(১) জয়দেবপুর-তেলিয়াপাড়া প্রতিরোধ যুদ্ধ সাক্ষাতকারঃ ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোরশেদ খান

<৯, ৪.২, ১৯৬-১৯৯>

জয়দেবপুর-তেলিয়াপাড়ার প্রতিরোধ যুদ্ধ

সাক্ষাতকারঃ ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোরশেদ খান

(১৯৭১ সালের মার্চে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টে লেফটেন্যান্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বাংলা একাডেমী দলিলপত্র থেকে সংকলিত সাক্ষাৎকারটি ১৯৭৩ সালে গৃহীত)

২৫ শে মার্চ সকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এবং টঙ্গী টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং খবরাখবর নিই। জয়দেবপুরের জনসাধারণ তখন দারুণভাবে উত্তেজিত। তারা টেলিফোনে আমাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য দারুণভাবে চাপ দিতে থাকে। দুপুর বারোটার সময় টঙ্গী টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে জানতে পারি যে, পাঞ্জাবী কমান্ডো ব্যাটালিয়ানের কিছু সাধারণ পোশাকধারী সৈন্য টঙ্গী ব্রীজ দখল করে জনসাধারণের উপর গোলাগুলি চালাচ্ছে। তখন আমরা বুঝতে পারি এবং ধারণা করি যে পরবর্তী আক্রমণ হয়তবা আমাদের উপর করবে।

 

রাত্রে আমরা পাঞ্জাবীদের দ্বারা আক্রান্ত হবো মনে করে জয়দেবপুর প্যালেসের চতুর্দিকে পরিখা খনন করে পাহারা দিই। আমি কর্তব্যরত থাকাবস্থায় রাত প্রায় সাড়ে বারোটার সময় ঢাকা থেকে টেলিফোন গেল এবং সে টেলিফোন করেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান স্বয়ং। তিনি আমার অফিসার কমান্ডিং লেঃ কঃ রকীবকে ডাকতে বলেন। আমি লেঃ কঃ রকীবের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করি এবং লেঃ জেঃ টিক্কা খানের টেলিফোনের কথা জানাই। লেঃ কর্নেল রকীব অফিসে আসবার পূর্বেই পুনরায় টিক্কা খানের এডিসি টেলিফোন করেন। তিনি আমার কাছে জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীর খবর জানতে চান। অর্থাৎ জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরী জনসাধারণ আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র নিতে পারে। কাজেই তাকে রক্ষা করার জন্য আমরা কিরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি সে কথা জানতে চান। তার জবাবে আমি বললাম যে জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীর খবর পুরাপুরি জানি না। তবে আমাদের সঙ্গে দু’টি অয়ারলেস সেট আছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিস্থিতির কথা জানাব। এমন সময় লেঃ কর্নেল রকীব আমার অফিসে চলে আসেন এবং আমি তাঁকে টিক্কা খান ও তার এডিসির টেলিফোনের কথা জানালাম। তিনি তখন আমাকে একজন অফিসারের নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈন্য জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে পাঠাতে বলেন এবং অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে খবর দিতে বলেন। আমি তার নির্দেশমত কাজ করলাম। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন অফিসার আমার ডিউটি কক্ষে আসলেন। তাঁদের সঙ্গে সারারাত পরিস্থিতির উপর আলোচনা হয়।

 

২৬শে মার্চ সকাল আটটায় রেডিওতে সামরিক আইনের ঘোষণা শুনি। এরপর থেকে আমরা সবাই অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়ি এবং কি করতে পারি সে বিষয়ে আলোচনা করি। এবং শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে আমরা জয়দেবপুর থেকে বেরিয়ে পড়ব। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে আমরা অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে দুই প্লাটুন সৈন্য এবং রাজেন্দ্রপুর এম্যুনিশন ডিপোতে এক প্লাটুন সৈন্যের কথা চিন্তা করি এবং তাদেরকে কিভাবে আমাদের মাঝে আনতে পারি সে বিষয়ে চিন্তা করি। এভাবে ২৬শে মার্চ জয়দেবপুর কাটাই।

 

২৭শে মার্চ সকালে আমরা সবাই মিলে লেঃ কর্নেল রকীবকে কিছুটা জোর করে অয়ারলেসে ময়মনসিংহে অবস্থিত কোম্পানীকে জানাতে বললাম যে, তারা যেন জনসাধারণের সঙ্গে যোগ দেয় এবং সম্মিলিতভাবে কাজ করে। লেঃ কর্নেল রকীব তখন অয়ারলেসে ময়মনসিংহে মেজর (বর্তমান লেঃ কর্নেল) নূরুল ইসলামকে আমাদের কথা জানাতে বাধ্য হলেন এবং তাদেরকে জনসাধারণের সঙ্গে মিশতে বলেন।

 

২৮শে মার্চ ক্যাপ্টেন (বর্তমান মেজর) আজিজকে সকালে পাঠানো হল “রাজেন্দ্রপুর এম্যুনিশন ডিপোতে” এবং সেখানে তিনি গিয়ে আমাদের বাঙালি কোম্পানীকে খবর দেবেন কিভাবে তারা বের হয় এবং আমাদের পাওয়া মাত্র যেন বের হয়। এ খবর নিয়ে ক্যাপ্টেন আজিজ চলে গেলেন।

 

সকাল দশটার সময় ৪টা ট্রাক ও ৩টা জীপ নিয়ে আমরা এক কোম্পানী অগ্রসর হলাম ময়মনসিংহের দিকে। আমি টাঙ্গাইল থেকে গেলাম। পুরা কোম্পানী নিয়ে মেজর শফিউল্লাহ ময়মনসিংহ চলে যান। যাবার পথে বহু লোক পথের মধ্যে হাত তুলে ও ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানায়।

 

আমি টাঙ্গাইল পৌঁছেই জানতে পারলাম যে টাঙ্গাইলে অবস্থিত বাঙালি কোম্পানী পূর্বেই জনসাধারণের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাজ শুরু করেছে। তখন আমার সঙ্গে কাদের সিদ্দিকী আলাপ করতে আসেন। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করার পর কয়েকটি গাড়ী সংগ্রহ করার প্রতিশ্রুতি দিল।

 

আমি আমার কোম্পানীর সৈন্যদের নিকট গিয়ে তাদেরকে আমার আয়ত্তে নিলাম। উক্ত কোম্পানীর কোম্পানী কমান্ডার ছিলেন মেজর কামাল (পাঞ্জাবী)। তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললাম ভয় না করার জন্য। সন্ধ্যায় ডাকবাংলোতে কাজেম কামালের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করি। পরে আমি আমার ড্রাইভার ও গার্ডকে নিয়ে জীপে রাস্তায় বেরুলাম জয়দেবপুর থেকে আমাদের কোম্পানী আসছে কিনা দেখবার জন্য। কিছুদূর যাবার পর অনেক দূরে একটি গাড়ীর আলো দেখতে পাই। মনে হল আমাদের সৈন্যরা জয়দেবপুর থেকে আসছে। আমি ডাকবাংলোতে ফিরে আসছি এমন সময় ডাকবাংলোতে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেল। সোজা ডাকবাংলোতে না পৌঁছে আমি আমার সুবেদারকে ডেকে ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করলাম। সুবেদার বললো, স্যার কিছু না, সব ঠিক আছে। গোলাগুলি শেষ হবার পর ডাকবাংলোয় গিয়ে দেখি মেজর কাজেম কামাল ও তার সাথে আরও ৫/৭ জন পাঞ্জাবী সৈন্য আহত ও নিহত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মেজর কাজেম কামাল ও তার পাঞ্জাবী সৈন্যরা আমার অনুপস্থিতিতে পালানোর চেষ্টা করে এবং গুলি শুরু করে। আমাদের সৈন্যরা পাল্টা গুলি করলে তারা আহত ও নিহত হয়। এমন সময় আমাদের জয়দেবপুরের সৈন্যরা টাঙ্গাইল পৌঁছে।

 

জয়দেবপুরের সৈন্যরা টাঙ্গাইল পৌঁছলে তারা আমাকে আমার কোম্পানীসহ ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হতে বলে এবং তারাও ময়মনসিংহের দিকে রওনা দেয়। আমি তখন নিহত পাঞ্জাবী সৈন্যদের সরিয়ে ফেলার জন্য জনসাধারণকে অনুরোধ করি। আমার গাড়ী তখনও সংগ্রহ না হওয়ায় আমি নিজেই কয়েকটি গাড়ী তাড়াতাড়ি সংগ্রহ করি। তখন রাত প্রায় তিনটা। আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হই। রাস্তায় অনেক ব্যারিকেড থাকায় বেশী দূর অগ্রসর হতে পারলাম না।

 

২৯শে মার্চ ভোরে আমরা মুক্তাগাছার কাছাকাছি পৌঁছলাম। আমাদের পূর্বে জয়দেবপুর থেকে যে সেনাদলটি ময়মনসিংহ রওনা দিয়েছিল তারাও মুক্তাগাছায় পৌঁছেছিল। তারা ময়মনসিংহের দিকে রওনা দেয়। আমি মুক্তাগাছাই রয়ে গেলাম। মধুপুরেও কিছু সৈন্য ছিল। সকাল দশটার দিকে মেজর নূরুল ইসলাম ময়মনসিংহ থেকে টেলিফোনে বললেন, আমাদের পিছনে ফেলে যাওয়া কালিহাতী ব্রীজ উড়িয়ে দিতে। আমি মেজর নূরুল ইসলামকে বললাম ব্রীজ উড়ানোর মত তেমন কোন এক্সপ্লোসিভ নেই। কেননা তখন আমার নিকট আশি পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ ছিল। তা দিয়ে সম্ভব হলে আমি চেষ্টা করবো। আমি কালিহাতী ব্রীজ উড়িয়ে দেওয়ার জন্য পিছনে ফিরলাম। কালিহাতী ব্রীজ উড়ানোর জন্য পরিকল্পনা নিচ্ছিলাম। এমন সময় কাদের সিদ্দিকী সেখানে পৌঁছেন এবং তাঁকে আমরা টাঙ্গাইলে ফেলে আসাতে দুঃখ প্রকাশ করি। গ্রামের ও আশেপাশের লোকজন তখন অনেক জমা হয়েছে। তারা আমার ব্রীজ উড়ানোর কথা শুনে আপত্তি করেন। কেননা চতুর্দিকে গ্রাম ছিল। পাঞ্জাবীরা তাদের অত্যাচার করবে, এ জন্য গ্রামবাসী ব্রীজ উড়ানোর পক্ষে মত দেন নাই। আমার নিকটও অল্প এক্সপ্লোসিভ থাকায় ব্রীজ উড়ানো সম্ভব হল না, কাদের সিদ্দিকী আমার কাছে একটা পিস্তল চাইলেন। কিন্তু পিস্তল না থাকায় তাকে দিতে পারলাম না। তারপর সেখান থেকে সোজা ময়মনসিংহ রওনা দিই। বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে ময়মনসিংহে পৌঁছলাম। ময়মনসিংহে চতুর্দিকে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। আমরা পাঁচটা কোম্পানী তখন ময়মনসিংহে একত্রিত হয়েছি। সেখান থেকে আমাদের অপারেশন পরিকল্পনা শুরু করি। মেজর শফিউল্লাহ তখন আমাদের কমান্ডিং অফিসার। সেখানে জনসাধারণ ও নেতৃবৃন্দ উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করি।

 

৩০শে মার্চ ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও সৈন্যরা ময়মনসিংহে ছিলাম। এই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় খবর পাঠাই ও যোগাযোগ করি। সীমান্ত এলাকায় সমস্ত ইপিআরদের খবর দিই সীমান্ত এলাকা ছেড়ে ময়মনসিংহে পৌঁছার জন্য। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ময়মনসিংহ থেকে পাকিস্থানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে এ খবর বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই। অয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামের খবর পাই। চট্টগ্রামের ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর সঙ্গে পাকিস্থানী সৈন্যদের যুদ্ধ চলছে, সে সমস্ত খবর আমরা পাই। রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। এবং জানতে পারি যে রাজশাহী, পাবনা, বগুড়ায় পাঞ্জাবী সৈন্যরা দারুণভাবে মার খেয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বহু ইপিআর ও সাবেক সৈন্য আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। একজন সুবেদারের কমান্ডে এক কোম্পানী সৈন্য পাঠানো হল মধুপুর গড়ে-পাকিস্থানী সৈন্যরা ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিনা তার খোঁজখবর নিতে এবং অবলম্বন করতে। তারপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমস্ত সৈন্য নিয়ে ট্রেনে নরসিংদী হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হবো। এমন সময় খবর পেলাম কুমিল্লার ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছেছে। তখন আমরা দুটি বেঙ্গল রেজিমেন্ট একত্র হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই এবং ঢাকার দিকে অগ্রসর না হয়ে ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে ভৈরব রওনা হলাম ৩১শে মার্চ রাতে। পুরা ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভৈরব ও কিশোরগঞ্জ পৌঁছলাম ১লা এপ্রিল।

 

ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) মতিয়ূর রহমানের কমান্ডে ইপিআর-এর একটা কোম্পানী পাঠান হলো নরসিংদীতে। মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে একজন অফিসার পাঠালেন ভৈরবে। ভৈরব থেকে তিনি কিশোরগঞ্জ চলে গেলেন মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে। সিদ্ধান্ত হলো আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌঁছালাম। চট্টগ্রাম থেকে মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার এবং ডেপুটি চীফ অব স্টাফ, বাংলাদেশ আর্মি) জিয়াউর রহমানকে সিলেটের তেলিয়াপাড়া পৌঁছার কথা বলা হলো। এবং আমরা ২য় এবং ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমস্ত সৈন্য তেলিয়াপাড়ার দিকে অগ্রসর হবার কথা জানালাম।

 

আমরা ২য় বেঙ্গল এবং ৪র্থ বেঙ্গল তেলিয়াপাড়া পৌঁছলাম। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানী আশুগঞ্জ পাঠান হয়। অন্য আর এক কোম্পানী সিলেট চলে যায়। আমি আলফা কোম্পানী অর্থাৎ আশুগঞ্জে পৌঁছি ৩রা এপ্রিল। আমার সঙ্গে অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন নাসিম। ক্যাপ্টেন নাসিম ছিলেন কোম্পানী কমান্ডার, আর আমি ছিলাম সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড। এখানে আমরা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলি। জনসাধারণ আমাদেরকে যথাসাধ্য সাহায্য করেন। কিছু আনসার ও মোজাহিদ রিক্রুট করি। কিছু নিয়মিত সৈন্যসহ এক প্লাটুন সৈন্য পাঠাই লালপুরে (আশুগঞ্জ থেকে দেড় মাইল দক্ষিণ দিকে)।

 

আনুমানিক ৮ই অথবা ৯ই এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী নরসিংদী দখল করে নেয়। ১৬ই এপ্রিল ভোরে ৫টার সময় পাকিস্তানী বিমান বাহিনী হঠাৎ আশুগঞ্জে আমাদের উপর বোমাবর্ষণ শুরু করে ৬টা স্যাবর জেট দ্বারা। সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে আমাদের তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানী সৈন্য ভৈরব ব্রীজের পশ্চিম দিকে ছিল এক ব্যাটালিয়ন। এক কোম্পানী প্যারাস্যুটে নামিয়ে দেয় আশুগঞ্জ শহরে। অন্য একটা ব্যাটালিয়ন পাঠায় লালপুর। সকাল আটটার সময় আমরা তিনদিক থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হই। তখন তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বেলা তিনটে পর্যন্ত যুদ্ধ অনবরত চলতে থাকে। আমাদের ১০/১২ জন সৈন্য ঐ যুদ্ধে শহীদ হন। ১৫/১৬ জন আহত হন। আমি এবং মেজর নাসিমও সামান্য আহত হই। অন্যপক্ষে পাকিস্তানী এক প্লাটুন সৈন্য যুদ্ধে নিহত হয়।

 

মেজর কে এম শফিউল্লাহকে জানালাম আমাদের পরিস্থিতি। তিনি আমাদেরকে সৈন্য তুলে নেওয়ার কথা বললেন। আমরা সৈন্য তুলে নিয়ে তালশহরে যাই। তালশহরে পৌঁছবার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করি। এমন সময় একজন মুক্তিবাহিনীর ছেলে একটা হোন্ডা নিয়ে আমাদের কাছে আসে। আমি উক্ত হোন্ডায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য যাই। কেননা আমি তখন আহত। মেজর শফিউল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি আমাকে তেলিয়াপাড়া যাবার পরামর্শ দেন। আমি ঐদিন সন্ধ্যায় তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে পৌঁছি।

 

তেলিয়াপাড়ায় আমাকে জানানো হলো মাধবপুরে ডিফেন্স দেওয়ার জন্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও তেলিয়াপাড়ার মাঝখানে মাধবপুর। মাধবপুরে ২৫শে এপ্রিল আমরা আবার ডিফেন্স তৈরি করি। এবং শাহবাজপুর ব্রীজ ভেঙ্গে দিই। আমি অত্যন্ত অসুস্থ হওয়ায় আগরতলা হসপিটালে চলে যাই। হসপিটালে দু’সপ্তাহ থাকতে হয়। ১লা মে আমি আবার তেলিয়াপাড়া পৌঁছি। তখনও মাধবপুরে আমাদের ডিফেন্স ছিল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তখন শাহবাজপুর পর্যন্ত পৌঁছেছে। তেলিয়াপাড়ায় মেজর শফিউল্লাহ আমাকে এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শাহবাজপুর পাঠান পাকিস্তানী সৈন্যদের রেইড করার জন্য। তেলিয়াপাড়া থেকে মাধবপুর হয়ে শাহবাজপুর পৌঁছতে আমার এক রাত দুই দিন লেগে যায়।

Scroll to Top