<৯, ৯.২, ২৮২-২৮৩>
সশস্ত্র প্রতিরোধ-রংপুর
সাক্ষাৎকার-লেঃ মোঃ আবদুস সালাম
০৭-০৬-১৯৭৩
২৬শে মার্চ সকাল বেলা রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের মার্শাল ল’ জারী করার কথা শুনতে পাই। এই সময় হাজার হাজার ক্রুদ্ধ জনতা শ্লোগান দিতে দিতে টোগরাই হাট রেল স্টেশনে আসে এবং ৩ মাইল পর্যন্ত রেল লাইন তুলে ফেলে এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
২৭শে মার্চ রংপুর থেকে একজন আর্মী ক্যাপ্টেন (নওয়াজেশ) আমাদের এখানে পালিয়ে এসে মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোক্তার আহম্মদ হোসেন সরকার সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ক্যাপ্টেনের কাছে ক্যান্টনমেন্টের ঘটনা বিস্তারিত জানি। ঢাকা থেকে একটা টেলিফোন এসেছিলো। ফোনে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশকে মেরে ফেলতে বলা হয়। ঘটনাচক্রে সেই ফোনে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশই কথা বলছিলো। তিনি টেলিফোনে উত্তর দিলেন, “এখনই ক্যাপ্টেন নওয়াজেশকে হত্যা করছি।”
ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ বিভিন্ন জায়গা থেকে পলায়নরত বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ ছাত্র জনতাকে নিয়ে একটা বাহিনী গঠন করেন এবং ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করেন। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ সাহেবের সঙ্গে আমি থানাতে গিয়ে ওসিকে কিছু রাইফেল দিতে বলি। কিন্তু ওসি রাইফেল দিতে অসম্মত হলে পরে তাকে রাইফেল দিতে বাধ্য করা হয়। থানা থেকে আমরা ২৫০টি রাইফেল জোগাড় করি।
ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের নেতৃত্বে আমরা তিস্তা নদীর পাড়ে ডিফেন্স নেই। নদীর অপর পাড়ে অবস্থানরত খান সেনারা রাত্রে আমাদের উপর শেলিং আরম্ভ করে। বলা প্রয়োজন যে, ঐ দিন সকাল দশটায় যখন আমরা চুপচাপ ডিফেন্স নিয়েছিলাম তখন খান সেনারা আমাদের অবস্থান জানতে না পেরে তিস্তা রেল ব্রিজের উপর দিয়ে কিছু খান সেনা এপারে চলে আসে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাদের উপর আক্রমণ চালাই। ঘটনাস্থলেই একজন মেজরসহ আট জনকে হত্যা করতে সক্ষম হই। যে মেজরকে হত্যা করি তার নাম এজাজ। পরবর্তীকালে তিস্তা ব্রিজের নাম পাল্টিয়ে খান সেনারা মেজর এজাজের নাম অনুসারে ব্রিজের নাম “এজাজ ব্রিজ” রাখে।
এখানে পাক বাহিনীর শেলিং-এর মুখে টিকতে না পেরে আমরা পিছু হটে কুড়িগ্রামে ডিফেন্স নেই। ৮ই এপ্রিল খান সেনারা কুড়িগ্রাম আক্রমণ করে। কুড়িগ্রামের তিন মাইল দূরে আমরা টকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। ৮ তারিখে খান সেনারা কুড়িগ্রাম দখল করে এবং ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত করে। বাড়ি ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। তারা পরে সোনালী ব্যাংকও লুট করে। ৯ তারিখে ছাত্র এবং গ্রামবাসী মিলে টোগরাইহাট থেকে তিস্তার প্রায় দশ মাইল রেল লাইন তুলে দেই যাতে খান সেনারা আমাদের এলাকায় তাড়াতাড়ি প্রবেশ করতে না পারে।
টোগরাইহাটের যুদ্ধঃ আমরা পুনরায় প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হই এবং ১৫ তারিখে আমরা টোগরাইহাটে ডিফেন্স নেই। খান সেনারা কুড়িগ্রাম থেকে একটা ট্রেন নিয়ে লাইন সারতে সারতে তিস্তার দিকে যাচ্ছিলো। ট্রেনটা যখন টোগরাই হাটের নিকট আসে তখন আমরা খুব দূরে থেকে কয়েক রাউণ্ড গুলি ছুড়ি। এই গুলির আওয়াজে খান সেনার গাড়ি থেকে নেমে পজিশন নেয়। পুনরায় আরো কয়েক রাউণ্ড গুলি ছুড়লে খান সেনারা শব্দের উৎসস্থল লক্ষ্য করে ধাওয়া করে। তারা যখন আমাদের নিকটবর্তী হয় তখন আমরা তাদের উপর আক্রমণ করি। উভয় পক্ষে সমান তালে যুদ্ধ চলতে থাকে। এই যুদ্ধ চৌদ্দ ঘন্টা স্থায়ী হয়। এই যুদ্ধে বহু খান সেনা নিহত হয় বলে আমরা খবর পাই। আর বাদ বাকী সৈন্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
যুদ্ধ শেষে আমরা যখন তিস্তা ব্রিজের দিকে যাচ্ছিলাম তখন রাস্তায় খান সেনাদের তিনটা দালালকে ধরতে সক্ষম হই। এরা ঐ অঞ্চলে লুটতরাজ, ডাকাতি, নারী ধর্ষণ হত্যা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত ছিলো। ঘটনাস্থলেই তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়।