গেরিলা যোদ্ধা

গেরিলা যোদ্ধা

 

আগস্ট মাস থেকেই কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ  কেন্দ্র এবং চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী বাংলাদেশের একমাত্র তৈল শোধনাগারটি অচল করার জন্য চাপ দিচ্ছিলাম। কিন্ত এই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র দুটি ধ্বংস হলে পাকিস্তানীদের চাইতে আমাদের ক্ষতি বেশি হবে বলে মনে করে আমি দুটি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করি। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং জ্বালানির অভাব দেখা দিলে শত্রুদের যান চলাচল সীমিত হয়ে পড়বে এবং এতে করে তাদের তৎপরতাও হ্রাস পাবে। কিন্ত আমার মনে হচ্ছিলো কেন্দ্র দুটি ধ্বংস না করেও অন্যভাবে আমাদের লক্ষ্য হাসিল করা সম্ভব।

 

আমরা ভাবনাকে সামনে রেখে একটি নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার সাবেক সিং এর সঙ্গে কথা বলি। তিনি ভারত সরকারের পক্ষ  থেকে বাংলাদেশের ১,২,৩ নম্বর সেক্টরের কার্যক্রমও চাহিদা সংক্রান্ত বিষয়ে সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলেন। আমাদের পরিকল্পনা ছিলঃ

 

১। মদনঘাটে বিদ্যুৎবিভাগের  সাব- স্টেশন ধ্বংস করা।

২। কাপ্তাই এবং চট্টগ্রামের মধ্যে যতগুলি সম্ভব বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করতে হবে।

 

আমার বিশ্বাস ছিল দুটি কাজ করতে পারলেই শত্রুপক্ষের বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ করে  চট্টগ্রাম বন্দরের  বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে এবং এতে করে ওদের বাণিজ্য অন্যান্য জাহাজ নোঙ্গরে অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে।

 

যথারীতি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে একাজের জন্য  আমি আমার সাথে কার্যরত বিমানবাহির নির্ভীক অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতানকে মনোনীত করলাম। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমি তাকে পরিকল্পনাটি বুঝিয়ে দিলাম এবং রেইডিং বাহিনীর সদস্যদের বেছে নিতে বললাম। এরপর সবাই মিলে আমরা কয়েকটি মহড়া দিলাম। রেইডিং পার্টির সদস্যদের কি কাজে পাঠানো হতো তা আগে থেকে বলা হতোনা। একেবারে সর্বশেষ ঘাঁটিতে পোঁছানোর পর যখন লক্ষ্যবস্তর উপর আঘাত হান্তে যাবে ঠিক তখনই তাদেরকে বলা হবে, তার আগে নয়। সুলতান তার দলের লোক এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র বেছে নিলো। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা  ধ্বংস করা ছাড়াও সুলতানের উপর ঐ এলাকার গেরিলা তৎপরতা হ্রাস পাওয়ার কারণ নির্ণয়ের দায়িত্ব দেওয়া হল।

 

১১ই সেপ্টেম্বর সুলতানের সঙ্গে কয়েকজন বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং কিছু সংখ্যক নিয়মিত সদস্যকে হরিণা থেকে এ অভিযানে পাঠানো হল।

 

৩রা অক্টোবর তার পার্টি দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে শহর থেকে মাইল খানেক দূরেই মদনাঘাটের ট্রান্সফরমার ধ্বংস করে দিলো। বহুসংখ্যক বৈদ্যুতিক পাইলনও উড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে কাপ্তাই থেকে সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়ে। বিশেষভাবে সুরক্ষিত মদনাঘাট বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির চারদিকে ছিল ইটের দেওয়াল আর দুর্ভেদ্য কাটাতারের বেড়া। এখানে মোতায়েন থাকতো ১০জন নিয়মিত সৈন্য এবং২০ জন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যের একটি প্লাটুন। তারা সবসময় চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিল। তার মধ্যে থেকে সুলতান তাঁর দল নিয়ে শত্রুর উপর সফলতার সাথে এই আক্রমণ সম্পন্ন করে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝিতে বন্দরের জাহাজ ধ্বংসের পর আবার দুঃসাহসী হামলায় শত্রুরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা বুঝতে পারলো যে গেরিলারা ক্রমান্বয়ে অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

 

অভিযান শেষ করে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান ঐ এলাকার অধিকাংশ গেরিলা গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করে তাদের অসুবিধা এবং সমস্যাবলী নিয়েও আলোচনা হয়। ১১ই অক্টোবর সুলতান হরিণায় এসে বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করেন।

 

গেরিলারা গ্রামাঞ্চলে বেশ কার্যকর অবস্থান গড়ে তুলেছিল। বস্তুতঃ সারা দেশটাই তখন পুরো গেরিলাঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিলো।ফলে যখন তখন যেকোনো দিকে সৈন্যরা অভিযান চালাতে পারতো। রাতগুলো ছিল একান্তভাবেই তাদের। ফলে পাকিস্তানী সৈন্যরা পারতপক্ষে রাতের বেলা বাইরে বের হতো না।

 

আমাদের পক্ষে জনগণের সমর্থন ছিল ব্যাপক। গেরিলাদের সাহায্যে আসতে পারলে লোকজন সম্মানিত এবং গর্ব অনুভব করতো। গেরিলাদের খাদ্য ও আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তানীরা বহু লোককে হত্যা করেছে, তাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে, সহায়- সম্পত্তি লুট করে সেই লুটের মালের বখরা পুরষ্কার হিসেবে রাজাকারও দালালদের দেওয়া হয়েছে। এতদশত্বেও জনগণের হৃদয় আবেগ এবং উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, যখন দেখেছে অল্প বয়সী তরুণেরা ভারী অস্ত্র- গোলাবারুদের ভারে নুজ্জ হয়েও দৃঢ় প্রত্যয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে শত্রু হননের দিকে এগিয়ে চলেছে। বাংলার জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানানোর জন্য সাগ্রহে প্রতীক্ষা করেছে দিনের পর দিন। দেশের ভেতরে অবস্থানকারী লোকজন যদি সেদিন এই ত্যাগ স্বীকার না করতো তাহলে অঙ্কুরেই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটতো।

Scroll to Top