বংশাল ফাঁড়ির প্রতিরোধ
(শারদীয় কালান্তর, সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত সত্যেন সেন রচিত “নাদির গুন্ডা” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)
১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের সেই ভয়ংকরী রাত্রি, যার কথা বাংলাদেশের মানুষেরা কোনো দিনই ভুলতে পারবে না। ওরা ঢাকা শহরকে রক্তবন্যায় ভাসিয়ে দেবার জন্য অতর্কিতে নেমে এলো। ওরা জানতো, এদেশে ওদের পক্ষে কেউ নেই। সরকারী কর্মচারী থেকে রাস্তার পুলিশ পর্যন্ত, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী থেকে শহরের মেহনতী মানুষ আর গ্রামের কৃষক পর্যন্ত জনসাধারণের সমস্ত স্তর থেকে ওরা সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। তাই পশ্চিমী শাসক চক্রের জঙ্গী বাহিনী কোন রকম বাছ-বিচার না করে সর্বগ্রাসী আক্রমণ নিয়ে নেমে এসেছিল।
রাত বারোটার পর ঘড়ি দেখে কাঁটায় কাঁটায় একই সঙ্গে ওরা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল, লালবাগ, পিলখানায় ইপিআর ব্যারাকে, পুলিশ ব্যারাকে এমনকি থানায় থানায় ফাঁড়িতে ফাঁড়িতে আক্রমণ করে বসলো। সবাই জানে, একমাত্র রাজারবাগ পুলিশ লাইন ছাড়া আর কোন জায়গা থেকে তারা কোনো প্রতিরোধ পায়নি, যেখানে গেছে সেখানেই অবাধে ধ্বংসলীলা চালিয়ে গেছে। কিন্তু এর ছোট্ট একটা ব্যতিক্রমও আছে। এই খবরটা কিন্তু খুব কম লোকই জানে।
নবাবপুর থেকে বংশালের রাস্তায় ঢুকলে বাঁয়ে নিশাত সিনেমা হল, ডাইনে দৈনিক সংবাদ অফিস, সেখান থেকে একটুখানি এগিয়ে গেলে বংশাল ফাঁড়ি। কিছুসংখ্যক সৈন্য মেশিনগান-রাইফেল নিয়ে এই ফাঁড়ি আক্রমণ করতে গিয়েছিল। তারা নিশ্চিন্ত মনে রাত্রির নিঃশব্দতার বুকে আর্মি বুটের খট খট শব্দ হেনে ফাঁড়িটার দিকে এগিয়ে চলেছিল। এখানে কারো কাছ থেকে যে প্রতিরোধ আসতে পারে এমন কথা তারা কল্পনাও করতে পারেনি। ভেবেছিল, অবাধে ও স্বচ্ছন্দে তাদের হত্যালীলা চালিয়ে যাবে, একটা প্রাণীকেও রেহাই দেবে না। কিন্তু ফাঁড়িটার কাছে যেতেই এক পশলা বৃষ্টিধারার মতো মেশিনগানের গুলি তাদের অভ্যর্থনা জানাল। ওরা ভীষণ চমকে উঠে পিছিয়ে গেল। এটা কি বিশ্বাস করবার মতো কথা। এক সামান্য ফাঁড়ির জনকয়েক পুলিশ, তাদের এত বড় সাহস হবে! কিন্তু বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না, ওদের মধ্যে কয়েকজন সেই গুলিতে আহত হয়েছে। এরপর ফাঁড়ির ভেতর থেকে পরপর কয়েকবার রাইফেলের শব্দ শোনা গেল।
এবার দু’পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। বংশালের পথে একটিও জনপ্রাণী নেই। ঘরে ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ। কারো কোন সাড়া-শব্দ নেই, শুধু ঘন ঘন মেশিনগান আর রাইফেলের শব্দে বংশালের পথ আর দুই ধারের বাড়িগুলি থেকে থেকে কেঁপে উঠছিল। সৈন্যরা বেশ একটু বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলো।
ফাঁড়ির ভেতরে কে কোথায় আছে, কারা কি করছে- কিছুই তারা দেখতে পাচ্ছিল না। অপর পক্ষে অন্ধকার ফাঁড়িটার মধ্যে উপযুক্ত জায়গায় পজিশন নিয়ে প্রতিরোধকারীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছিল। রাস্তার আলোয় সৈন্যদের তারা ভালো করেই দেখতে পাচ্ছিল। ফলে এইবার ওরা বেশিক্ষন লড়াই চালিয়ে যেতে পারলো না, তখনকার মতো সেখান থেকে পৃষ্ঠভঙ্গ দিল।
ফাঁড়ির মধ্যে প্রতিরোধকারীরা উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলল। আক্রমণকারীদের মধ্যে জনকয়েক সম্ভবত হতাহত হয়েছিল। কিন্তু পশ্চাদপসরণকারী সৈন্যরা তাদের কোনো চিহ্ন রেখে যায় নি।
ফাঁড়ির পুলিশেরা এভাবে একদল সশস্ত্র সৈন্যকে হটিয়ে দেবে, এটা সত্য সত্যই অভাবনীয়। আরও আশ্চর্যের কথা, তারা ফাঁড়ির মধ্যে থেকে মেশিনগান চালিয়েছিল। থানা বা ফাঁড়ির পুলিশদের হাতে কখনো মেশিনগান দেওয়া হয় না। একমাত্র বন্দুক ও রাইফেল তাদের সম্বল। এই সংকট মুহূর্তে এই মেশিনগান কেমন করে তাদের হাতে এলো?
বংশাল মহল্লার লোকের মুখে এর উত্তরটা আমি পেয়েছি। এটা শুধু ফাঁড়ির পুলিশের কাজ নয়। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল এই মহল্লারই সুপরিচিত নাদির গুন্ডা ও তার কয়েকজন সাগরেদ। যোগ দিয়েছিল বললে কথাটা সঠিকভাবে বলা হবে না। কার্যত এই নাদিরের নেতৃত্বেই নাকি এই প্রতিরোধকে সংঘটিত করে সৈন্যদের হটিয়ে দেয়ার সম্ভব হয়েছিল।
নাদিরের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে ফাঁড়ির পুলিশেরা এ কাজে হাত দিতে সাহস করত না। আর মেশিনগান? শুধু বংশাল মহল্লা নয়, পাশাপাশি মহল্লার অনেকেই এ কথা শুনেছিল যে সারা শহরের মধ্যে এক্তিমাত্র লোক আছে যার হাতে একটি মেশিনগান আছে। সেই লোকটি হচ্ছে নাদির গুন্ডা নামে পরিচিত নাদির মিয়া। কি করে সে এই মেশিনগান সংগ্রহ করেছিল, একমাত্র সে-ই জানে।
প্রাক-স্বাধীনতার যুগে বিখ্যাত উর্দু লেখক কিষণচন্দর ‘তিন গুন্ডা’ নামে এক অপূর্ব কাহিনী লিখেছিলেন। কাহিনীর সেই তথাকথিত গুন্ডারা স্বাধীনতা আন্দোলন উপলক্ষে গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু সত্য সত্যই এরা কেউ গুন্ডা ছিল না। সরকারী প্রচারণায় স্বাধীনতা আন্দোলনের এই শহীদদের গুন্ডা বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
নাদির গুন্ডার ব্যাপারটা কিন্তু সে রকম নয়। সত্য সত্যই সে গুন্ডামি করত। যেই পরিবেশে জন্মেছিল, বড় হয়েছিল, সেই পরিবেশই তাকে এই পথে টেনে আনে। বয়স আর কত? ত্রিশের কোঠার নিচেই ছিল। এই বয়সেই সে গুন্ডা নামে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল। তবু সাধারণ গুন্ডাদের চেয়ে সে স্বতন্ত্র ছিল। তার পরিচিত যারা, এর কথাটা তাদের জানা ছিল যে, অনেকে বিপদে-আপদে নাদির গুন্ডার কাছ থেকে নানাভাবে সাহায্য পেয়েছে, ভালোবাসাও পেয়েছে।
এই সংসারে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা বিশ্বাস করা কঠিন অথচ সত্য। নাদির গুন্ডার জীবনে এমনি এক ঘটনা ঘটল। স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের সংস্পর্শে এসে লোকটা কেমন করে যেন সম্পূর্ণ বদলে গেল। আর সব কথা যেন ভুলে গেল সে। কেমন করে বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের হাত থেকে মুক্ত করা যাবে- এটাই তার ধ্যান, জ্ঞান, জপমন্ত্র হয়ে দাঁড়াল। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না হলেও সে বিভিন্ন মহল্লায় রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলত।
একটা বিষয়ে সে নিঃসন্দেহে ছিল যে, সত্য সত্যই ওদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে সশস্ত্র সংগ্রামে নামতে হবে। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সে এই মেশিনগান আর অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়েছিল। আর এই নাদির গুন্ডার প্রভাবে একই পথের পথিক আরও কয়েকটি ছেলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল।
পঁচিশে মার্চের সেই বিভীষিকা নাদিরের মনকে বিন্দুমাত্র দমিয়ে দিতে পারেনি। ওদের সেই পৈশাচিক হত্যা আর ধ্বংসলীলা তাকে প্রতিহিংসায় উম্মত্ত করে তুলেছিল। সারা শহরে হতাশা আর আতঙ্কের আবহাওয়া। তার মধ্যে দুর্জয় সাহস বুকে নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সে প্রতিরোধের কৌশল ও সংগঠন গড়ে তুলেছিল। তার এই সাহস আর নিষ্ঠার পরিচয় পেয়ে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে মহল্লার লোকেরা তাকে আপন মানুষ বলে চিনে নিল।
তারা বলাবলি করত, এই শহরে নাদিরের মতো আরও গোটা কয়েক মানুষ যদি থাকত, তবে আমরা ওদের নাভিশ্বাস তুলে দিতে পারতাম। নাদিরের নামটা মিলিটারি গোয়েন্দাদের কাছে পৌঁছাতে দেরি হয়নি। তারা তন্নতন্ন করে তার সন্ধান করে ফিরেছিল।
পঁচিশে মার্চের পর থেকেই লুণ্ঠনরত সৈন্যের দল ঘরবাড়ি-দোকানপাট ভেঙ্গেচুরে ইচ্ছামতো লুঠপাট করে চলেছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে শহরের গোটা কয়েক রেশনের দোকান লুট হয়ে গেল। শহরের মানুষ ভয়ে আঁতকে উঠল। এভাবে রেশনের দোকান যদি লুট হয়ে যায়, তবে খাবে কি তারা? শেষকালে কি না খেয়েই মরতে হবে? ভয়ে দিশেহারা মানুষ কি করবে পথ খুঁজে পায় না।
রেশনের দোকানের মালিকেরা ভয়ে দোকান খুলতে চায় না। এই দুর্দিনে সর্বসাধারনের অবস্থা চিন্তা করে অস্থির হয়ে উঠল নাদির। কিছু একটা করতেই হয়। ঐ শয়তানেরা এসে রেশনের চাল লুট করে নিয়ে যাবে আর তারা অসহায়ের মতো হাত গুটিয়ে বসে বসে দেখবে, এ কিছুতেই চলবে না। কিন্তু কি করতে পারে সে?
একদিন মহল্লার লোকেরা অবাক হয়ে দেখল নাদির আর তার দলবল তাদের রেশনের দোকান ভেঙ্গে বস্তা বস্তা চাল বের করে নিয়ে যাচ্ছে। শেষকালে নাদিরের এই কাজ! তারা হতবুদ্ধি হয়ে গেল। কিন্তু একটু পরেই তাদের আসল ব্যাপারটা বুঝতে বাকি রইল না। নাদির তাদের মুখের দিকে চেয়েই এই দুঃসাহসের কাজে হাত দিয়েছে। নাদির আর তার সঙ্গীরা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সেই চাল মহল্লার ঘরে ঘরে ভাগ করে দিল। পাড়ার লোকে তখনকার মত কিছুটা চাল পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। হাতের কাজটা সেরে ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেল নাদির। তার মাথার উপর মৃত্যুর পরোয়ানা ঝুলছে। খবরটা ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। মিলিটারির জীপ তার সন্ধান নিয়ে ফিরছে।
এরপর দুঃসাহসী নাদির আর বেশীদিন কাজ করার সুযোগ পায়নি। এপ্রিলের মধ্যভাগে গ্যাদা নামে এক কুখ্যাত গুন্ডা তাকে মিলিটারির হাতে ধরিয়ে দিল। গ্যাদা ইতিমধ্যেই মিলিটারির দালালি করে আরো কয়েকজনকে ধরিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া নাদিরের বিরুদ্ধে তার ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল। একবার নাদিরের গুলিতে জখম হয়ে তাকে বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল। তখন রাত অনেক হয়েছে। নাদির একটি জীপে করে আসছিল। আর্মানিটোলা ময়দানের কাছে এসে তার জীপটা একটা বাড়ির পাশে দাঁড়াল। ওরা আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল। একটা সঙ্কেত পেয়ে মিলিটারির লোকেরা বিদ্যুৎগতিতে এসে তার জীপটাকে ঘিরে ফেলল। তারপর তারা তাকে ধরে নিয়ে তাদের আস্তানায় চলে গেল। নাদির সেই যে গেল, তারপর আর ফিরে আসেনি। ফিরে আসবে না কোনদিন।