারাতে জীবন কাটাচ্ছিলাম আমি। বাসার যে সব প্রহরী ছিল, তাদের মধ্যে দু’জন সাদা পোষাকধারী সিভিল আর্মড ফোর্সের লোকও ছিল। এরা কার্যত আর্মির প্রহরীদের ঠিক রাখতো।
একদিনের ঘটনা। আমার শোবার ঘরে জামাল আর রেহানা ঝগড়া করছিল। বন্দী জীবন জামালের মত ছেলে সহ্য করতে পারছিল না। কেমন যেন ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
সেদিন তাই ওদের দু’ভাই বোনের ঝগড়াটা একটু বেশী রকমে শুরু হয়েছিল। ওদের ঝগড়ার মাঝেই হুট করে ঘরের মধ্যে সিভিল আর্মড ফোর্সের একজন অফিসার ঢুকলো। চোখ লাল করে হিংস্রভাবে সে জামালকে বললো, তুমি আজকাল বেশী বাড়াবাড়ী করছ। এভাবে গোলমাল করলে আমরা তোমাকে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাব। পা দু’টো উল্টো করে বেঁধে তোমাকে চাবুক মারা হবে। জীবনে আর যাতে কারো মুখ দেখতে না পাও সে ব্যবস্থাও করা হবে। বেশ চিৎকার করেই অফিসারটি কথাগুলি বলেছিল। আমি প্রথমে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে বললাম ঘর থেকে। একটা হিংস্র দৃষ্টি সে আমাদের ওপর নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
অফিসারটি চলে যাবার পর বেগম মুজিব তার ভবিষ্যত কর্মপন্থা স্থির করে নিলেন। সে দিনই তিনি অফিসারটির জঘন্য আচরণের সমস্ত ঘটনা প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সমস্ত উপর মহলেই লিখে জানালেন।
কিন্তু এ ঘটনার পর থেকেই জামাল যেনো আরও অশান্ত হয়ে উঠলো। পালাবার জন্য সমস্ত সময় সে সুযোগ খুঁজতো। ২৭শে জুলাই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হাসিনার সন্তান হলো। আমাদের জীবনে এলো প্রথম নাতী। অথচ তাঁকে দেখবার জন্য আমাদের কাউকেই অনুমতি দেওয়া হল না। ঘরের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলাম সেদিন। কেঁদেছিলাম পাক করুনাময় আল্লাহতায়ালার দরগায়।
৫ই আগষ্ট জামাল পালিয়ে গেল বাসা থেকে। কয়েকদিন আগে থেকেই পালিয়ে যাবার জন্য সে চেষ্টা চালাচ্ছিল। আমাকে বলছিল আমি যদি পালাতে পারি তাহলে ৩/৪ ঘন্টা ওদেরকে কোন খবর দিও না। জামাল পালাবার পর বুঝতে পারলাম যে ও পালিয়েছে। মন আবার অশান্ত হলো। যদি ধরা পড়ে শেষ হয়ে যায়, আবার সান্ত্বনা পেলাম বাঁচলে এবার ও বাঁচার মতো বাঁচবে। বেলা দু’টায় খাবারের সময় ওর খোঁজ পড়লো। খোঁজ খোঁজ, চারদিক খোঁজ। কিন্তু জামাল কোথায়? সন্তানের খোঁজে আমি তখন দিশেহারা হবার ভান করলাম।
সরাসরি চিঠি পাঠালাম উপর মহলে। আমার ছোলেকে তোমরা ধরেছ। এবার ফিরিয়ে দাও। হানাদারদের তরফ থেকে কিছুই বলার ছিল না। কেননা আগেই আমি এ সম্পর্কে সজাগ হবার জন্য চিঠি লিখেছিলাম সর্বত্র। তদন্তের জন্য যে কর্নেলকে পাঠানো হয় সে মনে মনে শংকিত হলো। হয়তো সত্যিই ওদের বাহিনীর কেউ জামালকে গুম করেছে। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে কর্নেল ফিরে গেলেন। কিন্তু আমাদের ওপর কড়াকড়ির মাত্রা আরেক দফা বাড়লো।
আগষ্ট মাসের শেষের দিকে জামালের চিঠি পেলাম। এ সময় আমার শাশুড়ীর শরীর বেশী খারাপ থাকায় তাকে হাসপাতা্লে ভর্তি করা হলো। প্রতিদিন দু’ঘন্টার জন্য আমাকে হাসপাতালে যাবার অনুমতি দেয়া হলো। রোগী দেখার ভান করে ওপার থেকেও অনেকে আসতো। ওদের মাথায় হাত রেখে হানাদার প্রহরীদের দেখিয়ে উপদেশ দিতাম ঠিকমতো ঘরে থেকে লেখাপড়া করার জন্য। এক ফাঁকে চিঠিটা হস্তগত করে নিজে সাথে করে নীচ পর্যন্ত পৌঁছে দিতাম ওদেরকে। ভীষণ ভয় লাগতো ওদের জন্য। কিন্তু আল্লাহকে ডাকা ছাড়া কিইবা আমি করতে পারতাম তখন।
ঠিক এভাবেই কেটে গেছে আমার দিন। সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল, তা দিয়েই চলতো আমার ছোট সংসার। দুঃখ-দৈন্য যন্ত্রণা দেহমনে সব কিছুই যেনো আটকে গিয়েছিল। প্রতি মুহূর্তে একটি সন্দেহ দিয়ে ঘেরা মৃত্যুর রাজত্বে ধুঁকে ধুঁকে দিন কাটতো আমাদের।
প্রিয়জনরা ছড়িয়ে আছে চারদিকে। জানতাম না কেমন আছে ওরা। স্বামীর জন্য আর চিন্তা করতাম না। কেননা আল্লাহ ছাড়া তাঁকে বাঁচাবার সাধ্য যে আর কারো নেই।
এ কথা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। তবু মাঝে মাঝে শিরা উপশিরাগুলো অবশ হয়ে আসতো। কোথায় আমার বুকের সন্তানেরা আর এই কারাগৃহে আবদ্ধ আমাদের জীবনের স্থায়ীত্বই বা কোথায়?
নভেম্বরের শেষের দিকেই বুঝতে পেরেছিলাম ডিসেম্বরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমার বন্দী জীবনে বাইরের সংবাদ আসার কোন উপায় ছিল না। কিন্তু ট্রানজিস্টার সেটটা ছিল। আমরা শুনেছিলাম ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে সেই দিনই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে। তিন তারিখের কলকাতার ঐতিহাসিক জনসভা শোনার জন্য তাই আমাদের প্রতীক্ষা ছিল একটা ভিন্নতর। ইন্দিরাজীর ভাষণ শেষ হলো। খুবই বিস্ময় লেগেছিল। কেন যেন ট্রানজিস্টারের সামনে থেকে নড়তে ইচ্ছা করছিল না। রাত বাড়ল আকাশ বাণীর সংবাদ শেষ হলো। হঠাৎ ঘোষণা করা হলো শীঘ্রই বিশেষ ঘোষণা প্রচার করা হবে। সমস্ত দিনের ক্লান্ত দেহমন। পরিবারের সকলেই ঘিরে বসলাম ট্রানজিস্টারের চারদিক। কিন্তু কোথায় সে ঘোষণা সময় কেটে যাচ্ছিল। একে একে বাচ্চারা ঘুমুতে চলে গেল। মাথার কাছে ট্রানজিস্টারটা খোলা রেখে প্রতীক্ষা করতে করতে কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙ্গলো বিমানবিধ্বংসী কামানের কটকট শব্দে। বুঝলাম যুদ্ধ বেঁধে গেছে।
৬ই ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দিল স্বাধীন বাংলাদেশকে। সে এক অনন্য অনুভূতি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতির সংবাদ এলোমেলো করে দিচ্ছিল আমার দেহ মনকে। বাচ্চারা কাঁদছিল ওদের আব্বার জন্য। আমি চেষ্ঠা করছিলাম ওদেরকে সান্ত্বনা দিতে, কিন্তু স্বাধীনতার স্বীকৃতি আর অতি প্রিয়জনের মুত্যুর আশঙ্কা আমার আত্নাকে যেনো অসার করে তুলেছিল।
ডিসেম্বরের দিনগুলো প্রতিদিন যেনো নতুন নতুন বিভীষিকা হয়ে দাড়াতো।
১৭ তারিখ সকালে যখন পাক আর্মিকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছিল তখন শেখ মুজিবের বাসা থেকে শুধু মাত্র সিভিল আর্মড অফিসার দুজনকে সরিয়ে নেয়া হয়। প্রধানতঃ আর্মিকে শৃঙ্খলায় রাখার জন্য সিভিল আর্মড অফিসার নিয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে সিভিল আর্মড অফিসার দু’জনকে ফিরিয়ে নেয়ার সাথে সাথে আর্মি প্রহরীরা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল। প্রথম দিকে ওরা আশা করেছিল যে, ওদেরও নিয়ে যাবার ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু দুপুর পর্যন্ত যখন চারিদিক থেকে “জয়বাংলা” ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল তখন ভীষণ রকম ক্ষেপে গেল ওরা।
আমাদের ঘরের মধ্যে কাপড় শুকোবার জন্য তার বাধাঁ ছিল। রাতে তারটা ঝনঝন করে বেজে উঠতেই সবাই দাড়িয়ে পড়লাম। রক্তের মত লাল দু’টো চোখ। প্রহরী দলের অধিনায়ক সুবেদার রিয়াজ দাড়িয়ে ছিল বারান্দায়। কঠোর ভাবে সে বললো খোকাকে ডাকো্। ঠান্ডা হয়ে বললাম খোকা ঘুমিয়ে পড়েছে। কোন কথা থাকলে আমাকে বলতে পার। আমার মুখের দিকে কঠোর ভাবে তাকিয়ে সে বলল সাবধানে থাকো।
মেজর তারা সিং এলেন বেলা ন’টার সময়। তারা সিং সাধারণ বেশে এসেছিলেন কিন্ত পেছনে তিনি একদল সৈন্যকে পজিশন নেয়া আবস্থাতে রেখে দিয়েছিলেন চারদিকে। খালি হাতে শুধু ওয়ারলেস সেট সাথে নিয়ে তিনি গেটের সামনে দাড়িয়ে ওদেরকে বুঝাচ্ছিলেন। প্রথমে ওরা সারেনডার করতে চায়নি। শেষে দু’ঘন্টা সময় চেয়েছিল। গেটের সামনে থেকে ওদের কথা শুনে মেজর তারা সিং যেই পা বাড়ালেন অমনি ভেতর থেকে চিৎকার উঠলো বাচ্চারা আপনি যাবেন না মেজর। যাবেন না। সময় পেলেই ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলবে। সত্যিই সময় পেলে ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলতো। কিন্তু মেজর তারা সিং তাদের আর সে সময় দেননি। ঢুকে পড়েছিলেন গেটের মধ্যে।
পাশের বাঙ্কার থেকে কাঁপতে কাঁপতে হানাদাররা তখন বের হয়ে আসছে আত্নসমর্পণের জন্য।“
-দৈনিক বাংলা
১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২